Site icon suprovatsatkhira.com

প্রশিক্ষিত যুব, উন্নত দেশ – বঙ্গবন্ধু’র বাংলাদেশ

সুজলা সুফলা শস্য শ্যমলা আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যামে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আমরা অর্জন করি আমাদের বহুল প্রত্যাশিত স্বাধীনাতা। অগ্নিঝরা মার্চ এর সেই দিনগুলি প্রতিটি বাঙ্গালীকে অনুপ্রানিত করে নতুন করে শপথ নিয়ে দেশকে গড়ার, দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির অগ্রযাত্রায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার। আজ সময় এসেছে লক্ষ শহীদের রক্ত দিয়ে অর্জিত স্বাধীনাতকে অর্থবহ রুপ দেওয়ার। সময় এসেছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সেনারবাংলা গড়ার। সেই সেনারবাংলা গড়ার জন্য প্রস্তুত আজকের যুব সমাজ। সম্প্রতি আইএলও প্রকাশিত ‘ট্যাকলিং দ্য কোভিড-১৯ ইয়ুথ এমপ্লয়মেন্ট ক্রাইসিস ইন এশিয়া এন্ড দ্য প্যাসিফিক’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- করোনারনে ‘লকডাউন প্রজন্ম’ তৈরি হয়েছে; যার প্রভাব দীর্ঘদিন থাকবে। করোনার তাৎক্ষণিক প্রভাবে লকডাউন এবং সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কাজ হারিয়েছে বহু যুবক। সমাজে এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে থাকবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। আইএলওর আশঙ্কা, করোনার প্রভাবে বাংলাদেশে যুব বেকারত্বের হার বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হতে পারে। এ অবস্থায় সংস্থাটি এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে যুব বেকারত্ব সংকট নিরসনে এ অঞ্চলের সরকারগুলোর প্রতি জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরিতে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে।

দেশের বেকার সমস্যা নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারও উদ্বিগ্ন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বেকার সমস্যা রাতারাতি দূর করা সম্ভব নয়; তবে সরকার ইতোমধ্যে যুব বেকারত্ব নিরসনে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলেছে, কভিডের অভিঘাতে বাংলাদেশে কত মানুষের আয় কমেছে বা কত মানুষ কাজ হারিয়েছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সরকার এ নিয়ে বিশেষ জরিপ করেনি। আবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব জরিপ করেছে, তার ফলাফল সরকার মেনে নেয়নি।

যুব বেকারত্বের বর্তমান অবস্থা:
দেশে ৪৭ শতাংশ শিক্ষিত ব্যক্তি বেকারত্বে ভুগছে। এর বড় কারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে অর্জিত জ্ঞান দিয়ে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করা যাচ্ছে না। গত দেড় বছরে কোভিডের অভিঘাতে তছনছ হয়ে গেছে বিশ্ব অর্থনীতি। অনেক মানুষের কাজ গেছে। অনেক মানুষের আয় কমেছে। তবে সবচেয়ে বেশি কাজ গেছে তরুন ও নারীদের। বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি ২৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে সারা বিশ্বে তরুনদের বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে ২৫-এর বেশি বয়সী মানুষের বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
কাজ হারানোর পাশাপাশি অনেক মানুষ নিষ্কিয় বসে আছেন। সে জন্য অর্থনীতিবিদেরা এ নিষ্কিয় ও বেকার মানুষের মধ্যে পার্থক্য করে থাকেন। যাঁরা এখন কাজে নেই, তবে কাজের খোঁজ করছেন, তাঁরা বেকার। অন্যদিকে যাঁরা সক্রিয়ভাবে কাজ খুঁজছেন না বা নিজের ব্যবসা চালু করার অপেক্ষায় আছেন, তাঁরা অর্থনৈতিকভাবে নিষ্কিয় হিসেবে বিবেচিত হন।
চাকরির বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতার জন্যই মূলত বেকারত্বের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২২ লাখ তরুন চাকরির বাজারে প্রবেশ করে, যাদের সিংহভাগই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ বেকারত্বের শিকার। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের হারও নেহাত কম নয়।আরেক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে স্নাতক বেকারের সংখ্যা প্রায় ৪৬ শতাংশ। এভাবেই বেড়ে চলেছে দেশের বেকারত্ব, বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারের হার।

