Site icon suprovatsatkhira.com

পদ্মা সেতু চালুর পর কালিগঞ্জের বসন্তপুর নৌ-বন্দর চালু করার দাবি জোরালো হচ্ছে

ডেস্ক রিপোর্ট; গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে। দূরত্ব কমেছে ভারতের কোলকাতা শহরের। সময়ও লাগছে কম। এতে বেড়েছে ভোমরা স্থলবন্দরের গুরুত্ব। তবে সাতক্ষীরাবাসির দাবি পণ্য পরিবহন খরচ কমাতে ও ভোমরা বন্দরের উপর চাপ কমাতে ১৯৬৫ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া কালিগঞ্জের বসন্তপুর নৌ-বন্দরটি আবারও চালু করার কোন বিকল্প নেই।

সরেজমিনে সোমবার দুপুরে সীমান্তবর্তী কালিগঞ্জের বসন্তপুর এলাকায় গেলে স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি হাফিজুর রহমান জানান, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পরপরই রাজা প্রতাপাদিত্য ও বিক্রমাদিত্য স্মৃতি বিজড়িত বসন্ত রায় এর নামানুসারে কালিগঞ্জ সদর থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে গ্রামের নাম বসন্তপুর রাখা হয়। ইছামতী, কালিন্দি ও কাঁকশিয়ালী নদীর মোহনার (ত্রিমোহিনী) ভারত সীমান্তে হিঙ্গলগঞ্জের সঙ্গে বসন্তপুরে নৌ-বন্দর চালু ছিল। এ বন্দরটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করতো। এ বন্দরে মথুরেশপুর ও ভাড়াসিমলা ইউনিয়ন ছাড়াও সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকার হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান হতো। ঐতিহাসিক রামজননী ভবনটি দর্শণার্থদের কাছে অন্যরকম গুরুত্ব বহন করতো। এখানে রয়েছে হযরত বুল¬াহ সৈয়দ জীবের মাজার। পরিত্যক্ত রামজননী ভবনকে ঘিরে বর্তমানে বসন্তপুর রিভার ড্রাইভ ইকো পার্ক এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে পুকুর। বাঁধানো হয়েছে পুকুর ঘাট। শিশুদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে কয়েকটি দোলনা। শুরু হয়েছে রাস্তা সংস্কারের কাজ। পাশেই রয়েছে সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বসন্তপুর বিজিবি ক্যাম্প। চালু রয়েছে বসন্তপুর খাদ্য গুদাম। চলছে পার্কটির সৌন্দর্য বর্ধণের কাজ।

বিশিষ্ঠ সাহিত্যিক ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমান, বিশিষ্ঠ সমাজসেবক অ্যাড. জাফরউল¬াহ ইব্রাহীমসহ স্থানীয়রা জানান, নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। রাজা প্রতাপাদিত্যের কাকাতো ভাই রাজা বসন্ত রায়ের নাম অনুসারে অধুনা কালিগঞ্জের বসন্তপুর গ্রামের নামকরণ করা হয়। অনুকুল পরিবেশের কারণে পাকিস্তানের শুরুতে এলাকার উন্নয়ন ও সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের কথা মাথায় রেখে তৎকালিন পাকিস্তান সরকার এ নৌবন্দরটি চালু করেন। ক্রমশঃ এ বন্দরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে যায়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পর্যন্ত এ বন্দরের কার্যক্রম চালু ছিল। সেই সময় নৌ পথ ব্যবহার করে শত শত মানুষ হান্ডলোড সিস্টেমের মাধ্যমে মালামাল নিয়ে এপার-ওপার যাতায়াত করতো। এ বন্দর দিয়ে আমদানী-রপ্তানি হতো বিভিন্ন প্রকার পোশাক, পিতল-কাসা, হাড়ি-পাতিল, ফল ফলাদি, মুদি সামগ্রী পেয়াজ, রসুন, মশল¬া। সে সময় কাস্টমস ও ইমেগ্রেশন বিভাগের রমরমা কার্যক্রম থাকলেও পাক-ভারত যুদ্ধ শেষ না হতেই অনানুষ্ঠানিক ভাবে বন্দরের সকল কার্যক্রম বন্দ হয়ে যায়। তবে শুল্ক বিভাগের কার্যক্রম আজো চালু আছে। চারু রয়েছে বস্তপুর তহশীল অফিসটি। বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হলেও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত নদীপথে মানুষ এপার-ওপার করতো। দেশ স্বাধীনের পর থেকে অবৈধভাবে পারাপার হতো চোরাই পণ্য।

