Site icon suprovatsatkhira.com

ভূমিদস্যুদের শাস্তির দাবিতে সাতক্ষীরায় রবিবার মানববন্ধন

জগবন্ধু কয়াল, ঈশ^রীপুর (শ্যামনগর) প্রতিনিধি: শ্যামনগর উপজেলার ধুমঘাটে আদিবাসী মুÐা পল্লীতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় জখম চার জনের মধ্যে একজনের চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েেেছ। শনিবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
নিহতের নাম নরেন্দ্র নাথ মুÐা (৭০)। তিনি শ্যামনগর উপজেলার ধুমঘাট গ্রামের মৃত মুল্লুক চাঁদ মুÐার ছেলে।
শুক্রবার সকালে ধুমঘাটে মুÐা পাড়ায় তাÐবের ঘটনায় পুলিশ দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, শ্যামনগর উপজেলার বংশীপুর গ্রামের আলমগীর গাজীর ছেলে নুর হোসেন(২৬)। ও একই উপজেলার শ্রীফলকাটি গ্রামের আলমগীর গাজীর ছেলে নূর মোহাম্মদ (২২)।

এদিকে শ্যামনগর ধুম ঘাটে আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়ের জমি দখলের প্রতিবাদ ও সন্ত্রাসীদের হামলায় একজন নিহত ও তিনজন আহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে সাতক্ষীরার মানবাধিকার সংগঠন স্বদেশ, এইচ আর ডি এফ, সিএসও এইচআরডিকোয়ালিশন সাতক্ষীরা, মহিলা পরিষদ সাতক্ষীরা, সামস্, শ্যামনগর, আদিবাসী বিষয়ক জাতীয় কোয়ালিশন সাতক্ষীরা, সুন্দরবন ফাউন্ডেশন লিডার্স সহ বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের সমন্বয়ে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সামনে আগামীকাল ২১/৮/২২ তারিখ বেলা ১১.০০টায় মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। উক্ত মানববন্ধনে সকলকে উপস্থিত হওয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে।

অন্যদিকে সাতক্ষীরা-১ আসনের এমপি এ্যডভোকেট মুস্তফা লুৎফুল্লাহ তাঁর ফেসবুক পেজে নরেন্দ্র মুন্ডার মৃত্যুতে শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে লিখেছেন আদিবাসী মুÐা সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখল করতে হামলাকারীদের নৃশংস হামলায় আহত হয়ে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা। এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ ও হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য আহŸান জানাচ্ছি।

সরেজমিনে শনিবার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের ধুমঘাট গ্রামের মুÐা পাড়ায় যেয়ে দেখা গেছে নীলুর মোড় থেকে ভীম মÐলের বাড়ি পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার ইট সোলিং এর রাস্তা। সেখান থেকে অন্তাখালি মুÐাপাড়া হয়ে খলিলের মোড় পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার রাস্তা কাচা। অন্তখালি মুÐাপাড়ায় ২২ ঘর মুÐা বসবাস করেন। পরিমল মুÐার বাড়ির পাশের কালভার্ট থেকে দক্ষিণ দিকে অন্তাখালি হয়ে শিলতলা পর্যন্ত একটি খাল কাটা হয়েছে দুই বছর আগে। অন্তাখালি খালের পাশে মুল্লুক চাঁদ মুÐার জমিতে লাগানো প্রায় দেড় বিঘা জমির ধানের পাতা পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষ করে নষ্ট করা হয়েছে। শুক্রবার বিলে পানি না থাকলেও শুক্রবার বিকেল থেকে টানা বৃষ্টিতে হাটু পানি জমেছে। শুক্রবারের তাÐবে তিনজন নারী শ্যামনগর হাসপাতালে ও একজন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় মুÐা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে নরেন্দ্র মুÐা মারা যাওয়ার খবর পাওয়ার সাথে সাথে মুÐা পরিবারের সদস্যদের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ লক্ষ্য করা যায়।

শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত হামলার বর্ণনা দিতে যেয়ে নরেন্দ্র মুÐার স্ত্রী ৬২ বছরের বৃদ্ধা সুচিত্রা মুÐা বলেন, রাশেদুল ও এবাদুলের ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীরা সকাল সাতটার দিকে অন্তাখালি খালের দক্ষিনপাশে অবস্থান নেয়। এরপর নীলুর মোড় থেকে ও পেচোর মোড় থেকে শ্রীফলকাটি, বংশীপুর ও ঈশ্বরীপুরের দুই শতাধিক ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী হাতে দা, লাঠি, বেলচা, গাইতি, কুড়াল ইত্যাদি নিয়ে প্রতিটি মুÐা বাড়ির সামনে অবস্থান নেয়। প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে পরিমল মুÐার বাড়ির পাশের কালভার্ট এর পাশ থেকে বড় পাওয়ার টিলার বিলে নামিয়ে তাদের ধানের পাতার বীজতলা চষে নষ্ট করা হয়। মাঠে অবস্থানকারী রিনা মুÐা, সুলতা মুÐা, বিলাশী মুÐা বীজতলা নষ্ট করতে বাধা দিলে শ্রীফলকাটির নুরুল প্রথমে তাদেরকে বাধা দেয়। এরপর তাদেরকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে বিলের মধ্যে ফেলে রাখা হয়। জানালা দিয়ে দেখতে পেয়ে তার স্বামী নরেন্দ্র মুÐা ঘর থেকে বের হয়ে বিলে যাওয়ার চেষ্টা করলে রাশেদুল ও এবাদুল তাকে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে বিলের পানিতে ফেলে রাখে। সনাতন মুÐা ও ফণীন্দ্র নাথ মুÐার ঘরের চাল ভেঙে দেয় সন্ত্রাসীরা। হামলার দৃশ্য ধারণ করায় রিনা মুÐার হাতে কোপ মেরে তার স্মার্ট ফোন কেড়ে নেয় হামলাকারিরা। শনিবার থানায় মামলা করার পর দুইজন গ্রেপ্তার হওয়ায় নতুন করে হামলার ভয়ে মুÐা পরিবারের পুরুষ সদস্য ও স্কুল কলেজে পড়–য়া ছেলে ও মেয়েরা গ্রামের বাইরে যেতে পারছে না। এমনকি বাড়িতে কিশোরী মেয়ে ও নতুন বিয়ে দিয়ে নিয়ে আসা বৌমাদের সম্মান রক্ষা নিয়ে তারা আতঙ্কে রয়েছেন।

শ্যামনগর আতরজান মহিলা ডিগ্রী কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী বিশ্বকর্মা মুÐার মেয়ে সুপ্রিয়া মুÐা বলেন, সন্ত্রাসীরা যেভাবে তাদের বাড়ির সামনে সশস্ত্র অবস্থান নিয়ে পরিবারের সদস্যদের ঘরের মধ্যে অবরুদ্ধ করে ফেলে সে দৃশ্য তারা জীবনে ভুলতে পারবে না। এমনকি তাদের পরিবারের তিন নারী ও এক বৃদ্ধাকে যেভাবে পিটিয়ে জখম করার পর ধানের বীজতলা নষ্ট করে দিয়েছে তা যে কোন বর্বরতাকে হার মানায়। আগামীতে বাংলাদেশে কোন হিন্দু বসবাস করতে পারবে বলে তারা মনে করেন না।

ঈশ্বরীপুর এ সোবহান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী সাথী মুÐা ও পাতড়াখোলা আরশাদ আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র রিপন মুÐা জানান, মুÐাপাড়া বলে তাদের বাড়ির সামনের রাস্তা পাকা হয়নি। এরপরও শুক্রবারের হামলার পর তারা স্কুলে না যাওয়ার চিন্তা করছেন।
বাতাসী মুÐা বলেন, ঘর থেকে বের হতে না পারলেও সন্ত্রাসীদের বর্বরতা তারা দেখেছেন। সন্ত্রাসীরা চলে যাওয়ার এক ঘণ্টা পর পুলিশ এসেছে। অথচ ঈশ্বরীপুর ১নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবুল কালাম আজাদ, ১,২,৩ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা ইউপি সদস্য কমলা রানী মৃধা ও ইউপি চেয়ারম্যান অ্যাড. শোকর আলীসহ ক্ষতাসীন দলের কোন নেতা গত ৩০ ঘন্টায় তাদের পাশে এসে খোঁজ খবর নেয়নি।
শ্রীরাম মুÐা ও পরিমল মুÐা জানান, ঠাকুরদাদা মুল্লুকচাদ মুÐার বাদাকাটা ৩০ বিঘা জমি অভাবের তাড়নায় ৫০ বছর আগে শিলতলার ফকির মোড়লের কাছে ৮০০ টাকায় ১০ বছরের জন্য খাই খালাসি রাখে। অথচ ফকির মোড়ল ওই জমির মধ্যে ১৭ বিঘা জমি পাতড়াখোলার সামছুর রহমানের কাছে জালিয়াতির মাধ্যমে বিক্রি করে দেয়। ওই জমি আজো সামছুর রহমান দখলে রেখেছে। একইভাবে শ্রীফলকাটির গফুর সরদার জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করে বর্তমান জরিপে আট বিঘা জমি তার দু ছেলে রাশেদুল ও এবাদুলের নামে রেকর্ড করিয়ে জবরদখল করতে মুÐাপাড়ায় সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে।

