Site icon suprovatsatkhira.com

একটি অঘোষিত মুক্তিযোদ্ধার গল্প

মীর খায়রুল আলম : ১৯৭১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কয়েকজন খানসেনা হরিনগর স্কুলে যায়। খবর পেয়ে এলাকার একজন শিকারি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নবাব্দি ফকির তার দলবল নিয়ে পাক গানবোটের ওপর আক্রমণ করেন। তাতে গানবোটের কিছুটা ক্ষতি হয় এবং পাকসেনারা পালাতে বাধ্য হয়। পরে ৯ সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী ও রাজাকাররা প্রতিশোধ নিতে হরিনগর বাজার ঘেরাও করে ২৮জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে এবং বাজারে অগ্নিসংযোগ করে। আবুল কাশেমের মানচিত্র ও পরিকল্পনার উপর কর্নেল বেগ ভেটখালী থেকে তাদের উপর বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়।

১২ অক্টোবর আবুল কাশেমের মানচিত্র ও পরিকল্পনার উপর কর্নেল বেগের নির্দেশে ভেটখালী রাজাকার ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করলে কিছুক্ষণ গুলি বিনিময়ের পর রাজাকাররা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ফোরক দিয়ে ক্যাম্পটি ধ্বংস করে দেয়। এছাড়াও রাজাকার ও খানসেনাদের উপর আক্রমণে আব্দুল কাশেমের মানচিত্র ও পরিকল্পনা ছিলো। এভাবে খন্ড খন্ড করে সশস্ত্র যুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধে ৫ ডিসেম্বর শ্যামনগর এবং ৭ ডিসেম্বর পাকসেনারা সাতক্ষীরা ছেড়ে চলে যায়। মুক্ত হয় সাতক্ষীরা। দীর্ঘ নয় মাস ধরে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এদেশের স্বাধীনতা।যুদ্ধ শেষে আবুল কাশেম ৬ নং রমজাননগর ইউনিয়নের রিলিফ চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকারের সময় মুক্তিযুদ্ধাদের তালিকার প্রস্তুত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এ পর্যন্ত মোট ছয়বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা হলেও তালিকা থেকে ছিটকে পড়েন আবুল কাশেম। যদিও তার সুপারিশে ২জন মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল কিন্তু তিনি নিজের নাম লেখাননি। প্রায় সময় বলতেন, দেশের জন্য যুদ্ধ কিছু করে নিজের স্বার্থ দেখতে নেই। এরপর বি-ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সাতক্ষীরা হাসাপাতালে ভর্তি হলে ৫ নভেম্বর ২০১২ তারিখে কমান্ডার দেবীরঞ্জন মন্ডল হাসপাতালের কেবিনের জন্য প্রত্যায়ন দেন। আবুল কাশেম ওই বছর ১৯ নভেম্বর মারা যান। তার মৃত্যুতে ২০ নভেম্বর ২০১২ তারিখে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় “প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম আর নেই” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ১৪ ডিসেম্বর ১৯২৭ সালে শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের ভেটখালী গ্রামের কেরামত গাজীর ছেলে জিএম আবুল কাশেম জন্মগ্রহণ করেন।

সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে ১৯৫২ সালে এসএসসি পরিক্ষা পাশ করেন। এর পরপর পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন। ১৯৬৯ সালে কালীগঞ্জ প্রেসক্লাব মাঠ প্রাঙ্গনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধুকে দেখতে এবং তার ভাষণ শুনতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অগণিত মানুষ আসেন। বঙ্গবন্ধুর আহŸানে শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের ভেটখালী গ্রামের আবুল কাশেম পায়ে হেঁটে তার সাথে দেখা করেন। ১৯৭০ নির্বাচনের পর অচলাবস্থার প্রেক্ষিতে গণবিদ্রোহ দমনে পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী শহর ও গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক সামরিক অভিযান ও বিমানযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এরপর যুদ্ধ ঘোষণায় ১১টি সেক্টরের মধ্যে ৯নং সেক্টরের অধীনে উপজেলার নৈকাটি ও পরে কৈখালীতে সাব সেক্টর এ অফিসের দায়িত্বে ছিলেন, ক্যাপ্টেন এম এন হুদা, লেঃ মাহফুজ আলম বেগ ওরফে কর্নেল বেগ ও সুবেদার বাসার এবং কমান্ডার এমএ জলিল ছিলেন।

যার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন, এ কে ফজলুল হক (তৎকালীন এমপিএ)। কর্নেল বেগের গোয়েন্দা ও পরিকল্পনাকারী এবং মানচিত্র করতেন আবুল কাশেম। আবুল কাশেম ভারতের ধলচিতা ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নেন। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণে তার দুইছেলের মধ্যে বড় ছেলের ছেলেরা স্বাবলম্বী হলেও দারুণ মানবেতর জীবন যাপন করছে ছোট ছেলের ছেলেরা। গত ১৫ জুন ২০১৪ সালে ছোট ছেলে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)য় অনলাইনে আবেদন করেন, যার ডি.জি.নং উএও১৯৩৮৪। এবং ২০২১ সালে ২৫ জানুয়ারি যাচাই-বাছাইয়ের লক্ষ্যে ৭ ফেব্রæয়ারি ২০২১ তারিখে শ্যামনগর উপজেলা পরিষদের নতুন ভবনে যাচাই বাছাই কমিটির সামনে হাজির হন। কমিটরি সদস্য ছিলেন, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার দেবীরঞ্জন, ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি কমান্ডার গাজী আবুল হোসেন, এমপি’র প্রতিনিধি মুজিব বাহিনীর সদস্য মুজিবর রহমান, শ্যামনগর ইউএনও আ,ন,ম আবুজার গিফারী ও সমাজ সেবা কর্মকর্তা সহিদুর রহমানের উপস্থিতিতে শ্যামনগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধার সংগঠক এ,কে ফজলুল হক এবং ওয়াজেদ আলী গেজেট নং-১৯১১, আবুবকর সিদ্দিক গেজেট নং-১৫০২, পরিমল গায়েন গেজেট নং-১৯১৪, আরশাদ আলী গেজেট নং-১৫০৬ প্রত্যায়নসহ সকল কাগজপত্রাদী জমা দেওয়া হয়। কিন্তু ছিটকে পড়েন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version