তারা আরো জানান, বন্ধ হয়ে যাওয়া বসন্তপুর নৌবন্দরের এলাকায় ১৪ বিঘা সরকারি খাস জমি রয়েছে। স¤প্রতি মাপ জরিপ করে এর নিশানাও নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর কোলকাতার সঙ্গে দূরত্ব কমে যাওয়ায় ভোমরা বন্দরের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। তাই বসন্তপুর নৌ-বন্দরটি আবারো চালু হলে ভোমরা বন্দরের উপর চাপ কমার পাশপাশি দুই দেশের ব্যবসা বাণিজ্যর স¤প্রসারণ ঘটবে। বন্ধ হবে চোরাচালান। কোলকাতার হলদিয়া বন্দর, খিদিরপুর ডক, বসিরহাট, হাসনাবাদ থেকে নৌপথে আমদানি ও রপ্তানিকৃত পণ্য পরিবহনে খরচ অনেক কম পড়বে। বঙ্গোপসাগর সংলগ্ম মান্দার বাড়িয়া সিবীচ, হেরোইন পয়েন্ট ও দূবলারচর হয়ে রায়মঙ্গলের মধ্য দিয়ে ডায়মন্ডহারবার, পূর্ব-মেদিনীপুরের বন্দর এবং দীঘা সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত দু দেশের ব্যবসা বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটবে। প্রতি বছরে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া কালিগঞ্জ, দেবহাটা, শ্যামনগর ও আশাশুনির লক্ষাধিক মানুষের নিরাপদ রুট হবে বসন্তপুর নৌবন্দর। এছাড়া কাঁকশিয়ালী নদীকে ড্রেজিং করে প্রবাহমান খোলপেটুয়া নদীর সাথে সংযুক্ত করলে নৌ পথে খুলনা অঞ্চলসহ রাজধনী পর্যন্ত অবাধ নৌ-বাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত হবে।

এলাকার বয়োবৃদ্ধরা জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯নং সেক্টরের সর্বাধিক কৌশলগত স্থান ছিল বসন্তপুরের বিলুপ্ত নৌ-বন্দর এলাকা। এই নৌপথটি এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল, জাতির পিতার ভ্রাতা শেখ নাসের, তার স্ত্রী, ছেলে শেখ হেলাল, শেখ ফজলুল করিম সেলিম এই পথ দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ গমনাগমন করেছিলেন। উপজেলা সদরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডাকবাংলোয় ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর হতে মাসাধিককাল সময় অবস্থান করেছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা। বসন্তপুরের এই এলাকাটির রয়েছে একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। বন্দর সংলগ্ন এলাকায় যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি আছে তা আজও ১৪ নম্বর পোর্ট বসন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত।

তারা আরো জানান, ২০২০ সালের ৮ ফেব্রæয়ারি নাট্য ও সংস্কৃতিক কর্মী ছাড়াও সাংবাদিক ও সামজিক সংগঠণের নেতা কর্মীদের উদ্যোগে বসন্তপুর নৌবন্দর এলাকায় প্রশাসনের সহযোগিতায় রিভারড্রাইভ ইকোপার্ক এ বনভোজন অনুষ্ঠান করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কাছে বন্দরটি চালুর ব্যাপারে গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর জেলা প্রশাসক মোস্তফা কামাল এর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। গত ১৮ জুন নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বিআরডিডবি¬উি কর্তৃপক্ষের একজন উপপরিচালকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের টিম বসন্তপুর এলাকায় এক সার্ভে করেন। স¤প্রতি তারা একটি প্রতিবেদন সংশি¬ষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর এ নৌ বন্দর পূণঃরায় চালুর ব্যাপারে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। এ বন্দরকে নতুন করে চালু করার লক্ষ্যে সাতক্ষীরার চারজন সাংসদসহ আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ সম্ভাবনাকে ঘিরে ১৪ জুলাই বসন্তপুর নৌ-বন্দর বিষয়ক সাব কমিটির আহবায়ক ও আওয়ামী লীগ নেতা এজাজ আহম্মেদ স্বপন দলীয় সাংসদ, জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বসন্তপুর এলাকা পরিদর্শণ করবেন। স্থানীয় সকল পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন তারা।

কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগ সাতক্ষীরার সহকারী কমিশনার আমির মামুন বলেন, বসন্তপুর নৌ-বন্দর চালু হলে আমদানি-রপ্তানিকারকরা বাণিজ্যিক স্বার্থে এটি ব্যবহার করবে। ফলে সরকারের রাজস্ব আরো বৃদ্ধি পাবে।
কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার রবিউল ইসলাম বলেন, বসন্তপুর নৌ-বন্দরের গুরুত্ব বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরতে তিনি সব ধরণের চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version