স্থানীয় হিন্দু ও মুসলিম স¤প্রদায়ের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের জানান, মুÐাদের সম্পত্তি হস্তান্তর করার নিয়ম নেই। অথচ জালিয়াতির মাধ্যমে জমি লিখে নেওয়ায় আদালতে মামলা রয়েছে। শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ বিষয়টি নিয়ে মীমাংসার উদ্যোগ নিলেও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও ঈশ্বরীপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাড. শোকর আলী মীমাংসা করে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে শালিসে ব্যর্থতার দোহাই দিয়ে স্থানীয় দুই টি ক্লাবকে ম্যানেজ করে তারই আত্মীয়স্বজন সদস্যদের দিয়ে রাশেদুল ও এবাদুলের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে শুক্রবার মুÐাদের জমি দখলচ্যুত করতে নেপথ্যে থেকে কাজ করেছেন। এমনকি সামস এর নির্বাহী পরিচালক কৃষ্ণ পদ মুÐাকে দিয়ে মামলা বন্ধ করানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

জানতে চাইলে শনিবার সন্ধ্যায় ঈশ্বরীপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট শোকর আলী বলেন, মুÐাদের জমি সঠিক নয় ও নরেনদ্র মুÐা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন দাবি করে বলেন, ১৯৪৮ সালে গফুর সরদারের নামে ৮ বিঘা জমি হস্তান্তর দেখানো হয়েছে। হস্তান্তর করা যাবে না আইনটি হয়েছে ১৯৫০ সালে। মুÐাপাড়ায় সকালে হ্মালার ঘটনা ঘটলেও তার ভাই মাস্টার আব্দুল বারি অসুস্থ থাকায় ও রাত ১১টায় মারা যাওয়ায় তিনি সেখানে যেতে পারেননি। রাশেদুল ও এবাদুল তার প্রতিপক্ষ ছাদেকুর রহমান ছাদেমের আত্মীয় হওয়ায় তাদেরকে সহায়তা করার তার কোন সূযোগ নেই। উল্টে ছাদিকুর রহমান মুÐাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে তিনি জেনেছেন। তবে ক্লাবের কোন সদস্য সেখানে গিয়েছিল কিনা তা তার জানা নেই। তবে তার পরিচিতি যারা গিয়েছিল তাদেরকে ধমক দিয়েছেন তিনি।
তবে বংশীপুর মনস্টার ক্লাবের সভাপতি ফিরোজ হোসেনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী ওয়াহিদ মোর্শেদ জানান, ধুমঘাটে মুÐা পাড়ায় হামলার ঘটনায় নিহতের ভাইপো ফণীন্দ্রনাথ মুÐা বাদি হয়ে ৩০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ১৭০জনকে আসামী করে শনিবার সকালে থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। এ ঘটনায় পুলিশ নিজ বাড়ি থেকে নুর হোসেন ও নূর মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করে শনিবার আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠিয়েছে। শনিবার বিকেলে নরেন্দ্র মুÐার মারা যাওয়ায় হত্যা মামলা হিসেবে মূল মামলার সঙ্গে ৩০২ ধারা যুক্ত করার জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় তিনি ও কালিগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আমিনুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করেছেন। রবিবার লাশের ময়না তদন্তের জনস্য সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হবে।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version