Site icon suprovatsatkhira.com

স্বাধীনতার ইতিহাসে দেবহাটার টাউন শ্রীপুরের বীরপুরুষ শাহজাহান মাস্টার

মীর খায়রুল আলম: তৎকালীন বৃটিশ শাসন আমলে সাত জমিদারের বসতি ও বাংলাদেশের প্রথম পৌরসভা টাউন শ্রীপুর। এই গ্রামে ১৯৩৭ সালের ৬ ফেব্রæয়ারী টাউন শ্রীপুরের গ্রামের বিখ্যাত মিস্ত্রি বংশের মুন্সী খিজির মিস্ত্রির ঘরে জন্মগ্রহন করেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার। তিনি বাংলাদেশর মুক্তিযুদ্ধের ৯নং সেক্টরের প্রতিষ্ঠাতা করেন তিনি।
ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার তের ভাই-বোনের মধ্যে একমাত্র তিনিই বেঁচে ছিলেন। তার পিতা অত্যান্ত সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। ধর্ম পরায়ণ ব্যক্তি হিসাবে এলাকায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। শাহজাহান মাস্টার হিন্দু জমিদার শাসিত টাউনশ্রীপুর প্রাইমারী স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। পরে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর টাউনশ্রীপুর শরৎচ্চন্দ্র হাই স্কুলে ভর্তি হন। তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় মাতৃভাষা রক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। সে সময় তিনি ভাষার প্রতি সম্মান জানিয়ে নিজ বিদ্যালয়ে ৪০ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করেন। সেখানে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেওয়ার পর তিনি সকলের নজর কাড়েন। তিনি ১৯৫৪ সালে উক্ত বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপরে শাহজাহান মাস্টার সাতক্ষীরা মহকুমা একমাত্র কলেজে আইকম ক্লাসে ভর্তি হন।

১৯৫৬ সালে তিনি আই.কম পাশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে কুষ্টিয়া ডিগ্রি কলেজ থেকে বি.কম পাশ করেন। একই বছরে সাতক্ষীরা পদ্মশাখরা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। পরে ১৯৫৯ সালে শ্যামনগর থানার ভেটখালী হাইস্কুলে একই পদে যোগদান করেন। সাথে সাথে ১৯৬২ সালে রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড পাশ করেন এবং শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেন। পরবর্তীতে টাউনশ্রীপুর ও সখিপুর হাইস্কুলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পদ্মশাখরা স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব কালীন সময়ে হাড়োদ্দাহ নিবাসী মো. আজিজুর রহমানের কন্যা রাবেয়া খাতুন কে বিবাহ করেন।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে দেশ প্রেমে উদ্ভুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানী মিলিটারি পরিচালিত মুজাহীদ বাহিনীতে যোগদান করেন তিনি। তার দক্ষতার ফলে পাকিস্তান সরকার তাকে সাতক্ষীরা মহাকুমা মুজাহীদ বাহিনীর দায়িত্ব দেন। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার তাকে ক্যাপ্টেন উপাধিতে ভূষিত করেন। এ কারনেই তিনি ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার নামে পরিচিত হন।

১৯৭১ সালে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশ রক্ষার্থে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। তিনি স্থানীয় যুবকদের নিয়ে নিজ এলাকায় মুক্তি বাহিনী গঠন করেন। দেবহাটা থানায় পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে জয় বাংলা পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দেন। বিওপির ৬ জন পাকিস্তানী ইপিআরদের বন্দী করে তাদের কাছ থেকে চায়না রাইফেল ছিনিয়ে নেন। যুদ্ধ কালীন সময়ে ৯ নম্বর সেক্টরের মুক্তি বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প টাউশ্রীপুর হাইস্কুলে স্থাপন করেন তিনি।

পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার ভরতের টাকীতে মুক্তি বাহিনীর প্রথম ক্যাম্প স্থাপন করেন। যেটি শেষ পর্যন্ত নয় নম্বর সেক্টরের মর্যাদা পায়। এ কারণে তাকে নয় নম্বর সেক্টরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় ধরে তিনি নয় নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী দীর্ঘ নয় মাসে যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলার নিজ এলাকায় ফিরে এসে পুনরায় শিক্ষকতায় যোগদান।

এছাড়া তিনি ইংরেজি ১৯৮৫ সালে তৎকালনি রাষ্ট্রপতি হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশের প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালে তিনি নিজের শরীরের মূল্যবান অংশ দুইটি চক্ষু রেজিষ্ট্রীর মাধ্যমে আই ব্যাংকে দান করেন। ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই সখিপুর হাই স্কুলে ক্লাস নেওয়ার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সাথে সাথে তাকে সখিপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে দুপুর ১২.৩০ মিনিটে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। পর দিন ২৪ জুলাই টাউনশ্রীপুর হাইস্কুল প্রাঙ্গণে বিকাল ৫টায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। এই মহান ব্যক্তির স্মরণে প্রতিবছর স্মরণ সভা, দোয়া অনুষ্ঠান সহ বিভিন্ন আয়োজন করা হয়। এবছর আগামী মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারের স্মরণে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার স্মৃতি সংসদ।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version