Site icon suprovatsatkhira.com

যেভাবে শিশুকে সাবলীল পাঠক হিসেবে গড়ে তোলা যায়

প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে বুনিয়াদী শিক্ষা। প্রাথমিক স্তরে যদি কোনো শিশুর ভিত্তিকে মজবুত করা না যায় তাহলে ঐ শিশুকে মানবসম্পদে রুপান্তর করা দূরুহ ব্যাপার। একটু খেয়াল করলে দেখা যায় প্রতিবছর অসংখ্য শিশু বাংলা পড়তে না শিখেই পরবর্তী শ্রেণিতে উর্ত্তীণ হচ্ছে। এভাবে একসময় প্রাথমিক স্তরের সর্বোচ্চ ৫ম শ্রেণি পেরিয়ে গেলেও সাবলীলভাবে বাংলা পড়তে পারছে না। এর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে, প্রতিটি ক্লাসেই (শিখন-শেখানো কার্যাবলীতে) সকল শিশুর পাঠের জন্য নির্ধারিত শিখনফল অর্জন করানো সম্ভব হচ্ছে না।

উদাহরণস্বরুপ: ১ম শ্রেণির বাংলা বইয়ের ১ম পাঠটি হলো আমার পরিচয়। এখানে ছবি দেখে শিশুরা ছবি (নিজের) সম্পর্কে বলবে। এই ছবিটি শিশুর চিরচেনা জীবন ঘনিষ্ঠ ছবি। ছবি দেখেই সে আনন্দ পাবে। অনেকে মনে করেন এই পাঠে শিশুর শেখার কী আছে? এ পাঠ না নিয়ে পাঠ-৪ দিয়ে শুরু করি। কারণ পাঠ-৪ হলো শিশুর পছন্দের একটি ছড়া যা সে মা-বাবা, ভাই-বোন বা নিকট আতœীয়দের মুখ থেকে শুনে মুখস্থ করে ফেলেছে।

অনেকে ভাবেন যেহেতু এটা শিশুর মুখস্থ আছে তাহলে তারা এখন এটা খাতায় লিখুক। ব্যস, পাঠ- ৪ এর নির্দেশনা আতা গাছে তোতা পাখি ছড়াটি খাতায় লিখ। পাঠ-১ থেকেই শিশুর মেধা তথা বিকাশের প্রতি শুরু হলো প্রতিকুল পরিবেশের অবতারণা। যা শিশুর সাবলীল পাঠক হয়ে উঠার পথে প্রধান অন্তরায়।

কারিকুলাম বলছে- পাঠ-১ এ- ১। পরিচয়মূলক কথোপকথন শুনে বুঝতে পারবে ২। পরিচিত ব্যক্তির নাম শুনে মনে রাখতে পারবে। পরিচয়মূলক কথোপকথনে অংশগ্রহণ করতে পারবে। এর মাধ্যমে শিশুর যে যোগ্যতা নিশ্চিত হবে তাহলো- ১। পরিচয়মূলক কথোপকথন ও বর্ণনা শুনে বুঝতে পারবে। ২। সহপাঠী ও পরিচিত ব্যক্তির নাম শুনে মনে রাখতে পারবে। পরিচয়মূলক কথোপকথনে অংশগ্রহণ করতে ও বর্ণনা করতে পারবে।

এই যোগ্যতা নিশ্চিত হলে শিশুরা অন্যের সাথে নিজের পরিচয় আদান-প্রদান করতে পারবে। সামাজিকীকরণের শুরু এখান থেকেই। সমাজে অন্যের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রাথমিক ধাপ হলো অন্যের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করা। কেউ যখন কোন ইন্টারভিউ বোর্ডে নিজেকে হাজির করেন তখন সাধারণত যে প্রশ্নটি করা হয় তাহলো নিজের সম্পর্কে বল (Introduce yourself)। স্কুল জীবনের প্রথম ক্লাসের ঘাটতি তখন অনুভূত হয়।

এভাবে প্রতি পাঠের শিখনফল নিশ্চিত না করিয়ে পরবর্তী পাঠে প্রবেশ শিশুকে অনেক যোগ্যতা থেকে ছিটকে দেয়, যার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো- সাবলীলভাবে পড়তে না পারা। সাবলীলভাবে পড়তে না পারলে ঐ শিশুকে দিয়ে অন্যান্য বিষয়ের শিখনফল অর্জন করানো কতটুকু সম্ভব তা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং শিশুর প্রথম পাঠ থেকে প্রতিটি পাঠের শিখনফল অর্জনের জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষকগণকে সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকতে হবে।

শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা শিক্ষকদের ক্লাসরুমের বাইরেও অনুকরণ করে থাকে। শিশুদের নিয়মিত পাঠক্রমের বাইরেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরে শুদ্ধ বাংলা ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব তাদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। বিদ্যালয়ে সপ্তাহে একদিন সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শিশুদের কবিতা আবৃত্তি, গল্প পড়া ও বলা, গান ইত্যাদি অনুশীলন করাতে হবে।

প্রতিদিন বাংলা বই থেকে হাতের লেখা লিখতে দিতে হবে এবং বাংলা পঠনের ওপর জোর দিতে হবে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে একদিন অন্তত উপস্থিত বক্তৃতা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। শিশুরা যতক্ষণ বিদ্যালয়ে অবস্থান করবে, ততক্ষণ তাদের একে অন্যের সাথে শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলার চর্চা করাতে হবে।

জাতীয় বিশেষ দিবস উদযাপন উপলক্ষে বিদ্যালয়গুলো নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এসব অনুষ্ঠানে শিশুদের বাংলা বানান, রচনা, কবিতা লেখা, গল্প বলা প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। বিষয়ভিত্তিক দেয়ালিকা প্রকাশের জন্য উৎসাহিত করতে হবে। সাবলীলভাবে পঠনের যোগ্যতা বাড়াতে নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিদিনের সংবাদপত্র সংগ্রহ করতে হবে তা নয়। পুরাতন সংবাদপত্র সংগ্রহ করে পড়ানো যেতে পারে। প্রতিটি বিদ্যালয়েই রয়েছে বুক কর্নার। এই কর্ণারে শিশুদের উপযোগী অনেক বই রয়েছে। পাঠ্য বইয়ের বাহিরে বিভিন্ন গল্পের বই শিশুদেরকে পড়তে উৎসাহিত করতে হবে। প্রয়োজনে বই পড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে।

তবে এ বিষয়ে শিক্ষকদের থাকতে হবে ইতিবাচক মনমানসিকতা ও আন্তরিকতা। তার সঙ্গে একটু জায়গা থাকা দরকার, যেখানে আনন্দের আলো প্রবেশ করতে পারে। আর এই আনন্দের সাথে শিখেই শিশুরা রচনা করবে ভবিষ্যতের ভিত্তি। আমরা এগিয়ে যাবো ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ একটি স্বপ্নের বাংলাদেশের দিকে।

সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার, খুলনা সদর, খুলনা।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version