অক্টোবর ৫, ২০২১
সাতক্ষীরায় সড়কের পাশের গাছ গুলোতে পেরেক মেরে টাঙানো হচ্ছে সাইনবোর্ড গাছের সাথে চরম নিষ্ঠুরতা
শেখ শাওন আহমেদ সোহাগ: সাতক্ষীরায় সড়কে ছায়া-দানকারী বৃক্ষের বুকে পেরেক ঠুকে চলছে ব্যবসায়ীদের পণ্যের প্রচার-প্রচারণা। এসব দেখা দেখিতে থেমে নেই রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধি, স্কুল-কলেজের ভর্তির প্রচারসহ বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রচারণাও।
বাদ যাচ্ছে না গ্রামীণ সড়কের দু’পাশে লাগানো বিভিন্ন ফলজ ও বনজ বৃক্ষের ডাল ও কান্ড। সড়কের এসব গাছে নাম জাহির করা প্রচারসহ নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের মন গলানো সাইনবোর্ড গুলো লোহার পেরেকের সাথে ঝুলে আছে গাছের মাজায়।
গাছ আমাদের পরম বন্ধু। গাছের সাথে মানুষের জীবনের গভীর সম্পর্ক। তবে শুধু মানুষই নয় জীব-জগতের সকল প্রাণির সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে ৫০ বছর বেঁচে থাকায় একটি গাছ আমাদের জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন দেয় ৫ লাখ টাকার, বায়ুদূষণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে ১০ লাখ টাকার, বৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে বাঁচায় ৫ লাখ টাকা, মাটির ক্ষয়রোধ ও উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে ৫ লাখ টাকা, প্রাণিদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে বাঁচায় ৫ লাখ টাকা, আসবাবপত্র, জ্বালানি কাঠ ও ফল সরবরাহ করে ৫ লাখ টাকার, বিভিন্ন জীবজন্তুর খাদ্য জোগান দিয়ে বাঁচায় আরও ৪০ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে মূল্য দাঁড়ায় ৩৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
অথচ মানুষের অকৃত্রিম বন্ধুটাকে চরম নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সাতক্ষীরা জেলার প্রতিটি সড়কের পাশে, অলিতে-গলিতে অসংখ্য গাছের গায়ে পেরেক ঢুকিয়ে কিংবা মোটা-তার দিয়ে বেঁধে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যানার, ফেস্টুন, প্রতিষ্ঠানের চটকদার বিজ্ঞাপন লাগানোর ঘটনা বেড়েই চলেছে। গাছেরও যে প্রাণ আছে সেটা মানুষ ভুলে যায় অবলীলায়। তাই প্রচারণার পেরেক ঠুকে ক্ষত-বিক্ষত করা হয় তার দেহ।
গাছে পেরেক বিদ্ধ করে সাইনবোর্ড না লাগাতে জাতীয় সংসদে ২০০২ সালে একটি আইন পাস হয়। কিন্তু শুধু কাগজপত্রেই আইনটি রয়েছে। বাস্তবে এর কোন প্রয়োগ নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ না নেওয়ায় গাছের উপর মানুষের অত্যাচার থামছে না বলে দাবি সচেতন মহলের।
জেলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায়, হাইওয়ে সড়ক থেকে শুরু করে ছোট-বড় সড়কের পাশের বিভিন্ন গাছে ঝুলছে অসংখ্য ব্যানার-ফেস্টুন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, সরকারি অফিস আদালতের সামনের চিত্রও একই। ফেস্টুনগুলো পেরেক দিয়ে গাছে আটকানো হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ব্যানার-ফেস্টুন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিং সেন্টার গুলোর বিজ্ঞাপনসহ বিবিধ।
