Site icon suprovatsatkhira.com

সাতক্ষীরার সাংবাদিক আনিসুর রহিম আর নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক: সাতক্ষীরার সাংবাদিকতার আকাশ থেকে খসে গেল আরও একটি তারকা। সাংবাদিকতার প্রতিক পুরুষ, জেলা নাগরিক কমিটির আহŸায়ক, অধুনালুপ্ত দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্রের সম্পাদক, সাতক্ষীরা প্রি-ক্যাডেট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, সুলতানপুর আজাদী সংঘ ক্লাবের সদস্য, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, দৈনিক পত্রদূতের সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা (সার্টিফিকেটগ্রহণকারী নন) অধ্যাপক মো: আনিসুর রহিম আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি আজ মঙ্গলবার (৩ জানুয়ারি ২০২৩) দুপুর ১টার দিকে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। বুধবার সকাল ১১টায় তার জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হবে।

তিনি সপরিবারে সুন্দরবন ভ্রমনে যেয়ে অসুস্থ হন এবং বনের মধ্যেই ট্রলারে বেলা ১টার সময় মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়েন। তাঁর বুকে পেসমেকার বসানো ছিল। আগামী ৭ তারিখে পেসমেকারটি চেঞ্জ করার জন্য ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল। আপোষহীন সাহসী সাংবাদিকতা করার কারণে অসংখ্যবার তিনি হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে তিনি অন্যায় অসত্যের কাছে মাথানত করেননি। দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার রহস্য সর্বপ্রথম তিনি দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্র পত্রিকায় সাহসীকতার সাথে প্রকাশ করেন। সেই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সারাদেশে একে একে ধরা পড়ে জঙ্গিরা।

অধ্যাপক আনিসুর রহিম ১৯৫৫ সালের ৭ মার্চ নড়াইল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আরিফুর রহিম সেসময় নড়াইল সিও রেভিনিউ বিভাগে ম্যানেজার পদে চাকরি করতেন। নড়াইল থেকে তার পিতা বদলি হয়ে আসেন সাতক্ষীরায়। অধ্যাপক আনিসুর রহিম সাতক্ষীরা সিলভার জুবলি প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা থেকে বদলি হয়ে বরগুনায় যার আরিফুর রহিম। ১৯৭১ সালে বরগুনা থেকে মেট্রিক পাশ করেন। মেট্রিকুলেশন পাশ করে যশোর এমএম কলেজে ভর্তি হন। যশোর এমএম কলেজ থেকে ১৯৭৩ সালে এইচএসসি পাশ করেন। অধ্যয়নকালীন তিনি যুক্ত হন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে। সেসময় যশোরে তাঁর নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়ন শক্তিশালী সংগঠনে রূপ নেয়। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স পাশ করে সহপাঠী দিলারা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

অধ্যাপক আনিসুর রহিমরা ৬ ভাই ও ৩ বোন। তাঁর দুই ছেলে এবং এক স্ত্রী। পারিবারিকভাবে ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান সবাই সুপ্রতিষ্ঠিত। ইতোমধ্যে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহŸানে সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বরগুনায় থাকার সময় অধ্যাপক আনিসুর রহিম যোগদেন মুক্তিযুদ্ধে। সরাসরি যুদ্ধ করেন। সহযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তোলে শক্তিশালী ব্রিগেড। তবে মুক্তিযুদ্ধের সনদের জন্য তিনি কখনো চেষ্টা করেননি। ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। ‘সাপ্তাহিক একতা’ পত্রিকায় তাঁর হাতেখড়ি। এরপর কলম ধরেছেন একাধিক পত্রিকায়, লিখেছেন অনর্গল। দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর অসংখ্য লেখা প্রকাশ হয়েছে। প্রত্যেকটি লেখায় তিনি অধিকার ও ন্যায়ের কথা বলেছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি সস্ত্রীক শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন সাতক্ষীরা মহিলা কলেজে। সাতক্ষীরা মহিলা কলেজ জাতীয়করণ হলে তিনি চাকরি ছাড়েন। এরপর তিনি দেবহাটার খান বাহাদুর আহসানউল্লা কলেজে প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে ফিরে আসেন সাতক্ষীরা ডে-নাইট কলেজে। এ কলেজে তিনি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে সুনামের সাথে চাকরি জীবন সম্পন্ন করেন। এদিকে কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি শিশু শিক্ষা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। গড়ে তোলেন আসমানী শিশূ নিকেতন ও পরে সাতক্ষীরা প্রি-ক্যাডেট স্কুল। তার হাত ধরেই জেলায় কিন্ডার গার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রথম সূচনা করে। এরপর জেলাজুড়ে কিন্ডার গার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থায় যে বিপ্লব দেখা যায়, তা অধ্যাপক আানিসুর রহিমের চিন্তার ফসল।

