সুপ্রভাত ডেস্ক: মাসুরার পিতা মো: রজব আলী বলেন, “এখন বাইরে গেলে সবাই বলছে তোমার মেয়ে তো জিতে গেছে। তখন খুব ভালো লাগছে। এখন মনে হচ্ছে আমার মেয়েকে বল (ফুটবল) খেলতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। আয় রোজগার খুব খারাপ ছিল। শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে থাকতাম। ১১ মাস আগে সরকারের দেওয়া আট শতক জমিতে ছোট একটা ঘর করে সেখানে টিনের ছাউনি উঠেছি। যদি আমার একটা ঘর করে দিতো সরকার তবে মেয়েদের নিয়ে চিন্তামুক্ত হতাম।”
মসুরার পিতা এখন গর্বিত, ডিফেন্ডার মাসুরা বাড়ি এসে এবার তাকে মোটরভ্যান কিনে দেবেন।
“প্রথমে আমার খারাপ লাগতো মেয়ে ফুট বল খেলবে এটা কেমন দেখায়। তবে মাসুরার তীব্র ইচ্ছায় খেলাধুলা শুরু করে সে। প্রথমে আমি অতটা পাত্তা দেয়নি। তবে আজ আমি মহাখুশি। এই জয় ১৬ কোটি মানুষের জয়।”
সাফজয়ী নারী ফুটবল দলের সদস্য মাসুরা পারভীনের পথ চলার গল্পটা বেশ কষ্টের, বাধার মুখে পড়েছিলেন পদে পদে। তার বাবা ভ্যানচালক রজব আলী। উপার্জনের একমাত্র সম্বল ভ্যানটিও ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে বাড়ির উঠানে পড়ে রয়েছে। বাড়িটি তৈরি টিনের ছাউনি দিয়ে । রজব আলী এখন অসুস্থ হওয়ায় কাজও করতে পারছেন না। বাবার কষ্ট ঘোচাতে বাড়ি ফিরে বাবাকে মোটরভ্যান কিনে দেওয়ার কথা ভাবছেন তিনি।
মাসুরা যখন প্রথমদিকে খেলতে শুরু করেছিলেন, বিষয়টিকে ভালোভাবে নেননি তার বাবা, পরিবারটি এখন বলছে, দৃঢ় মনোবলে খেলা চালিয়ে যাওয়া মেয়ের কারণে এখন একটু ভালো থাকতে পারবেন তারা।
মাসুরার বাড়ি সাতক্ষীরা সদরের বিনেরপোতা এলাকায়, সরকারিভাবে দেওয়া আট শতক জমিতে থাকে মাসুরার পরিবার। মা ফাতেমা বেগম, দুই বোন সুরাইয়া পারভীন ও সুমাইয়া ইয়াসমিনকে নিয়ে তার পরিবার।
নারী ফুটবল দলের ডিফেন্ডার মাসুরা পারভীন সাতক্ষীরা শহরের কারিমা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। এক বোন সুরাইয়া দশম শ্রেণি ও ছোট বোন সুমাইয়া পড়ছে অষ্টম শ্রেণিতে।
মাসুরা পারভীনের এমন সাফল্যে এখন নিতান্তই খুশি তার পরিবার। অনুভূতি জানাতে গিয়ে রজব আলী বলেন, ‘আমি গরীব মানুষ। খেলাধুলা বুঝি না। আগে ফলের ব্যবসা করতাম। পরে ভ্যান চালাতাম, তবে ভ্যানটি নষ্ট হয়ে গেছে। তাছাড়া আমিও একটু অসুস্থ সে কারণে ভ্যানটি চালাতে পারছি না।’
তিনি জানালেন, সাতক্ষীরা পিটিআই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে মাসুরা খেলাধুলা শুরু করে।
“প্রথমে আমার খারাপ লাগতো মেয়ে মানুষ খেলা করবে কেমন দেখায়। তবে মাসুরার তীব্র ইচ্ছার কাছে হার মেনে অনুমতি দিলে তখন থেকে খেলাধুলা শুরু করে সে। আজকে আমরা মহাখুশি। এই জয় ১৬ কোটি মানুষের জয়।”
রজব আলী জানান, তার মেয়ে এবার বাড়িতে এসে মোটরভ্যান কিনে দিতে চেয়েছে।
‘প্যাডেল চালিত ভ্যানটি নষ্ট হয়ে গেছে। অসুস্থ মানুষ এখন আর পায়ের ভ্যান চালাতে পারি না। মোটরভ্যানটি কিনে দিলে ভালো চালাতে পারবো।”
মাসুরা পারভীনের মা ফাতেমা বেগম বলেন, “মেয়ের এমন জয়ে আমি খুব খুশি। জয়ী হওয়ার পর ফোন দিয়েছিল। আমার জন্য, বোন-বাবার জন্য কেনাকাটা করে নিয়ে আসবে বলেছে। সবার কাছে আমার মেয়ের জন্য দোয়া চাই।” তার বোন সুরাইয়া ও সুমাইয়া বলেন, “বড়বোনের এমন অর্জনে এখন আমাদের গৌরব হচ্ছে। সবাই ভালো বলছে।” সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কয়লা ইউনিয়নের আলাইপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন মাসুরার বাবা। তবে ১৯৭৩ সালে আট বছর বয়সে জন্মস্থান ত্যাগ করে সাতক্ষীরা শহরে চলে আসেন রজব আলী। এ শহরেই জন্ম হয় তিন কন্যার।
মাসুরা পারভীন জয়ের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, “এই জয়ে আমরা খুবই আনন্দিত। এই জয় একা আমার বা আমাদের জয় নয় জয়টি পুরো বাংলাদেশের জয়।” সামাজিক বাধা পেরিয়ে খেলাধুলা চালিয়ে যাওয়া আর দক্ষিণ এশিয়া জয়ী হওয়ার পর সমাজের অন্য মেয়েদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার আছে কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মাসুরা।
তিনি বলেন, “আগে অনেক মেয়েরা খেলাধুলা জানতো না। আমরা যে জয়টা করেছি এটা পুরো বাংলাদেশ দেখেছে। মেয়েরাও দেখছে। এখন আমাদের বলা লাগবে না এখন তারা নিজেরাই আসবে। খেলাধুলা লেখাপড়া একসাথে থাকা ভালো দিক।”
“আজ যদি আমি খেলাধুলা না করতাম তবে কোথায় থাকতাম আমি নিজেও জানি না। এ পর্যন্ত আসা সম্ভব ছিল না। আমি বলবো আমার মতো যারা আছে তারা যেন খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়।”