খুব ছোটবেলা থেকেই আরিফিনকে বাংলা বিষয়ে অক্ষর জ্ঞান দেন তার বাবা নিজেই। ঈশ^র চন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয় প্রথমভাগ ও বর্ণ পরিচয় দ্বিতীয় ভাগ বই দুটি দিয়ে দিয়ে বাবা একটু একটু করে বাংলা পড়ান, আর সে খুব তাড়াতাড়ি সেটা রপ্ত করে নেয়। সেই থেকেই বাংলার প্রতি সৃষ্টি হয় তার গভীর অনুরাগ যা তাকে বসিয়েছে আজ শ্রেষ্ঠত্বের আসনে। হয়েছে দ্বিতীয় সেরা বাংলাবিদ। তাকে নিয়ে লিখেছেন বাহলুল করিম ও নুরুল হুদা-
সিরাজুল আরিফিন। ২০০২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে বাবা-মার কোল আলোকিত করে পৃথিবীতে আসে সে। তাদের পৈত্রিক নিবাস কালিগঞ্জ উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নের চুনাখালী গ্রামে হলেও বাবার চাকুরীর সুবাদে তখন তাদের পরিবার সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসেই থাকতেন।
ছেলেবেলা থেকেই বই তার নিত্য দিনের সঙ্গী। সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১১ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে ও ২০১৪ সালে অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি এবং ২০১৭ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ ও বৃত্তি প্রাপ্তির মধ্য দিয়েই স্কুল জীবন শেষ হয় তার।
স্কুল জীবনেই তার হাতেখড়ি হয় ভাষা প্রতিযোগিতায়। ২০১০ সালে যখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র, তখনই প্রথম আলোর ‘ভাষা প্রতিযোগ’ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় আরিফিন। এই প্রতিযোগিতায় সে টানা সাত বার জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃত হয়েছে। এরপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
তখন আরিফিনের এসএসসির ব্যবহারিক পরীক্ষা চলছে। বাংলাবিদের টিম স্কুলে স্কুলে প্রচার চালাচ্ছে। সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে গিয়ে বাংলাবিদের একটি লিফলেট নিয়ে আসে সে। লিফলেট দেখেই করে ফেলে রেজিস্ট্রেশন।
পরে বাংলাবিদের প্রাথমিক বাছাই পর্বে খুলনার সরকারি করোনেশন বালিকা বিদ্যালয়ে ১৫০০ প্রতিযোগীর সাথে সেও অংশ নেয়। প্রথম ধাপে ১০০ এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে খুলনা বিভাগের নির্বাচিত সেরা-১০ এ ঠাঁই পায় সে।
দেশে মোট সাতটি অঞ্চল। এর মধ্যে ঢাকা ও ময়মনসিং থেকে ২০ জন এবং বাকি ছয়টি অঞ্চল থেকে ১০ জন করে মোট ৮০ জন জাতীয় পর্যায়ে সিলেক্ট হয়। এই ৮০ জন থেকে প্রথম ধাপে বাদ পড়ে যায় ৪০ জন। তারপরে আরও একটি বাছাই পর্বে ২০ জনকে রাখা হয়। তালিকা ক্ষুদ্র হতে থাকে। কিন্তু আরিফিন আত্মবিশ্বাসী। ক্ষুদ্র তালিকাতে সে রয়েছেই।