১৯৯৬ সালে তিনি সাতক্ষীরার গণমানুষের কণ্ঠস্বরকে একসূত্রে গেঁথে প্রকাশ করেন দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্র পত্রিকা। দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্র প্রকাশ হলে জেলায় সাংবাদিকতায় আসে নতুন গতি। আসে এ পেশার প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস। আনিসুর রহিমের সম্পাদনায় দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্র পত্রিকায় সাহসী সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে এক ধরণের সামাজিক আন্দোলন। সমাজের সব ধরণের মানুষ এ পত্রিকার প্রতি অবিচল আস্থা রেখে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতেন। প্রশাসনেও ছিল এ পত্রিকার প্রতি অন্যরকম গ্রহণযোগ্যতা। পত্রিকাটির ‘খাস খবর’ নিজেই লিখতেন আনিসুর রহিম। দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্রে সাহসী প্রতিবেদন ছাপার কারণে কয়েকবার হামলার শিকার হন আনিসুর রহিম। দুর্বৃত্তরা তাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করেছে। হুমকি দিয়েছে। কিন্তু হামলা ও হুমকি তাকে সত্যের কক্ষপথ থেকে এক বিন্দু সরাতে পারেনি। দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্র বন্ধ হয়ে গেলে তিনি বীরমুক্তিযোদ্ধা স. ম আলাউদ্দীন প্রতিষ্ঠিত দৈনিক পত্রদূতের সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি হিসেবে সুনাম ও সাহসীকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

আশির দশকের শুরুতে অধ্যাপক আনিসুর রহিম বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাতক্ষীরা জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। বিভিন্ন ন্যায়ভিত্তিক আন্দোলনে তিনি জনগণকে সম্পৃক্ত করেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি সাতক্ষীরায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৮ সালে ভূমিহীন আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বাঁকাল ইসলামপুরে ভূমিহীনদের উচ্ছেদ ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে যে আন্দোলন শুরু হয় সেই আন্দোলনে তার সাহসী ভূমিকা আজও অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা যোগায়। ১৯৮৮ সালের ৪ অক্টোবর এই ভূমিহীন আন্দোলনের কারণেই তিনি গ্রেপ্তার হন। তাকে সাতক্ষীরা থেকে যশোর কারাগারে রাখা হয়। ৬ মাসের অধিক সময় তিনি কারাগারে ছিলেন।

১৯৯৬ সালের ১৯ জুন দৈনিক পত্রদূতের প্রতিষ্ঠাতা বীরমুক্তিযোদ্ধা স. ম আলাউদ্দীন ঘাতকের গুলিতে শহিদ হন। স. ম আলাউদ্দীন হত্যার প্রতিবাদে জেলাজুড়ে ব্যাপক আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু হয়। অধ্যাপক আনিসুর রহিম ছিলেন সেই আন্দোলনের প্রথম সারিতে। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্র পত্রিকা এসময় সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। ১৯৯৮ সালের ভূমিহীন আন্দোলনেও মো: আনিসুর রহিম ছিলেন প্রথম সারির একজন। তিনি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বারবার কলম ধরেছেন।

তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ও বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
এদিকে অধ্যাপক আনিসুর রহিমের মরদেহ  বুধবার (০৪ ডিসেম্বর) সকাল ৯টায় সাতক্ষীরা দিবা-নৈশ কলেজ ক্যাম্পাসে নিয়ে আসা হবে। সকাল শিক্ষক এবং কর্মচারীদেরকে যথাসময়ে কলেজে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হয়েছে। এরপর মো: আনিসুর রহিমের মরদেহ নেওয়া হবে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সাতক্ষীরা প্রি-ক্যাডেট স্কুলে। সেখান থেকে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শহিদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে সকাল ১১টায় মো: আনিসুর রহিমের জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হবে।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version