চাকুরী পাওয়া নিয়ে বর্তমান যুবদের ভাবনা:
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে চাকরির বাজারে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জিত হচ্ছে না, এমনটিই মনে করছেন দেশের তরুনরা। এর ফল হিসেবে ৭৮ শতাংশ শিক্ষিত তরুনই চাকরি না পাওয়ার শঙ্কায় ভুগছেন। তবে এসব তরুনদের মধ্যে যারা ধনী পরিবারের, তাদের মধ্যে এই আশঙ্কা অনেক কম। গত ২৭ জুলাই/২২ রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে এক অনুষ্ঠানে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ‘যুব জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক ঝুঁকির উন্নয়ন নীতি এবং বরাদ্দ পরিকল্পনা’ শীর্ষক গবেষণাটি চালিয়েছে অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সানেম’ ও উন্নয়ন সংস্থা ‘অ্যাকশন এইড, বাংলাদেশ’। অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক শাকিল আহমেদ। গবেষণার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশে তরুনদের মধ্যে শিক্ষাসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। বৈষম্য রয়েছে কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, ডিজিটাল সেবা ও সামাজিক মূল্যবোধের মতো বিষয়গুলোতেও। বিশেষ করে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময়ে এই বৈষম্য প্রকট হয়েছে।গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বেকার ৭৮ শতাংশ শিক্ষিত তরুন মনে করেন, তারা চাকরি পাবেন না। তবে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষিত তরুনদের মধ্যে এই হার ৮৯ শতাংশ। ধনী পরিবারের শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে অবশ্য মাত্র ১৯ শতাংশ এমন আশঙ্কায় ভুগছেন। এমন আশঙ্কার পেছনে দক্ষতার ঘাটতির বিষয়টি উঠে এসেছে গবেষণায়। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যেসব দক্ষতা তরুনরা অর্জন করেন, তা চাকরির বাজারে প্রয়োজনীয় দক্ষতার সঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে শিক্ষিত তরুন যারা আছেন, তাদের মধ্যে দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে।

দেশে সরকারী চাকুরীর সুযোগ কতটুকু:
বর্তমান সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরের আওতাধীন ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬৮টি পদ থাকলেও এখন পর্যন্ত ৩ লাখ ৮০ হাজার ৯৫৫টি পদ শূন্য রয়েছে। শূন্য পদের বেশির ভাগেই মাঠপর্যায়ের বলে জানা গেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংস্কার ও গবেষণা অনুবিভাগের পরিসংখ্যান ও গবেষণা কোষ ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস-২০২০’ বই থেকে এ তথ্য জানা গেছে।এ শ্রেণির এক লাখ ৯৫ হাজার ৯০২টি পদ শূন্য রয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শূন্যপদ রয়েছে তৃতীয় শ্রেণির পদে। এ শ্রেণিতে ৯৯ হাজার ৪২২টি পদ শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া ৪৬ হাজার ৬০৩টি প্রথম শ্রেণির এবং ৩৯ হাজার ২৮টি দ্বিতীয় শ্রেণির পদ শূন্য রয়েছে বলে ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস-২০২০’ বই বিশ্লেষণ করে জানা গেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, বর্তমানে প্রথম শ্রেণির পদে পুরুষ এক লাখ ৪৬ হাজার ৯৫০ জন এবং নারীর সংখ্যা ৩৭ হাজার ২৭৯। দ্বিতীয় শ্রেণির পদে পুরুষ এক লাখ ২২ হাজার ২৩০ এবং নারী ৪৮ হাজার ৫৩৬ জন। তৃতীয় শ্রেণির পদে পুরুষ ছয় লাখ ১২ হাজার ১৮৪ এবং নারী দুই লাখ ৮৩ হাজার ১৩৩ জন। চতুর্থ শ্রেণির পদে নারী ৪৫ হাজার ৪৬৪ এবং পুরুষ দুই লাখ ৯ হাজার ১৩৭ জন কর্মরত রয়েছেন।
মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পর্যায়ে ১৭ হাজার ৭৩৯টি পদের মধ্যে শূন্য পাঁচ হাজার ৬৮টি, সংস্থা ও অধিদপ্তর পর্যায়ে ১৪ লাখ ৯ হাজার ৬২৬টি পদের মধ্যে শূন্য দুই লাখ ৩৩ হাজার ৩৩৬টি। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারি কমিশনারের (ভূমি) অফিসে ১৪ হাজার ৮৫১টি পদ খালি রয়েছে, এখানে মোট পদের সংখ্যা ৪৭ হাজার ৩৩টি। বর্তমানে সরকারী চাকুরীতে কর্মরত সকল জনবল একযোগে চাকুরী ছেড়ে বাড়ী চলে যায় তবুও প্রতিবছর শ্রমবাজারে যে ২২ লক্ষ নতুন কর্সংস্থান প্রত্যাশীর চাকুরী দেয়া সম্ভব নহে ।