আরিফিন জানায়, নির্বাচিত ২০ জনকে নিয়ে ওরা একটা ক্যাম্প করলো। সেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থাও ছিল। প্রতিটি ধাপেই প্রশ্নগুলো আমার কাছে বেশ সহজই মনে হয়েছে। এতোদিন যারা একসাথে ছিলাম কেউ কাউকে চিনি না। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সবাই এখানে এসেছি। পরে অবশ্য একসাথে গল্প করতাম, আড্ডা দিতাম। সারাদিন আড্ডা দেওয়ার পর ঠিক সন্ধ্যার পরে আমাদের শ্যুটিং শুরু হতো। ২০ জনের মধ্যে ১৬জন আছে। প্রথম দিনের শুটিং শেষে দেখলাম আমার পাশের বেডটা ফাঁকা হয়ে গেছে। এটা আসলে অনেক খারাপ লাগার বিষয়। এগুলো মনে দাগ কাটে। যা সহজে ভোলা যায় না।
নির্বাচিত হল সেরা-১০। এখান থেকে প্রতিদিন একজন করে বাদ যেত। সেরা- ৭ এ এসে পরপর দুই দিন একই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দিন কাউকে বাদ না দিয়ে দ্বিতীয় দিন ১জনকে বাদ দেওয়ার মধ্য দিয়ে সেরা- ৬ ঘোষণা করা হয়।
পরে সেরা-৬ জনকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয় মহোৎসব।
মহোৎসব নিয়ে আরিফিন বলে, আসলে এতো বড় অনুষ্ঠানে আমি এর আগে কখনো যোগ দেইনি। এতে প্রথম ধাপের বিষয় ছিল ’আমার’ পছন্দ। ছয়টি বিষয় থাকবে। লটারি করে আমাকে প্রথমে অবস্থান নিধারণ করে পরে পছন্দ করতে হবে। লটারিতে আমার স্থান হলো ষষ্ঠ। ফলে আমার আর পছন্দ করার কিছুই রইল না। অবশিষ্ট রইল শুধুমাত্র শব্দার্থ। শব্দার্থের ব্যাপারে আমার একটু ভয় লাগছিল। কারণ জাতীয় পর্যায়ে মহোৎসবের আগ পর্যন্ত কোন ধাপে কেহই শব্দার্থে পুরোপুরি নম্বর পায়নি। তখন আমি কিছুটা ভয় পাচ্ছি। আর প্রশ্নও হয়েছিল কিছুটা আনকমন। এই ধাপে প্রথম প্রশ্ন ছিল- গুবাক শব্দের অর্থ কী? এই প্রশ্নের উত্তর দিলাম সুপারি বা সুপারি গাছ।
এরপর প্রশ্ন আসলো ‘খ’ শব্দের অর্থ কী? আমি উত্তর দিলাম আকাশ। বিচারকমÐলীর তাৎক্ষণিক অভিব্যাক্তিতে প্রকাশ পেয়েছিল তাদের অনেকের ‘খ’ শব্দের অর্থ আকাশ এই উত্তরটা জানা ছিল না। এই ব্যাপারে পুরো অডিটোরিয়াম জুড়ে বেশ সমর্থন ও হাততালি পেয়েছিলাম। এরপর এক এক করে ধাপ পার হতে হতে মহোৎসবের প্রায় শেষে পৌঁছে গেলাম।
ফলাফল ঘোষণার আগ মুহূর্তে বিচারকদের মধ্যে শাইখ সিরাজ বললেন, এ পর্যন্ত আমার জানামতে সবচেয়ে ভালো করেছে সিরাজুল আরিফিন। তখন ভেবেছিলাম যে, হয়তো আমিই প্রথম হতে যাচ্ছি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে লক্ষ করলাম যে, আমার চেয়ে যে প্রথম হবে তার এক নম্বর বেশি। এক নম্বরের ব্যবধানে হেরে গেছি। আমি হলাম দ্বিতীয় সেরা। যেকারণে ঐ মুহূর্তে আনন্দের চেয়ে ব্যর্থতার কথাই স্মরণে আসছিল বেশি।
তারপরও থেমে নেই আরিফিন-থেমে নেই তার বিজয় রথ।
বর্তমানে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে সে।
