নিজস্ব প্রতিবেদক: “কে যাও ভাটির দেশে নাইয়া রে ভাই, কালি গান গাইয়া”। মঙ্গলবার সকালে সাতক্ষীরা সদরের ভবানীপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে বসে ভাটিয়ালি গানটি গাইছিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি নজরুল(৪৩)। রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দরাজ কণ্ঠে গানটি শুনে থেমে গেলাম। বাড়ির ভিতরে ঢুকে অনুরোধ করতেই করতাল বাজিয়ে মাইক্রোফোনে একে একে ভাটিয়ালি গান “দুয়ারে আইসাছে পাল্কি, ঢেউ উঠে সাগরে রে, ছায়াছবির গান বন্ধু তোর বারেক নিয়ে আমি যাব” গান শোনালেন নজরুল।
মঙ্গলবার সকালে কথা বলার একপর্যায়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নজরুল বলেন, সৃষ্টিকর্তা জন্ম থেকে আমার দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিলেও গলায় যে সুরটুকু দিয়েছেন তা দিয়েই খালি গলায় হাটে বাজারে গান শুনিয়ে মানুষের কাছ থেকে পাওয়া টাকা নিয়ে সংসার যাত্রা নির্বাহ করি। এভাবে পরিশ্রম করে অর্জিত পয়সা দিয়ে যমজ মেয়ে মুক্তমনি ও হীরামনিকে গত বছর এসএসসি পাস করিয়েছেন। ছোট ছেলে আরাফাতকে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াচ্ছেন। হীরামনি এপ্লাস ও মুক্তামনি এ পেয়ে বর্তমানে বাণিজ্য বিভাগে শহীদ স্মৃতি কলেজে পড়াশুনা করছে। স্ত্রী শরিফা খাতুন সংসারের হাল ধরে তার মত একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর জীবনকে ধন্য করেছে।
নজরুল জানান, অন্ধ হলেও দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠে তার আর পড়া হয়নি। বাবার জন্মভিটা হলো সদর উপজেলার ঘোনা গ্রামে। বিয়ের পর স্বপরিবারে নানার বাড়িতে থাকতেন বাবা বাকের আলী সরদার। নানা মারা যাওয়ার পর মা তিন শতক জমি পাওয়ায় তাতেই তারা চার ভাই ও এক বোন বসবাস করেন। এক বোন জমি নেয়নি। সকল ভাই বোনের দিন আনা দিন খাওয়া। মা থাকেন ছোট ভাই আল আমিনের কাছে।
নজরুল ইসলাম তার জীবনের স্মৃতিচারণা করতে যেয়ে বলেন, পেট চালাতে এক সময় পাড়ায় পাড়ায় সাহায্য চেয়ে চলতো তার। হীরামনি ও মুক্তমণি বিদ্যালয়ে যত উঁচু ক্লাসে উঠতে থাকে তখন থেকে সন্তানদের আত্মসম্মানের বিষয়টি নিয়ে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। ছেড়ে দেন ভিক্ষাবৃত্তি। শুরু করেন বাড়ি থেকে নিকটবর্তী সাতক্ষীরা, খুলনা ও যশোরের হাটে বাজারে গান শুনিয়ে মানুষকে মুগ্ধ করে পয়সা উপার্জন। এ জন্য তিনি একটি সাউÐ বক্স, একটি মাইক্রোফোন ,একজোড়া করতাল কিনেছেন। তাকে বহনকারি ইজিবাইক বা ব্যাটারি চালিত ভানের ভাড়া বাদ দিয়ে প্রতিদিন তিনি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করেন। প্রতি তিন মাস পরপর প্রতিবন্ধি ভাতা পান দুই হাজার ২৫০ টাকা। এ দিয়েই তার চলে সংসার। বহন করা হয় ছেলে ও মেয়েদের পড়াশুনার খরচ। তবে শতকষ্টের মধ্য দিয়ে গতবার তার দু’ মেয়ে হীরামনি ও মুক্তমনি এসএসসিতে আশানুরুপ ফল করায় তিনি উজ্জ্বীবিত। মেয়েদের আরো বেশি পড়াশুনা করিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার প্রত্যয় নিয়ে যারা মেয়েদের এখনই বিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তাদেরকে সমুচিত জবাব দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, নিজে কারো কাছে গানের তালিম নেননি। হারমনিয়ামের রিডে হাত দেননি। এরপর ও খালিগলায় বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই মানুষকে আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করেন। ২০ সাল আগে আগরদাড়িতে আসা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ডান চোখ অপারশেন করিয়েছিলেন। চোখে সামান্য জ্যোতি এলেও তা ছিল ক্ষণস্থায়ী।
