Site icon suprovatsatkhira.com

কাঁকড়া সাব সেক্টরের টেকসইত্ব ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কাঁকড়া হ্যাচারির প্রয়োজনীয়তা

মোস্তফা কামাল : সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহের একটি অন্যতম প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়েছে কাঁকড়া চাষ। এই অঞ্চলের মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন, আমিষের চাহিদা পুরণ, কর্মসংস্থান তৈরি এবং বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনে আত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে কাঁকড়া সাব-সেক্টর। আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যপক চাহিদা ও বাজারমূল্য থাকায় সুন্দরবন অঞ্চলের মোহনা, নদী এবং খাল থেকে সারা বছর জুড়ে ব্যাপক হারে কাঁকড়া আহরিত হয়। এ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে যে সকল চাষী কাঁকড়া চাষ করে তারাও প্রকৃতি থেকে আহরিত কাঁকড়া চাষ করে।

উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় ২০১৩ সাল থেকে কাঁকড়া চাষে নতুন মাত্রা যোগ হয় সফট শেল কাঁকড়া চাষের মাধ্যমে যার বিস্তৃতি বর্তমানে ব্যাপকতা লাভ করেছে। বর্তমানে শ্যামনগর উপজেলার ৩৮০-৪০০ টি সফট শেল কাঁকড়ার ফার্মসহ অসংখ্য হার্ড শেল কাঁকড়ার ফার্ম বিদ্যমান যেখানে প্রতি মাসে প্রায় ৬ লক্ষ থেকে ৭ লক্ষ কিশোর কাঁকড়ার প্রয়োজন হয়। যা প্রাকৃতিক উৎস হতে আহরিত হচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক উৎসে কাঁকড়ার প্রাচুর্য কমে যাচ্ছে এবং সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্য এবং স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে কাঁকড়া হ্যাচারির বানিজ্যিক সফলতার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ এবং সেগুলো মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এর ফিশারিজ এ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেশানালজি ডিসিপ্লিন (এফএমআরটি) এবং সাতক্ষীরার নওয়াবেঁকী গণমুখী ফাউন্ডেশন (এনজিএফ) এর যৌথ উদ্যোগে ৩১ মে ২০২৩ ‘চ্যালেঞ্জস্ এ্যান্ড অপুরচুইটস্ ফর সাসটেইনেবল কমার্শিয়াল মুড ক্রাব হ্যাচারী অপেরশনস্ ইন বাংলাদেশ’- শীর্ষক একটি কর্মশালার আয়োজন তার গুরুত্ব প্রকাশ পায়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় অডিটরিয়ামে এফএমআরটি ডিসিপ্লিনের জেষ্ঠ্য অধ্যাপক ড. মোঃ নাজমুল আহসান এর সঞ্চালনায় পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের মৎস্য এবং বন কর্মকর্তা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকগ্রæপ, কাঁকড়া শিল্পের সাথে জড়িত বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারগণ উপস্থিত থেকে বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশে কাঁকড়া শিল্পের উন্নয়নে হ্যাচারি প্রযুক্তির বিদ্যমান সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে হ্যাচারি পরিচালনার ধারাবাহিকতা এবং বানিজ্যিক প্রসার নিশ্চিতকরণে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারগণের অভিজ্ঞতা, সর্বোত্তম অনুশীলন এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে পারস্পারিক মতবিনিময়ের মাধ্যমে উপযুক্ত সুপারিশমালা প্রনয়ণ করেন। যা বাংলাদেশে কাঁকড়া শিল্পের টেকসই উন্নয়নের পাশাপাশি সুন্দরবনের জীববৈচিত্র রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়। কর্মশালায় এফ এমআরটি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. মোঃ সারোয়ার, ড. মুহাম্মদ, আব্দুর রউফ এবং ড. মোঃ হাসানুজ্জামান কাঁকড়া হ্যাচারি ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দিক যেমন ব্রুডস্টক নির্বাচন, পরিবহন, লার্ভা পালন, পুষ্টি, রোগ প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয়ে তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল উপস্থাপন করেন। কর্মশালায় আলোচকবৃন্দ কাঁকড়া হ্যাচারি শিল্পের বানিজ্যিক প্রসারের জন্য অধিকতর গবেষণার উপর গুরুত্ব আরোপ করে এতদবিষয়ে পিকেএসএফ-কে মৎস্য এবং বন বিভাগের সাথে গবেষকবৃন্দের সমন্বয়ের উপর দৃষ্টি আকর্ষন করা হয়। নওয়াবেঁকী গণমুখী ফাউন্ডেশন (এনজিএফ) ২০১৬ সালে ইফাদ ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)-এর প্রোমোটিং এগ্রিকালচারাল কমার্শিয়ালাইজেশন এ্যান্ড এন্টারপ্রাইসেস( পিএসিই) প্রকল্পের অর্থায়নে এবং ভিয়েতনামের সিইসিডি সংস্থার কারিগরি সহযোগিতায় শ্যামনগর উপজেলার কলবাড়ি নামক স্থানে কাঁকড়ার হ্যাচারি স্থাপন করে। সেখানেই ২৬শে আগষ্ট ২০১৬ সালে বাংলাদেশে প্রথম সফলভাবে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন করে। এনজিএফ কাঁকড়া হ্যাচারি ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি বছর কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন করছে। ২০১৬ সালে ভিয়েতনামি টেকনিশিয়ানদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সর্বপ্রথম ৫ হাজার পোনা উৎপাদিত হয়। এরপর থেকে এনজিএফ কাঁকড়া হ্যাচারির টেশনিশিয়ানদের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ২০১৭ সালে ১লক্ষ ৮২ হাজার ২৫০ টি কাঁকড়ার পোনা উৎপাদিত হয় এবং ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত ৪২ হাজার ২৫০ টি কাঁকড়ার পোনা উপাদিত হয়। ২০১৯ সালে ৩ লক্ষ ৪৭ হাজার ০৩৯ টি পোনা উৎপাদিত হয়, ২০২০ সালে ৩৪ হাজার ৫৮৫ টি এবং ২০২১ সালে ২ লক্ষ ৪২ হাজার ৪২৬ টি পোনা উৎপন্ন হয়।