বাংলাবিদ হয়ে ওঠার পিছনে সাতক্ষীরাবাসীর সমর্থনের ব্যাপারে আরিফিন বলে, প্রথম বছর বাংলাবিদের বিষয়টি খুব বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায় নি। সাতক্ষীরার বলতে- আমি যখন স্কুলে গিয়েছি শিক্ষকদের সমর্থন পেয়েছি। স্কুলের ছোট ভাইদের থেকেও সমর্থন পেয়েছি। বন্ধুমহল ও তাদের বাবা-মা’র থেকে সমর্থন পেয়েছি। তাদের কাছে শুনতে শুনতে অনেকের কাছেই সমর্থন পেয়েছি। তবে যখন আমি বাংলাবিদের মহোৎসবে যাই- তার কিছুদিন আগে থেকে চ্যানেল-আইতে আমাদের ছবির বিজ্ঞাপনগুলো প্রচার হচ্ছিল। ঠিক তখনই সাতক্ষীরার বিভিন্ন অনলাইন বা প্রিন্ট মিডিয়া আমাকে নিয়ে লেখালেখি শুরু করে। আমাদের লাইভ দেখানোরও ব্যবস্থা করে। এভাবে আমি কিছু সমর্থন পেয়েছিলাম। এতে আমি অনেকটা সন্তুষ্ট। আমি নিজে অবশ্য খুব কম প্রচার করেছি। আমি বাংলাবিদে আঞ্চলিক পর্যায়ে বিজয়ী হওয়ার পরে শুধু ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। এরপরে জাতীয় পর্যায়ের মহোৎসবের আগে আমি আর কোন কিছু প্রচার করিনি। আমি নিজে থেকেই চাইনি যে আর প্রচার হোক।
প্রচারের ব্যাপারে আরিফিনের বাবা স্কুল শিক্ষক মোস্তফা খাইরুল আবরার বলেন, ও একটু প্রচার বিমুখ স্বভাবের। ওর ব্যাপারে প্রচার হোক এ বিষয়টিতে যেন তেমন আগ্রহ নেই। এমনকি ওকে নিয়ে কোথাও যদি কিছু বলি তখন ও বলে আব্বু, আমাকে নিয়ে আপনি কোথাও কিছু উপযাচক হয়ে বলবেন না। এমনটাই চায় সে।
বাংলাবিদের সবগুলো রাউন্ডের মধ্যে সবচেয়ে মজার ঘটনা বলতে ভুল করেনি সে। আরিফিন বলে, কবিতা আবৃত্তির একটি রাউন্ড ছিল। আমি আবৃত্তি করছিলাম কবি গুরুর ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। আজি এ প্রভাতে রবির কর বলতে গিয়ে ভুলবশত বললাম, আজি কে প্রভাতে রবির কর। বিচারক ওটা খেয়াল করে বললেন আবার বলো। আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে একই কথা বললাম। তখন বিচারকমÐলী বিষয়টি মার্ক করলেন। আমার নাম্বার একটু কমে আসল। দেখলাম যে, ১০ জনের মধ্যে আমার অবস্থান নয় নম্বরে। প্রথম ধাপটা গেল তখন আমি ভয় পাচ্ছি কারণ আজ এখান থেকে দুই জন বাদ পড়ে যাবে। পরে অবশ্য মনে পড়ল গতদিন চ্যানেল-আই কর্মকর্তা অপু মাহফুজ আমাদেরকে নিয়ে বসেছিলেন। তখন উনি বলেছিলেন, যখন ভুল করবে তখন একটা তুড়ি বাজিয়ে আবার খেলতে শুরু করে দেবে। দেখবে নিজের ভিতর আত্মবিশ্বাস পাচ্ছ। আমি ভাবালাম একটা পর্ব হয়ে গেছে সমস্যা কী? আমি আর তখন দেখছি না আশে পাশে কে উত্তর দিচ্ছে বা না দিচ্ছে। আমি একের পর এক প্রশ্ন আসছে আর উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। ওইদিন প্রতিযোগিতা শেষে দেখলাম যে আমার নম্বর হয়ে গেছে ৭২। আর আমার পরে যে আছে তার নম্বর ৩০। অর্থাৎ আমি ৪২ নম্বরের ব্যবধান নিয়ে ওইদিন প্রথম হয়ে গেছি।
বাজার বাজানোটা বড় রকমের একটা চ্যালেঞ্জ ছিল উল্লেখ করে আরিফিন বলে, মজার বিষয় হলো বাংলাবিদে প্রশ্নের উত্তর ঘণ্টা বাজিয়ে তারপর দিতে হয়। উত্তর দিতে গিয়ে হয়তো কেউ আমার আগে ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। তখন উত্তর দেওয়ার সুযোগ পাবে। পরে যখন স্কুলে আসতাম তখন শিক্ষকরা বলতেন এই প্রশ্নটা সহজ ছিল পারলে না কেন? তখন আমি শিক্ষকদের বোঝাতে পারতাম না যে অন্য কেউ আমার আগে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। যাইহোক ভীতি দূর করতে ফাইনাল রাউন্ডে উঠলে বাবা বাড়িতেই অনুশীলনের জন্য স্টুডিওর আদলে একটা বাজার সেট তৈরি করে দিলেন।