দক্ষ শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদা:
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ হওয়ার কারণে পর্যাপ্ত শ্রমশক্তি থাকলেও দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে। দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ করতে হয়। যার ফলে বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক খাতগুলোর ব্যয়কৃত অর্থ সেসব শ্রমিকের অর্জন হিসেবে চলে যায় দেশের বাইরে। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) তথ্যমতে, দেশের ২৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে ৮২ শতাংশ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত, তবে এর মধ্যে ৬ দশমিক ৩ শতাংশের কোনো বিশেষ বিষয়ে দক্ষতা রয়েছে। আর ৫৩ শতাংশ মোটামুটি দক্ষ এবং ৪০ দশমিক ৭ শতাংশ একেবারেই অদক্ষ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের (বিআইডিএস) এক সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে বিভিন্ন খাতে মোট ৮ কোটি ৮৭ লাখ শ্রমিকের দরকার হবে। এই সময় পর্যন্ত দেশের ৯টি শিল্প খাতে নিয়োগ দিতে হবে আরও ১ কোটি ৬৬ লাখ ৮৪ হাজার নতুন শ্রমিক। এর মধ্যে দক্ষ শ্রমিক লাগবে ৮০ লাখ, আধা দক্ষ ৫৬ লাখ ও অদক্ষ শ্রমিক লাগবে ৩১ লাখ। অন্য এক পরিসংখ্যানমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১১ মাসে এর আগের অর্থবছরের তুলনায় মোট রপ্তানি ১৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া পুঁজিস্বল্পতা ও বাজার সংকোচনের কারণে রপ্তানিমুখী শিল্প, এসএমই খাত এবং ইনফরমাল খাতে ব্যাপক বেকারত্বের সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে দেশের মোট কর্মসংস্থানের ২০ শতাংশ শিল্প খাতকে ঘিরে, তবে পর্যাপ্ত শ্রমশক্তি থাকা সত্তে¡ও এখানে দক্ষ শ্রমিকের যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশের প্রধান শিল্প খাতগুলোয় দক্ষ জনবলের সংকট তীব্র হচ্ছে। বর্তমানে ২০ শতাংশ দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি নিয়েই চলছে দেশের রপ্তানি আয়ের তৈরি পোশাক খাত।

যুব বেকারত্ব নিরসনে করনীয়:
দেশের জনসংখ্যার এক -তৃতীয়াং যুব। সম্ভাবনা থাকলেও বিপুলসংখ্যক যুবক বেকারত্বের সমস্যায় ভুগছে। দেশের অগ্রযাত্রায় সম্ভাবনাময় -যুবকদের কাজে লাগাতে প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা।তাদের দক্ষতা বাড়ানো। তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। সম্প্রতি প্রকাশিত জনশুমারি বিবেচনায় নিলে, তরুন-যুব জনগোষ্ঠীর হাত ধরে দারুণ এক জনমিতিক সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। যদিও সেই সম্ভাবনার পুরোটাই নির্ভর করছে এই বিপুল তারুণ্যকে কতটা কার্যকরভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে ও তাদের কাজের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া যাচ্ছে তার ওপর।