করোনা মহামারির কারনে ২০২০ এবং ২০২১ সালে এনজিএফ কাঁকড়া হ্যাচারি মাত্র ১টি সাইকেল উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করে। ফলে উৎপাদিত কাঁকড়ার সংখ্যাও কম হয়। ২০২২ সালে কাঁকড়া হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বিদেশী খাদ্য, মেডিসিন, এনজাইম ও অন্যান্য রি-এজেন্ট আমদানি করা সম্ভব না হওয়ার কারনে উৎপাদন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়। তথাপি হ্যাচারির টেকনিশিয়ানরা দেশীয় বিকল্প বিভিন্ন খাদ্য ও রি-এজেন্টের মাধ্যমে উৎপাদনের চেষ্টা করেন এবং ৬৫ হাজার ৮৬৯ টি কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন করে। বর্তমানে ২০২৩ সালে কাঁকড়া হ্যাচারিতে প্রথম উৎপাদন সাইকেলে ১লক্ষ ৬৩ হাজার ক্রারলেট উৎপাদন হয় এবং চলতি বছরে এনজিএফ কাঁকড়া হ্যাচারিতে ১ লক্ষ কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে হ্যাচারি ম্যানেজার মোঃ মাসুদুল হক প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। নওয়াবেঁকী গণমূখী ফাউন্ডেশন (এনজিএফ) কাঁকড়ার পোনা নার্সিং-এর ক্ষেত্রেও কাজ করছে। এ পর্যন্ত তারা ৩ শত জন কাঁকড়া চাষীকে কাঁকড়ার পোনা সরবরাহ, প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করেছে।

ফলে তাদের অনেকেই কাঁকড়ার পোনা নার্সিং এর মাধ্যমে যথেষ্ট লাভবান হয়েছে। এছাড়া এনজিএফ কাঁকড়া হ্যাচারি থেকে ইতিমধ্যে খ্রিষ্টান এইড-এর ইএমএসসিএস প্রকল্প, কেয়ার বাংলাদেশ-এর এসডিসি সমষ্টি প্রকল্প, ইউএনডিপি’র জিসিএ এবং ওয়ার্ল্ডফিস বাংলাদেশ এর ফিড দ্যা ফিউচার বাংলাদেশ এ্যান্ড নিউরেশন এ্যাকটিভিটি প্রকল্পে কাঁকড়ার পোনা সরবরাহ করা হয়েছে। বাংলাদেশে কাঁকড়া হ্যাচারিতে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনের ক্ষেত্রে কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। কিন্তু এ সকল বাঁধার মধ্যেও এনজিএফ কাঁকড়ার হ্যাচারি কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন কার্যক্রম অব্যহত রেখেছে এবং কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরে তারা সময়ের সাথে সাথে দক্ষতা অর্জন করেছে। এনজিএফ কাঁকড়া হ্যাচারি এ পর্যন্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ১২ জন দক্ষ জনবল তৈরী করেছে। তারা এখন অন্যান্য কাঁকড়ার হ্যাচারিতে কাজ করছেন। এনজিএফ কাঁকড়া হ্যাচারি এ পর্যন্ত যতটুকু সফলতা অর্জন করেছে তা ইতেমধ্যে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তা পর্যায়ে উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। শ্যামনগর উপজেলার কলবাড়িতে একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান কাঁকড়ার হ্যাচারিতে কর্মরত দুইজন টেকনিশিয়ানই এনজিএফ কাঁকড়া হ্যাচারিতে কাজ করে দক্ষতা অর্জন করেছেন। যেটি এনজিএফ কাঁকড়া হ্যাচারির আরও একটি সফলতা। এনজিএফ কাঁকড়া হ্যাচারি প্রযুক্তি স্থানান্তরের ক্ষেত্রেও কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে তারা কক্সবাজারে উদ্যোক্তা পর্যায়ের ২ টি কাঁকড়া হ্যাচারিতে প্রযুক্তি স্থানান্তর করেছে এবং সেখানে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন হচ্ছে। সর্বোপরি, কাঁকড়া সাব সেক্টরের সম্প্রসারণের মাধ্যমে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ ও সাব সেক্টরের টেকসইতের কাঁকড়া হ্যাচারি স্থাপনে সরকারী, বেসরকারী সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসা এখন সময়ের দাবী।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version