প্রিয় শখ সম্পর্কে জানতে চাইলে আরিফিন বলে, বই পড়তে বেশি ভাল লাগে। কম্পিউটারে প্রোগ্রামিংয়ে বেজ সমস্যা সমাধানের কাজ করতে বেশি পছন্দ করি। আর মুভি দেখতেও ভালো লাগে। অবসরে বই পড়ি, গান শুনি। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের ভক্ত আরিফিন খেতে খুব একটা ভালোবাসে না। তার পছন্দ সাদা ভাত ও কম মশলা দিয়ে রান্না মুরগির মাংস।
জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে আরিফিন বলে, আমার বাবার একজন বন্ধু আছে। পেশায় উনি একজন ডাক্তার। খুব ছোট থেকে আমি ডাক্তার আঙ্কেলের কাছে যেতাম। তো উনি আমাকে প্যাড দিতেন বা সুন্দর সুন্দর কলম দিতেন। তখন ভাবতাম বড় হয়ে ডাক্তার হবো। ডাক্তার হলে সুন্দও সুন্দর প্যাড কলম পাব। ছেলেবেলায় এ ব্যাপারে খুবই আগ্রহ ছিল। এরপরে যখন উজ্জল (আরিফিনের প্রিয় শিক্ষক উজ্জল কুমার মল্লিক) স্যারের সাথে পরিচয় হলো তখন থেকে বুয়েটে পড়ার ইচ্ছা। হাইস্কুল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে যেয়ে প্রোগ্রামিং শিখলাম। আর লক্ষ্য নির্ধারিত হলো ভবিষ্যতে প্রোগ্রামিং নিয়েই কাজ করবো। এ ব্যাপারে বাবা-মা ও ভাইয়ের সমর্থনও ছিল। আর বাংলাবিদে আসার পর থেকে এর প্রতি ভালবাসা আরও একটু বেড়ে গেল। এর সাথে দায়িত্ববোধটা বেড়ে গেল। কারণ এখন আমি চাইলেই একটা ভুল বাংলা বলতে পারছি না। আমার সামনে কোন ভুল বাংলা দেখলে সেটা ঠিক করে দিতে হচ্ছে। কারণ আমার চোখে ভুলগুলো বেশি ধরা পড়ছে। এই বংলাবিদের মাধ্যমেই আমি ১০জনের একজন হতে পেরেছি। মানুষের নজরে আসতে পেরেছি। এই জায়গা থেকে আমার মনে হয় বাংলার ভুলগুলো ঠিক করে দেওয়া উচিৎ। অন্তত বাংলার জন্য যদি কিছু করতে পারি তাহলে সেটাই হবে আমার সার্থকতা। এখন একটা ইচ্ছা আছে, সেটি হলো- আমি বাংলা নিয়ে কাজ করতে চাই। এই ইচ্ছাটা আগে কখনো ছিল না। এর পাশাাশি কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে কাজ করতে চাই।
বাংলার প্রতি দুর্বলতার কারণ জানতে চাইলে আরিফিন বলে, ভাষা প্রতিযোগে যখন যাই- তখন থেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি বাংলা বই পড়তে পছন্দ করি। শুধুমাত্র শ্রেণি কক্ষে বাংলাতে ভালো করতাম তা কিন্তু নয়। তরপরেও বাংলা পড়তে খুব বেশি ভাল লাগতো। চর্যাপদের একটু কঠিন বাংলা ও প্রাচীন মধ্যপঞ্চমীয় বাংলাগুলো আমার পড়তে কখনো খারাপ লাগেনি। আর ছোট বেলা থেকেই বই পড়ার অভ্যাসটা ছিল। বাবা-মা বই পড়ার অভ্যাসটা তৈরি করে দিয়েছিলেন। ছোট বেলা থেকে বই পড়তে পড়তে বাংলা ভাষার প্রতি আলাদা একটা ভালবাসা তৈরি হয়ে যায়। আর এই যে প্রতিযোগিতাগুলোতে যাচ্ছি বাংলা ভাষা কেন্দ্রিক- সেখানে ভাল করায় উৎসাহটা পাচ্ছি। হয়তো আমি বাংলায় ভাল করতে পারবো। এভাবেই আস্তে আস্তে বাংলা ভাষার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছি।