শরিফা খাতুন জানান, বাপের জন্মভিটা ছিল খুলনার কয়রা উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। ছোট বেলায় বাবা চলে আসেন কুশখালিতে। সেখানে সরকারি খাস জমিতে খুপড়ি ঘর বেঁধে বসবাস শুরু করেন। বাবার এত অভাব ছিল যে তাকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধি নজরুলের সাথে বিয়ে দিতে চাইলে তিনি আপত্তি করেননি। স্বামীর আয়ের সংসার চালানো কঠিন ভেবেই পালন করছেন কয়েকটি ছাগল। সংসার ও সন্তানদের পড়াশুনার খরচ চালিয়ে স্বল্প সঞ্চয় করে ব্রাক থেকে ২০১৮ সালে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কোন রকমে ইটের ঘর বানিয়েছেন। তবে টাকার সঙ্কুলন না হওয়ায় দরজা ও জানালা লাগানো হয়নি। প্রতি মাসে ব্রাকের চার হাজার ১০০ টাকা কিস্তী টানতে যেয়েই তাকে হিমশিম খেতে হয়। মেয়েদের এসএসসি ফলাফলে খুশী কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে শরিফা জানান, সকলের আর্শিবাদ ও সহযোগিতা পেলে মেয়েরাই এ সংসারকে সফলতার দুয়ারে পৌঁছে দেবে।
গতবারে এসএসসিতে এ প্লাস পাওয়া হীরামনি এবং এ পাওয়া মুক্তামনি জানান, পড়াশুনার সুবিধার্থে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপবৃত্তি পেতে তাদের যমজ দু’ বোনকে দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। ইংরেজিতে তারা বরাবই দুর্বল ছিলেন। বাবুলিয়া জয়মণি – শ্রীনাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করাকালে টাকার অভাবে শুধুমাত্র জাহাঙ্গীর আলম ভুট্টো স্যারের কাছে দুই বোন মাসিক ৪০০ টাকায় পড়াশুনা করতেন। ইংরেজিতে একজন শিক্ষকের কাছে পড়তে পারলে তারা আরো ভাল ফল করতে পারতেন এসএসসিতে। বর্তমানে তারা শহীদ স্মৃতি কলেজে পড়াশুনা করেন উল্লেখ করে বলেন, প্রতিদিন বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার পায়ে হেঁটে বাবলুয়িা বাজার যেতে হয়। সেখান থেকে ইজিবাইকে কলেজে যেতে আসতে তাদের দু’বোনের ৬০ টাকা লাগে। টিফিন তো দূরের কথা পথ খরচ যেদিন থাকে না সেদিন কলেজে যাওয়া হয় না। বই কেনার খরচ কমাতে দুই বোনই বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। নিজেদের পড়ার খরচ নিজেরাই যোগাড় করার চেষ্টা করেও লাভ হয়নি উল্লেখ করে মুক্তামণি ও হীরামণি বলেন, একএকজন ছাত্রকে প্রাইভেট পড়াতে হলে মাসে এক থেকে দেড়’শ টাকার বেশি মেলে না। আবার অনেকে অভিজ্ঞ স্কুল শিক্ষকের বাইরে পড়াতে চাননা। ফলে তাদের ইচ্ছা আর পূরণ হয় না। এরপরও অনেকে তাদের পড়াশুনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে বাবা ও মাকে দ্রæত বিয়ে দিতে বলেন। দৃষ্টি প্রতিবন্ধি বাবা ও মাকে সহায়তা করতে তারা আরো বেশিদূর পড়াশুনা করে সরকারি চাকুরি পেতে চান। এজন্য তারা সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা কামনা করেন।
প্রতিবেশি সবুরা খাতুন বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি নজরুলের ও তার দুই যমজ মেয়ের প্রবল ইচ্ছাশক্তি তাদের সাফল্যের দোর গোড়ায় পৌঁছে দেবে। তারা এ গ্রামকে নতুন করে দেশের মানুষের কাছে পরিচিতি এনে দেবে।
বিশিষ্ঠ সমাজ সেবক কাওছার আলী বলেন, প্রতিবন্ধি হওয়াটা যে কোন অভিশাপ নয় তা নিজের কর্মকাÐ দিয়ে প্রমাণ করে চলেছে নজরুল। আর বাবা মায়ের ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য হীরামণি ও মুক্তামণি কখনো খেয়ে আবার কখনো না খেয়ে যেভাবে পড়াশুনা করে যাচ্ছে তাতে আগামিতে সফল হবেই।
বাবুলিয়া জয়মনি- শ্রীনাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রসাদ কুমার বিশ্বাস বলেন, হীরামণি ও মুক্তামণি খুভ ভাল স্বভাবের মেয়ে। তারা পড়াশুনায় যথেষ্ট ভালো। তাদের বাবা দৃষ্টি প্রতিবন্ধি জেনে সেশান চার্জ, পূণঃভর্তি ফি ও পরীক্ষার ফি যথাসম্ভব কম নিয়ে তাদেরকে পড়াশুনা করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে যে কলেজে তারা ভর্তি হয়েছে সেখান থেকেও তারা একই ধরণের সুবিধা পাবে বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস।