Site icon suprovatsatkhira.com

দুই বার বাঘের সাথে যুদ্ধ করে ফিরে আসা শহিদুলকে সুন্দরবনে যেতে হয় জীবিকার তাগিদে।

জি এম মাছুম বিল্লাহ, সুন্দরবনাঞ্চল প্রতিনিধি : সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের মৌখালী গ্রামের মৃত মন্তেজ গাজীর ছেলে শহিদুল (৪০)। সুন্দরবন উপকূলে জন্মগ্রহণ করা শহিদুল ইসলাম জীবিকার তাগিদে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। গরিব ঘরে জন্ম হওয়ায় শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি। বলতে গেলে শৈশবকাল থেকে বাবা সাথে সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন। দীর্ঘদিন সুন্দরবন যাওয়া আসায় বাঘের সাথে দেখা হয়েছে অনেক বার। ১৯৮৫ সালের অক্টোবর মাসে প্রথম বাঘের সাথে মুখোমুখি দেখা শহিদুল ইসলামের সাথে। সুন্দরবনের প্রথম বাঘের সাথে মুখোমুখি দেখা হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে শহিদুল ইসলাম বলেন, পশ্চিম সুন্দরবনের বাদুড়ঝুলি এলাকার জুরিগানি নাকি ট্যাকে জাল টানা অবস্থায় পিছন দিকে শব্দ শুনতে পাই। পিছনে তাকাতেই দেখি বাঘ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার দিকে লাফিয়ে পড়লো। বাঘ লাফ দিতেই আমি বাঘের মুখে বাম হাত ঢুকিয়ে দেই, আর ডান হাত দিয়ে মুখ ও চোখ খামচে ধরি। এভাবে প্রায় দুই/তিন মিনিট আপ্রান প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই।

পরবর্তীতে আমার সাথে থাকা আব্দুর রহিম নৌকা থেকে বৈঠা নিয়ে আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে। রহিমের হাতে থাকা বৈঠা দিয়ে প্রায় দশ মিনিট বাঘকে পিটাতে থাকে। একটা সময় বাঘটি আমাকে ফেলে লাফ দিয়ে পালিয়ে যায়। তাৎক্ষণিক আমার ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে রহিমের কাঁধে ভর করে পাশে থাকা নৌকা যোগে প্রায় দুই ঘণ্টা পর বাড়িতে পৌঁছাই। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা আমাকে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। উপজেলা কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত ডাক্তার বলেন, বাঘের মুখের ভিতরে হাত থাকায় ছয়টি শিরা কামড়ে ছিড়ে ফেলেছে। শিরা গুলো স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে বড় ধরনের অপারেশন করতে হবে। অর্থ সংকটে অপারেশন করতে সক্ষম হয়নি। দীর্ঘদিন চিকিৎসার নেওয়ার পরও ক্ষতস্থান গুলোর পরিবর্তন না হওয়ায় স্থানীয় কবিরাজের সুনীলের দারস্ত হই। একমাস তার বাড়িতে থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করি ও আস্তে আস্তে শরীরের সুস্থতা ফিরে আসে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসলেও বাম হাতে ঠিকমতো শক্তি পাইনা।

পুরোপুরি সুস্থ হতে প্রায় দেড় বছর সময় লেগে যায়। তারপর আবার চলতে থাকে সুন্দরবনের মাস কাঁকড়া ধরা। বেশ ভালোই চলছিল, সেখান থেকে প্রায় দশ বছর পরে আবারো একই ঘটনা ঘটল আমার সাথে। সেই লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে শহিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনে রান্নার জন্য জ্বালানি কাটতে উঠেছিলাম সুন্দরবনের ভিতরে। যথারীতি কাঠ নিয়ে ফিরে আসছিলাম নৌকায় হঠাৎ ২৫/৩০ দূরে দেখি বাঘ এদিকে আসছে। সাহস করে দাঁড়িয়ে গেলাম বাঘটিকে মোকাবেলা করতে হবে না হলে মরতে হবে। বাঘ বলে চিৎকার করে উঠতেই আমার সাথে থাকা নুর ইসলাম ও আজিবর ছুটে আসে। আমি কাঁধ থেকে কাঠ নামিয়ে হাতে কুড়াল নিয়ে বাঘের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকলাম দীর্ঘক্ষন আমার সহযোগী দুজনও আমার পাশে দাঁড়ালো। সামনাসামনি বাঘ মানুষকে আক্রমণে ভয় পায়। বাঘটি আমাকে ধরতে বারবার ঝুঁকতে থাকে। বাঘের যে বিভৎস্য চেহারা সেদিন দেখেছিলাম স্বচক্ষে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না যে একটা প্রাণীর চেহারা এত ভয়ানক হতে পারে। মুখ দিয়ে অঝোরে লালা ঝরছিল আর বিকট শব্দে মনে হচ্ছিল আমার জীবনের আজই শেষ পরিণতি তবে আমি সাহস হারায়নি। একটা সময় দৌড়ে এসে আমাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। আমিও তার গতিবিধি লক্ষ করে একটু বামদিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু ঠিকঠাক মত যেতে পারিনি কারণ হলো বাঘ খুব জোরে দৌড়াতে পারে। বাঘ তার বাম হাত দিয়ে আমার মাথা ধরার চেষ্টা করে।