আরিফিনের বাবা মোস্তফা খাইরুল আবরার সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও মাতা মোছা. শামীমা খাতুন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা হিসেবে কর্মরত আছেন। আরিফিনের বড় ভাই, যিনি আরিফিনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু সিরাজূম মূনীর মোস্তফা। বর্তমানে তারা মেহেদীবাগ (রসুলপুর) টিভি সেন্টারের পশ্চিম পাশে নিজেদের বাড়িতে বসবাস করেন।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আরিফিন ২০১২ ও ২০১৩ সালে ম্যাথ অ্যলিম্পিয়াডে আঞ্চলিক পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০১৪ সালে আরিফিনের ঝুলিতে ওঠে আসে ম্যাথ অলিম্পিয়াডের সেকেন্ড রানার্সআপ মেডেল। ২০১৫ সালে প্রথম আলো ও গ্রামীণ ফোন আইজেন (ও-এবহ) প্রতিযোগিতায় স্কুল টিমের নেতৃত্ব দেয় সে। তার টিম জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন ছিল। ২০১৫ সালে বুয়েটে অনুষ্ঠিত হাইস্কুল প্রোগ্রামিং কনটেস্টে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয় আরিফিন। এখানেই থেমে থাকেনি সে।
২০১৬ সালে শিশু একাডেমি কুইজ উৎসবে আরিফিন আঞ্চলিক পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন এবং ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত ‘ভাষা প্রতিযোগে’ আঞ্চলিক পর্যায়ে সেরাদের সেরা ও জাতীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অর্জন করে সাতক্ষীরার এই কৃতি সংন্তান।
জয়ের ক্ষুধায় বিচলিত আরিফিন এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন দুইদিনের বন্ধেই সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে সাতক্ষীরা থেকে গিয়ে কার্জন হলে অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে এবং চ্যাম্পিয়ন হয়ে এক বছরের শিক্ষা বৃত্তি লাভ করে। এরপরেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শাপলা হলে আনুষ্ঠানিকভাবে আরিফিনের হাতে তুলে দেন ২০১৮ সালের সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতার বিভাগীয় পর্যায়ের গণিত ও কম্পিউটার বিষয়ের সেরা মেধাবীর পুরস্কার।
ক্ষুদে বাংলাবিদদের উদ্দেশ্যে আরিফিন বলে, প্রথমবার সাতক্ষীরা থেকে বাংলাবিদে গিয়েছে মাত্র ছয়জন। এর মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে আমি একা যেতে পেরেছিলাম। এ বছর খুলনা বিভাগের মধ্যে সাতক্ষীরা থেকে সেরা-১০ এ চারজন আছে। অর্থাৎ সারা দেশের ৮০জনের মধ্যে সেরা-১০ এ সাতক্ষীরার চারজন। এটা সাতক্ষীরাবাসীর জন্য অনেক বড় একটা অর্জন। নতুন বাংলাবিদদের উদ্দেশ্যে একটাই বলার যে সামনে যত বাধাই আসুক না কেন ভেঙে পড়া যাবে না। হতে পারে আমি এই পর্বে সবচেয়ে কম নম্বর পাচ্ছি, এর মানে এই নয় যে, আমি শেষ হয়ে গেছি। যেটুকু সামর্থ আছে সেটুকু নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আর অবশ্যই নিজেকে কখনও সেরা ভাবা যাবে না। কারণ আমি হয়তো শেষে চলে এসেছি তার মানে এই নয় যে আমিই সেরা। এখনো পিছন থেকে আমাকে কেউ অতিক্রম করতে পারে। পিছনে প্রতিযোগী আছে এটা মাথায় রেখে যদি সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় তাহলে হয়তো তাদের ভালো করা সম্ভব।