১. কর্মমুখী শিক্ষার উপর গুরত্ব আরোপ:
কর্মমুখী শিক্ষা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। কর্মমুখী শিক্ষাকে যত বেশি কার্যকর করা যায় তত বেশি দেশের উন্নয়নকে গতিশীল করা যাবে। আমরা শুধু হাজার হাজার ডিগ্রি দিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু আমরা কতটুকু কাজের সুযোগ করে দিতে পারি, সেই ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায়। সবাইকে কিন্তু কর্মক্ষেত্র দিতে পারি না। আমাদের দেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। সেখানে বিদেশি শ্রমিক কাজ করেন প্রায় পাঁচ লাখ। যারা বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৬০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স বাবদ নিয়ে যাচ্ছেন, যা আমাদের জন্য খুবই নেতিবাচক। এসব কর্মী ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে এসে বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় কাজ করেন। এটা হয়ে থাকে, কারণ আমাদের দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোকের অভাব রয়েছে।আজ যদি শিক্ষিত বেকারকে কারিগরি বা প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ বা দক্ষ করে তুলতে পারতাম, তাহলে আমাদের মেগা প্রকল্পে বিদেশি শ্রমিক দিয়ে কাজ করানোর প্রয়োজন হতো না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে হবে এবং কর্মমুখী শিক্ষাকে বেশি আকর্ষণীয় করতে হবে। এর মাধ্যমে শুধু শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কমানো হবে তা নয়। বরং কর্মমুখী শিক্ষায় দক্ষ শ্রমিক বা শিক্ষার্থীকে বিদেশে পাঠিয়ে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দারিদ্র্যবিমোচনে কর্মমুখী শিক্ষা ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে।

২. শিল্পখাতের উন্নয়নে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহন:
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক ছাড়া অন্যান্য শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। সে প্রসঙ্গে ওষুধ, জাহাজনির্মাণ শিল্প ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এ শিল্পগুলো শিল্প খাতের সার্বিক আয়তনের তুলনায় এখনও অনেক ছোট রয়ে গেছে। তাছাড়া তাদের কোনোটিই শ্রমঘন নয়। এ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে সরকারকে গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে হবে ।কর্মে ইচ্ছুক থাকলেও কর্ম পাচ্ছে না- এমন জনগোষ্ঠীর জন্য বেকার ভাতা চালুর প্রস্তাব রেখে ‘কর্মসংস্থান নীতি-২০২২’ শিরোনামের খসড়া চূড়ান্ত করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
অনেকেই মনে করেন, সরকারি বিনিয়োগ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে খুব একটা অবদান রাখতে পারে না। তাই কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সবার আগে প্রয়োজন ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ। আমাদের নীতিপ্রণেতা কিংবা রাজনীতিবিদদের প্রায় সবাই স্বীকার করেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে কাঙ্খিত মাত্রায় দারিদ্র্য বিমোচন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবে শুধু ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমেই যে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়, তা সবসময় সঠিক নাও হতে পারে। অন্য নানা উপায়েও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। তবে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যত সহজ, অন্য কোনো উপায়ে তা সম্ভব হয় না।কৃষি খাতের উপর বিনিযোগে অনিশ্চয়তা এবং ঝুকি সবসময় বেশী যার কারনে শিল্পের উপর সব সময় জোর দিতে হবে ।

৩. অনগ্রসর এলাকার যুবদের জন্য বিশেষ প্রকল্প গ্রহন:
দেশের অনগ্রসর এলাকা বিশেষ করে দ্বীপ ,হাওর ও মঙ্গাপীড়িত এলাকার যুবদের নিয়ে বিশেষ প্রকল্প যেমন উপকরন সহয়যতা প্রদান কর যেতে পারে । সর্ংশ্লিষ্ট এলাকার যুবদের প্রশিক্ষন প্রদান করার পর তাকে প্রকল্প গ্রহনের জন্য উপকরন প্রদান করা । যদি কেউ গবাদি পশু মোটা তাজা করতে চায় তাকে খামার তৈরী সহ যাবতীয় উপকরন সরবরাহ করা যেতে পারে । কেউ যদি পোশাক তৈরী করতে চায় তাকে মেশিনসহ যাবতীয় উপকরন সরবরাহ করতে হবে । প্রকল্প থেকে যে মুনাফা লাভ করবে, প্রতি মাসে তার মাত্র ২%-৩% অর্থ ৫ বছর যাবৎ সরকারী কোষাগারে জমা দিবে। তারপর বাকী সম্পদ এর মালিকানা তার নিজের হবে।