ঠিকঠাক নাগালে না পাওয়ায় ধরতে পারিনি। যখন বাঘটি তার হাত দিয়ে আমার মাথার কিছুটা ধরেছে তখন আমার হাতে থাকা কুড়াল দিয়ে বাঘের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কোপ দিতে থাকি। একই সাথে আমার সাথে থাকা দুইজন তাদের হাতে থাকা লাঠি দিয়ে বাঘকে পিটাতে থাকে এভাবে চলতে থাকে প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট। অবশেষে এক লাফ আমাদের থেকে বেশ কিছু দূরে চলে যায় এবং সেখান থেকে আমাদের উপর পুনরায় আক্রমণের চেষ্টা চালায়। আমরা তিনজন তার হাত থেকে বাঁচার জন্য হাতে থাকা লাঠি দিয়ে বিভিন্ন গাছের গায়ে শব্দ করতে থাকি। বেশ কিছুক্ষণ পরে বাঘটি সেখান থেকে চলে যায়। তারপর সহযোগীদের সহযোগিতায় কোমরে থাকা গামছা দিয়ে মাথার ক্ষতস্থান বেঁধে ফেলি। তার সাথে থাকা নুর ইসলাম বলেন, বাঘটি যেভাবে আমাদেরকে সামনে থেকে আক্রমণ করেছিল জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম তবে আল্লাহর ইচ্ছায় শেষ পর্যন্ত তিনজন প্রাণে বেঁচে বাড়িতে ফিরি। অপর সহযোগী আজিয়ার বলেন, বাঘটি শহিদুলের মাথা ধরার চেষ্টা করছে। ঠিকমতো ধরতে না পারলেও যেমন জমিতে ট্রাক্টর চাষ করে ঠিক তেমনি মাথার থেকে চুল মাংস সহ আঁচড়ে নিয়ে চলে যায়। সেই সময়ও শহিদুল কে দেখে মনে হচ্ছিল তার কিছুই হয় নি।

আমি খুব বেশি দিন সুন্দরবনে যাইনি তবে শহিদুল কে বাঘে আক্রমণ করার পরও তার যে ভূমিকা ছিল সেটা দেখেই আমার সাহস বেড়ে গিয়েছিল। আমি তখন লাঠি দিয়ে বাঘটিকে আরো বেশি পিটাতে থাকি। এক পর্যায়ে আমাদের আক্রমণে বাঘটি লাফিয়ে চলে যায়।

প্রথম দুইবার বাঘের সাথে সরাসরি মোকাবেলা হলেও তৃতীয়বার কৌশলে পালিয়ে আসেন শহিদুল ইসলাম। তৃতীয়বারের ঘটনার বর্ণনায় শহিদুল ইসলাম জানান, ছোট খালে মাছ ধরছিলাম আমি ও এক সহযোগী। মাছ ধরতে ধরতে খালের আগায় চলে যাই এমন সময় হঠাৎ দেখতে পেলাম দূরে একটি বাঘ এদিকে দিকে তাকিয়ে আছে। তৎক্ষণাৎ গহীন জঙ্গলের দিকে ছুটে পালানোর চেষ্টা করি। তার ভাষ্যমতে তিনি একটি খালপার হয়ে গাছের আগায় প্রায় দুই ঘন্টা বসে থাকেন। তারপর সময় বুঝে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে প্রায় পাঁচ ঘন্টা পায়ে হেঁটে ও নদী সাঁতরে বাড়ি চলে আসেন। অপরদিকে তার সহযোগী কোনোকিছু বুঝতে না পেয়ে বাড়ি চলে আসেন। শহিদুল বাড়িতে আসলে তার মুখে ঘটনা শুনে তিনি অবাক হয়ে যান। সুন্দরবন উপকূলে বাঘে মানুষের যুদ্ধ প্রায় শোনা যায় তবে শহিদুল ব্যতিক্রম একজন ব্যক্তি যাকে দুইবার সরাসরি বাঘের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়েছে।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version