তার সাফল্য ও দৈনন্দিন জীবন নিয়ে কথা হয় আরিফিনের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথেও।
আরিফিনের বড় ভাই সিরাজূম মূনীর মোস্তফা বলেন, বাংলাবিদে যাওয়ার জন্য পড়াশোনাটা আরিফিন নিজে নিজেই করেছে। আমি হয়তো একটু বলে দিয়েছি- এখন এই বই পড়া ভালো বা এই ধরণের বইগুলো পড়। যাস্ট ট্রাকটা ধরে দিয়েছি। আর ও মুভি দেখতে পছন্দ করতো। আমিও মুভি দেখতে পছন্দ করতাম। দু’জনে একসাথে বসে মুভি দেখতাম। ও আমার খুব একজন ভালো বন্ধু- আবার একইসাথে ভাল সমালোচকও।
তিনি আরও বলেন, দেখা যাচ্ছে আমি একটা বই পড়লাম, তখন আরিফিন পটাপট বলল, না ওই বইটা ভাল না। এ বইটি ঠিক ভাল হয়নি। তুমি অন্য বই পছন্দ কর। তখন সে বইটা আমি আর পড়ি না। আমি কোন মুভি দেখার আগে তা আরিফিনকে দিয়ে দেখাই। ও দেখে যদি বলে মুভি রেটিং সাত থেকে সাড়ে সাত- তখন আমি বুঝি মুভিটা ফার্স্ট ক্লাস। তখন আমি মুভিটা দেখি। ও যখন মুভি দেখে বলে রেটিং পাঁচ তখন আমি সে মুভি দেখি না। আর যে মুভি দেখে বলে রেটিং ১০ পাবে- সে মুভি আমি কখনো ল্যাপটপ থেকে ডিলিট করি না। একসময় আরিফিন খুব একটা কবিতা পছন্দ করতো না। ও গল্প পড়তে পছন্দ করতো। যখন ওকে বললাম কবিতা মুখস্থ করতে- তখন ও কবিতা পছন্দ করা শুরু করলো।
তিনি আরও বলেন, আরিফিন ছোটবেলা থেকেই খুবই জেদী ও একরোখা। কথা শুনতে চায় না। একদিনের এক ঘটনা। বাসায় কেউ নেই। আমরা দুইভাই আছি। আব্বু আমাকে একটা শার্ট কিনে দিয়েনেছ। শার্টটি গত বছর ঈদের সময় কেনা। ফুলহাতা শার্ট। সেটা আমি আবার সবসময় পরি। আরিফিন গেম খেলতে চেয়েছে- তো আমি বললাম এখন গেম খেলা হবে না। ও বলল, তুমি যদি খেলতে না দাও তাহলে আমি তোমার শার্টের হাতা কেটে দেব। আমি ভাবছি ও ছোট মানুষ, দ্বিতীয় শেণিতে পড়ে। এই কাজ ও করবে না। আমি বলছি না গেম খেলতে দেবোই না। তখন ও আরও একবার বললো দিবা কি না? তখন আমি বললাম না দেবো না। এরপর আরিফিন সত্যি সত্যি আমার শার্টের হাতা কেটে দিল। আমি আশা করি নি যে ও আসলে শার্টের হাতা কেটে দেবে। ও যেভাবে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারবে ইনশাল্লাহ। আর ও যখন কোন কাজ করে তার আগে খুব ভাল করে চিন্তাভাবনা করে নেয়। হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নেয় না বা হুট করে কোন কাজ করে না। আমি চাই আরিফিন কম্পিউটারের একজন ভাল প্রোগ্রামার হোক। ও নিজে চায় এবং ওর স্বপ্ন বুয়েটে পড়ার। আমিও চাই সে বুয়েটে পড়–ক ও একজন ভাল কম্পিউটার প্রোগ্রামার হোক।
