সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২২
অনুমোদনবিহীন এ্যাপোলো হাসপাতালে দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে তদন্তে সনদ নেই তবুও ডাক্তার শ্যামনগরের শাহজাহান সিরাজ
গাজী আল ইমরান, নিজস্ব প্রতিনিধি : ‘নেই ডাক্তারি সনদ, অনুমোদন নেই হাসপাতালের। বেড সংখ্যা ১০ টি থাকার কথা থাকলেও তার অধিক রোগী ভর্তি করা হয়। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নীতিমালা অনুযায়ী ৩ জন ডাক্তার থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র একজন ডাক্তার’। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার হায়বাতপুর মোড়ে অবস্থিত অনুমোদনহীন সুন্দরবন এ্যাপোলো হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তদন্ত শেষে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন তদন্ত কমিটি। জানা গেছে, সুন্দরবন এ্যাপোলো হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক শাহজাহান সিরাজের কোন ডিগ্রি না থাকলেও তিনি নামের আগে ডাক্তার, কনসালটেন্ট ও বিভাগীয় প্রধান, ফিজিক্যাল মেডিসিন ও থেরাপি বিভাগ কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল-ঢাকা লিখে থাকেন। এছাড়া প্রেসক্রিপশন, হাসপাতালের ক্যালেন্ডার, ভিজিটিং কার্ডসহ নানা স্থানে তিনি নিজেকে ডাক্তার হিসেবে উল্লেখ করেন। অথচ তদন্ত কমিটি ওই ভুয়া ডাক্তারের কোন সনদ পাননি শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. তরিকুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা। বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ডা. জিয়াউর রহমান। উল্লেখ্য, গত শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) উপজেলার আটুলিয়া ইউনিয়নের বড়কুপোট গ্রামের মৃত, মোকবুল হোসেন মালীর স্ত্রী রাবেয়া খাতুন (৬৪) জরায়ু সমস্যা জড়িত কারণে এ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি হয়। একই দিন বেলা ৫ টার দিকে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ এনেস্থেশিয়া ডাক্তার না নিয়ে একজন হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে ইনজেকশন পুশ করে রোগীকে অজ্ঞান করে খুলনার ডা. সুব্রত কুমার মন্ডলকে দিয়ে সার্জারী সম্পন্ন করা হয়। পরবর্তীতে ডা. সুব্রত কুমার মন্ডল রোগীকে সার্জারী করে তার কর্মসংস্থান খুলনাতে চলে যান। এরপর রাবেয়া খাতুনের অবস্থা ধীরে ধীরে অবনতির দিকে যেতে থাকে। শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) বেলা আনুমানিক ১২ টার সময় সুন্দরবন এ্যাপোলো হাসপাতালেই রাবেয়া খাতুনের মৃত্যু হয়। রোগীর মৃত্যুর পর তার স্বজনরা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন অভিযোগ দিতে থাকে। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ধামাচাপা দিতে বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করে। এক পর্যায়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদেরকে বুঝাতে সক্ষম হন যে এটা নিয়ে বেশি জানাজানি হলে লাশ দাফনে পুলিশ সমস্যা করবে। মৃত বৃদ্ধার স্বজনরা দাফনের জটিলতা এড়াতে তাদের কথা মেনে নেয় এবং সন্ধ্যার পরে একটি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স যোগে মৃত বৃদ্ধাকে গোপনে বাড়িতে পাঠানো হয়। এ সংবাদ জানাজানি হলে স্থানীয় সাংবাদিকরা তথ্য অনুসন্ধানে যাওয়ার পর সুন্দরবন এ্যাপোলো হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক শাহজাহান সিরাজ সাংবাদিকদের কোন প্রকার তথ্য না দিয়ে বিভিন্ন রকম অবান্তর কথাবার্তা বলতে থাকে। এক পর্যায়ে শাহজাহান সিরাজ সাংবাদিকদের কাছে একটি রোগীর মৃত্যু হয়েছে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, যে রোগী মারা গেছেন তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এবং ডা. সুব্রত কুমার মন্ডলের আত্মীয়। তবে তথ্য অনুসন্ধান করতে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে গেলে সেখানে মেলে ভিন্ন চিত্র। ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহজাহান সিরাজের কথার কোন মিল পাওয়া যায়নি। সেখানে গিয়ে জানা যায়, মারা গিয়েছেন একজন মুসলিম বৃদ্ধা। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাওর হলে সুন্দরবন এ্যাপোলো হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রতিষ্ঠান পরিচালক শাহজাহান সিরাজের বিরুদ্ধে গত ২৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. তরিকুল ইসলামের নেতৃত্বে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. মকদুম জাহান রানা, ডা. মিলন হোসেন, স্যানিটারি ইনেসপক্টর বিকাশ চন্দ্র সরকার এবং স্বাস্থ্য ইনেসপেক্টর মন্ডল ভুপতি ভূষণকে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেন শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও প.প কর্মকর্তা ডা. জিয়াউর রহমান। তদন্ত শেষে প্রতিবেদনে এসব কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত শুরুর পূর্বে হাসপাতালের পরিচালককে নোটিস করা হলেও তদন্তকালীন সময়ে হাসপাতালের পরিচালক উপস্থিত ছিলেন না। এছাড়া তদন্তকালীন সময়ে ডিপ্লোমাধারী নার্স, মেডিকেল অফিসারের তালিকা দেখাতে ব্যর্থ হন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এদিকে তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালটি ২০১৯ সালের পরে নিবন্ধন নবায়ন করতে পারেননি। অথচ হাসপাতালের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বহাল তবিয়তে। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক নীতিমালা অনুযায়ী ৩ জন ডাক্তার থাকার কথা থাকলেও ১ জনের উপস্থিত দেখা যায় বলে জানান তদন্ত কমিটি। সূত্রমতে জানা যায়, যতদিন পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক’ পরিচালনা নীতিমালা অনুযায়ী শর্ত পূরণ করবে, ততদিন পর্যন্ত ক্লিনিকটি অনুমোদন প্রদান না করতে সুপারিশ করেছেন তদন্ত কমিটি। এবিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ও তদন্ত কমিটি প্রধান ডা. মো. তরিকুল ইসলামসহ তদন্ত কমিটির সদস্যদের কাছে জানতে চাইলে তারা জানান, ‘আমরা তদন্ত কার্যক্রম শেষে উপজেলা স্বাস্থ্য ও প.প. কর্মকর্তা মহোদয় এর নিকট প্রতিবেদন জমা দিয়েছি’। এ্যাপোলো হাসপাতালের পরিচালক শাহজাহান সিরাজ নামের আগে ডাক্তার লিখতে পারবেন কি’না জানতে চাইলে তারা জানান, ‘যেহেতু তিনি এমবিবিএস বা বিডিএস ডিগ্রিধারী নন, সুতরাং ডাক্তার লেখার সুযোগ নেই’। এদিকে এসব ঘটনার পর বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) শ্যামনগরের এ্যাপোলো হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা হুসাইন শাফায়াত, শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ও তদন্ত কমিটি প্রধান ডা. তরিকুল ইসলামসহ শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. মো. হুসাইন শাফায়াত জানান, ‘আমি এ্যাপোলো হাসপাতাল পরিদর্শন করেছি। তাদের অনেক কাগজপত্রসহ নিবন্ধন সনদ নেই। আমরা অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব’। 8,587,651 total views, 4,337 views today |
|
|
|