পাঠক নন্দিত ‘‘দৈনিক সুপ্রভাত সাতক্ষীরা’’ এর প্রতিনিধি আশাশুনির সমীর রায়, দেবহাটার মীর খায়রুল আলম, শ্যামনগরের গাজী আল ইমরান, তালার সৌমেন মজুমদার ও জুলফিকার রায়হান, কলারোয়ার জাহাঙ্গীর আলম লিটন এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, এসব উপজেলার হাইওয়ে সড়ক থেকে শুরু করে প্রতিটি রাস্তার পাশের প্রায় গাছ গুলোতে ব্যানার- ফেস্টুনে ছেয়ে আছে। বড় বড় লোহার পেরেকের সাহায্যে গাছের গায়ে এমনভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছে যাতে কেউ সহজে খুলতে না পারে। বিশেষ করে সড়ক ও জনপদ বিভাগের রাস্তার পাশের বড় বড় গাছ গুলোতে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের সাইনবোর্ড দেখা যায়।
কালিগঞ্জের আব্দুল্ল্যাহ আল হাসান, বাপ্পী সরকার, আবু বক্কার সিদ্দিক, শেখ আলাউদ্দিন, হাবিবুল্ল্যাহ বাহার, রোকনুজ্জামানসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, গাছ আমাদের পরম বন্ধু। গাছ থেকে অক্সিজেন নিয়ে আমরা বেঁচে আছি। তবে চরম নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে ছোট বড় গাছ গুলো। গাছের গায়ে পেরেক ঢুকিয়ে লাগানো হচ্ছে বড় বড় সাইনবোর্ড। এতে সড়কের গাছ গুলো রয়েছে চরম ঝুঁকির মধ্যে। গাছ আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে কিন্তু কিছু মানুষ সেই গাছের সাথে চরম নিষ্ঠুরতা চালিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু যোদ্ধা বিন্দু নারী উন্নয়ন সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক জান্নাতুল মাওয়া বলেন, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু প্রমাণ করেছিলেন জীবদেহের মত গাছেরও প্রাণ রয়েছে। তিনিই লক্ষ্য করেছিলেন উদ্ভিদ ও প্রাণী জীবনের মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। মানুষের মত গাছেরও আবেগ, সুখ- দুঃখের অনুভূতি রয়েছে। গাছ ছাড়া আমরা এক মুহূর্ত বাঁচতে পারবো না। তবে অতি দুঃখের বিষয় সেই গাছের সাথেও আমরা চরম নিষ্ঠুরতা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের বিবেককে জাগ্রত করা উচিত। কালিগঞ্জ সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক শ্যামাপদ দাস বলেন, বিজ্ঞাপনের চাপে সারা দেশে বিপন্ন হচ্ছে গাছের অস্তিত্ব। সারা দেশে সড়ক ও জনপদ বিভাগের রাস্তার পাশে বিশালাকার শিরিষ, বট ও অশ্বত্থ গাছগুলোর গায়ে প্রচারণা গুলো গাছের গায়ে এমনভাবে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে যেন সহজে তা খোলা না যায়। ব্যবহার করা হচ্ছে পেরেক ও তারকাঁটার মত সামগ্রী। কালিগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার (বিসিএস, কৃষি) মোহাম্মদ শফিক আল সারাহ বলেন, রেইনট্রি বা এ জাতীয় গাছে মেরেক মারার ফলে প্রথমে আঠা ঝরে। এরপর ওই গাছে ছত্রাকসহ পোকার আক্রমণ হয়। বেশি মেরেক মারার ফলে কাঠের গুণগত মান নষ্ট হওয়াসহ গাছ মারাও যেতে পারে। এছাড়া লোহার তার শক্ত করে যেখানে বাঁধা হয় সেখানে গাছ চিকন হয়ে যায়। যার ফলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ওই গাছ গুলো ভেঙে যায়। আর নারিকেল গাছে গন্ডার পোকার আক্রমণ হয়। এবিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সড়কের পাশে গাছের সাথে টাঙানো ব্যানার-ফেস্টুন গুলো অতিদ্রুত অপসারণের জন্য সড়ক ও জনপদ বিভাগের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা নিয়েছি। এছাড়া আমরা সাধারণ মানুষদের গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রচার চালাবো। যেন এধরণের কাজ থেকে মানুষ বিরত থাকে।
8,632,567 total views, 12,117 views today |
|
|
|