আরিফিনের সেরা বাংলাবিদ হওয়া নিয়ে তার মা মোছা. শামীমা খাতুন অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, সারা বাংলাদেশ থেকে ৩৫ হাজারের বেশি প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেছিল। তার ভিতর দিয়েই সেরা হয় আরিফিন- এটা তো অনেকটাই গর্বের বিষয়। ছোটবেলা থেকে ও তো টুক টুক করে বেড়ে উঠল। আমার কাছে বিষয়টা এমন যে, কুড়িয়ে পাঁচটা পাওয়ার চাইতে অর্জন করা একটা অনেক ভাল। আমি মনে করি ক্লাসে প্রথম হওয়ার থেকে জেনে বুঝে পড়লে ভাল করা সম্ভব। এছাড়া বই পড়ার কোন বিকল্প নেই। বই পড়তে হবে। বইয়ের ভিতর সবকিছু পাওয়া যাবে। বই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত বন্ধু।
বাংলাবিদ হয়ে ওঠার পিছনে বাবা-মায়ের অবদানের কথা তুলে ধরে আরিফিন বলে, বাবা-মাকে বাদ দিলে আমি ওখানে কিছুই না। বাব-মা ও ভাইকে বাদ দিলে আমি শূন্য। বাংলাবিদের পুরোটা জুড়ে রয়েছে আমার বাবা-মা ও বড় ভাই। আমি হয়তো কোন পর্বে একটু খারাপ করেছি- তখন আমার মন খারাপ লাগছে। হয়তো আমি পরের দিন বাদ পড়ে যেতে পারি। তখন হয়তো বাবা বলছেন যে, এতে ভেঙে পড়ার কিছুই নেই। আজকে পড়ো কালকে হয়তো পেরে যাবে। কিংবা মা হয়তো সাতক্ষীরাতে আছে, মাকে ফোন দিচ্ছি। তখন মা বলে একটা পর্ব খারাপ হয়েছে তো কি হয়েছে- এখনো তো অনেক পর্ব বাকি। তুমি ভাল করবে, অবশ্যই ভাল করবে। তো এটুকু কথা বলার মতো আমার পাশে বাবা-মা বা ভাই ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। এটাই আমার প্রেরণা, উৎসাহ।
আরিফিনের সাফল্য নিয়ে গর্বিত বাবা মোস্তফা খাইরুল আবরার বলেন, আরিফিনকে আমি যেভাবে দেখতে চেয়েছিলাম ও সেভাবেই গড়ে উঠছে। ওতো আমার চোখে স্বপ্নের মতো। দেশের সম্মান রক্ষার্থে বা দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে সে যেন এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে যে- তার খ্যাতি যেন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
আরিফিনের কাছে অনুভ‚তি জানতে চাইলে বাংলাবিদের অর্জনটা আমার কাছে সব থেকে আনন্দদায়ক ও বেশি সম্মানের উল্লেখ করে সে বলে, এর মাধ্যমে আমাকে দেশের মানুষ চিনেছে। ২০১৭ সালের ০৫ মে থেকে সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ পর্যন্ত বাংলাবিদের অডিশনে গিয়ে যে বিষয়গুলো শিখেছি- তা আমি আগে অন্য কোথাও শিখিনি। মন খারাপ থাকলেও- মুখে হাসি রেখে চলা বা কথা বলা যায় এটা আমি এর আগে শিখিনি। বাংলাবিদের মহোৎসবে নম্বর কম পাওয়ায় আমার মন একটু খারাপ হয়েছিল। পরদিন সকালে যখন টিভিতে আমাকে সরাসরি দেখানো হচ্ছে- তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, তোমার কেমন লাগছে? এক নম্বরের জন্য জিততে পারো নি- এ ব্যাপারে তোমার অনুভূতি কী? তখন প্রচন্ড কষ্টকে মনের কাণে চোপে রেখে হাসিমুখে বলতে হচ্ছে- না খুব খারাপ লাগেনি। আমি এতে খুশি। এটুকু বলাও শিখেছি আমি বাংলাবিদ থেকে। এজন্য বলবো বাংলাবিদ আমার জীবনে সবথেকে বড় অর্জন।