৪. তরুণ উদ্যোক্তাদের বিশেষ সুযোগ দান:
তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিকল্প পেশার (আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিং) জন্য কর্মহীন তরুণ বা নতুন গ্র্যাজুয়েটদের প্রস্তুত করার উদ্যোগ নিতে হবে। আরেক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে স্নাতক বেকারের সংখ্যা প্রায় ৪৬ শতাংশ। এভাবেই বেড়ে চলেছে দেশের বেকারত্ব, বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারের হার। এই ভয়াবহ বেকারত্ব সমস্যা কিছুটা হলেও কমাতে পারে ফ্রিল্যান্সিং বা মুক্ত পেশা। এর ফলে স্বাবলম্বী হতে পারবে একজন বেকার তরুণ ও তার পরিবার।
ফ্রিল্যান্সিং হলো মুক্ত পেশা। ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের কাজ করে অর্থোপার্জন করাই মূলত ফ্রিল্যান্সিং। স্বাধীনভাবে কাজ করা যায় বলে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাড়ছে এই পেশা। ফাইবার, ফ্রিলান্সিং ডটকম, আপওয়ার্ক ইত্যাদি হচ্ছে ফ্রিলান্সিংয়ের জন্য জনপ্রিয় ওয়েবসাইট। এ ওয়েবসাইট গুলোতে মানুষ বিভিন্ন ধরনের কাজ করে অর্থোপার্জন করছে, যার মধ্যে রয়েছে ডাটা এন্ট্রি, কনটেন্ট রাইটিং, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, এফিলিয়েট মার্কেটিং, এসইও, ওয়েব ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন ইত্যাদি।
ফ্রিল্যান্সিং করে এক দিকে যেমন একজন শিক্ষার্থী পড়াশোনার পাশাপাশি আর্থিক সচ্ছলতা পায় অন্য দিকে পড়াশোনার পরবর্তী সময়ে আর বেকারত্বের তকমা থাকে না। বাংলাদেশে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই পড়াশোনার শেষ করে চাকরির বাজারে প্রবেশ করে; কিন্তু চাকরি সবার ভাগ্যে থাকে না। যার ফলে তার মধ্যে হতাশা কাজ করে এবং বেকারত্ব সমস্যায় পডছে। এই গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে একজন শিক্ষার্থী যদি নিজেকে তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলে এবং ফ্রিল্যান্সিং শুরু করে দেয়, বছর পার হতেই সে আর বেকার থাকবে না।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু-বিভাগীয় গবেষণা ও শিক্ষাদান বিভাগ অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইন্সটিটিউট (ওআইআই)-এর এক গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে যে, অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংয়ে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫ লক্ষ ফ্রিল্যান্সার নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ বার্ষিক ১০ কোটি ডলার আয় করছে। এই অপার সম্ভাবনাময় খাতকে সফল করতে সরকার ইতিমধ্যে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

৫. পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা:
আর্থিকভাবে অসচ্ছল ও নারী শিক্ষার্থীদের বিশেষ প্রণোদনার মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবন্ধী, আদিবাসী ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। জাতিসংঘের সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে তরুনদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।

৬. চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভবনা কে কাজে লাগাতে হবে:
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে। এ সময় দক্ষ নেতৃত্ব ও গুণগত শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে।,এজন্য ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো জরুরি। শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের। শিক্ষার বহুমাত্রিকতা আগামীর নেতৃত্ব গঠনে ভূমিকা রাখবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের বানানো স্যাটেলাইট “ব্র্যাক অন্বেষা” এখন মহাকাশে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আমাদের শিক্ষার্থীরা টেক্কা দিচ্ছে নামীদামি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।’ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গবেষণা, সরকার ও শিল্প খাতের মধ্যে সমন্বয় থাকাটা জরুরি । আমাদের যে করেই হোক গবেষণায় আরও অর্থ বাড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ‘আমাদের তরুনদের চিন্তা করার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পড়াশোনায় বৈচিত্র বাড়ানো দরকার। আমাদের যেমন গণিত নিয়ে পড়তে হবে, তেমনি পড়তে হবে শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে। প্রোগ্রামিংসহ বিভিন্ন প্রাথমিক দক্ষতা সবার মধ্যে থাকা এখন ভীষণ জরুরি।ইন্টারনেট অব থিংস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, বিগ ডেটাসহ চতুর্থ শিল্পবিপ্লব- সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়কে কেবল ভবিষ্যতের জন্য তুলে না রেখে বর্তমানের সমস্যা সমাধানেও তার ব্যবহারে জোর দিতে হবে।
আমরা যদি প্রতিটি বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারি তবে অচিরেই বাংলাদেশ মালেশিয়া বা সিংগাপুরের কাতারে সামিল হবে। তবেই না বাস্তবায়ন হবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন।

লেখক: মো: আব্দুল কাদের, উপ-পরিচালক, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বরিশাল।

তথ্যসূত্র: সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার-২০১৮, বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের ওয়েবসাইট, জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশনা সমূহ।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version