নিজস্ব প্রতিনিধি: সাতক্ষীরার তালা উপজেলা সদর ও ইসলামকাটি ইউনিয়নের গোপালপুর খালের চার কিলোমিটার চেঁচে ছুলে খনন দেখিয়ে উপকুলীয় সামুদ্রিক মৎস্য প্রকল্পের বরাদ্দ সিংহ ভাগ লুটপাট করার পরিকল্পনার অভিযোগ উঠেছে। গত ৬ জুলাই ভরা বর্ষা মৌসুমে কাজ শুরুতেই মালিকানাধীন জমি ও গাছ গাছালি কেটে খাল খনন করার প্রাথমিক উদ্যোগ নেওয়ায় তথ্যঅনুসন্ধানে সংশি¬ষ্ট ঠিকাদার, প্রকল্প কর্মকর্তা ও সংশি¬ষ্ট জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এ লুটপাটের চেষ্টার প্রক্রিয়াটি উঠে এসেছে।
সরেজমিনে শুক্রবার সকালে তালা উপজেলার ইসলামকাটি ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে যেয়ে দেখা গেছে গোপালপুর ¯¬ুইজ গেটের তালা সদর ইউনিয়নের অংশে কপোতাক্ষ নদের সংগে গোপালপুর খালের মাটি এসকেবটর মেশিন দিয়ে অপসারন করা হয়েছে। একইভাবে ¯¬ুইজ গেটের ভিতের অংশে মাটি অপসারন করা হচ্ছে। ¯¬ুইজ গেটের পশ্চিম দিকে প্রবাহিত খালের দক্ষিন পাশে সুমন রায় গণেশ, অনুপ রায়, তপন হালদার, বিশ্বজিৎ পাল, বিশ্বজিৎ দেবনাথ, গোপাল পাল, শঙ্কর দেবনাথ, উত্তম দেবনাথ, অশোক দেবনাথ, আব্দুল মান্নান, আমজাদ হোসেন, আব্দুল মোড়লসহ কমপক্ষে ৩০জনের রেকডীয় সম্পত্তির অংশ বিশেষ গত ৬ জুলাই থেকে ছোট এসেকেবেটর মেশিন দিয়ে কেটে ও মাঝারি ও ছোট প্রজাতির বনজ ও ফলজ গাছ কেটে খালের পাড় বাড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ওইসব জমিতে উচু করে ফেলা ২০১৫ সালে গোপালপুর খাল খননের মাটি দৃশ্যমান। অনেকেই কয়েক হাজার টাকা খরচ করে মাটি অপসারন করেছেন।
ইসলামকাটি ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের সুমন রায় গণেশ, তপন হালদার, গোপাল পাল, শঙ্কর দেবনাথ, বিশ্বজিৎ পাল ও অনুপ রায়সহ কয়েকজন জানান, ২০১৫ সালে তাদের রেকডীয় জমির অংশ বিশেষ এর উপরে খাল খননের মাটি ফেলা হয়। এতে অনেক ছোট খাটো ফলজ ও বনজ গাছ মাটির নীচে চাপা পড়ে। বেশ কয়েক ফুঁট উঁচু করে ফেলা মাটি অপসারনে তাদেরকে সাত থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। মাটি ফেলতে আপত্তি করায় সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে মামলা করার হুমকি দেওয়া হয়।
তারা আরো জানান, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে গোপালপুর ¯¬ুইজ গেট থেকে ইসলামকাটি ইউনিয়নের চার কিলোমিটার খাল দুই কোটি ৩৫ লাখ টাকায় খনন করা হবে বলে তারা জানতে পারেন। স¤প্রতি ওই খাল খননের লক্ষ্যে গত ৬ জুন থেকে খালের দক্ষিণ পাশে গোপালপুরসহ কয়েকটি গ্রামের কমপক্ষে ৩০জনের রেকডীয় জমির উপর দিয়ে ছোট এসকেবেটর মেশিন দিয়ে গাছ গাছালি ভেঙে ও মাটি কেটে ফেলা হয়। মাটি কাটা জায়গায় বড় এসকেবেটর মেশিন দিয়ে মাটি আরো ১৫ ফুট ভিতরে ফেলা হবে বলে তারা জেনেছেন। প্রতিবাদ করে তাদের কোন লাভ হয়নি। প্রতিকার চেয়ে তারা গত ১২ জুলাই তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এরপর থেকে তারা ঢেঁকির তসুলের মত একবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, একবার উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ও সংশি¬ষ্ট ঠিকাদারের কাছে ছুঁটছেন। এরই মধ্যে শুক্রবার থেকে আবারো খাল খনন শুরু হয়েছে।
সাতক্ষীরা ও যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের অর্খায়নে উপকুলীয় সামুদ্রিক মৎস্য প্রকল্পের আওতায় সাতক্ষীরা জেলার চারটি উপজেলায় নয়টি খালের ২৪ কিলোমিটার খননের জন্য একটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। গত বছরের ২০ ডিসেম্বর এ খননে ১৬ কোটি ৫ লাখ টাকা টেন্ডার হয়। এর মধ্যে তালা উপজেলার তিনটি খালের মধ্যে গোপালপুর খালের চার কিলোমিটার খননে দুই কোটি ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়্ াহয়। দরপত্রে মালিকানাধীন জমি খননে ক্ষতিপূরণ ও প্রতি ঘণফুট জমিতে মাটি ফেলার জন্য ১৬ টাকা করে বরাদ্দ রয়েছে। গত ২৬ জানুয়ারি ঢাকার জনৈক ভবন শহীদ এ কাজের কার্যাদেশ পেয়েছেন। তালা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার তত্বাবধায়নে খনন কাজের তদরকি করবেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও সংশি¬ষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান। গোপালপুর খালে জোয়ারভাটা খেলার কারণে গত ৩০ জুনের মধ্যে খাল খনন করা সম্ভব হয়নি। তবে মুল ঠিকাদার ঢাকার শহীদুল কাছ থেকে সাব কন্ট্রাক্ট নিয়ে রফিকুল ইসলাম তার ভাই তোহিদুলকে দিয়ে এ কাজ করাচ্ছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদার তালা উপাজেলার কুলয়া গ্রামের বজলুর রহমান জানান, ১৯৭৩ সালে গোপালপুর ¯¬ুইজ গেট থেকে দেওয়ানীপাড়া ইট সোলিং পর্যন্ত গোপালপুর খালটি ৬৯ হাজার টাকায় খনন করা হয়। এ সময় খনন কাজ তদারকি কমিটির সভাপতি ছিলেন তার মরহুম পিতা আব্দুর জব্বার মোড়ল। ১৯৭৯ সালে সাবেক ম্যাপ অনুযায়ি ১২০ ফুটের উর্দ্ধে চওড়া খাল খনন করার জন্য তদান্তীন ঠিকাদার স্থানীয় ইসলামকাটি ইউপি চেয়ারম্যান, তালা সদর ও তেঁতুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যানদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে অগ্রিম ক্ষতিপূরণ সাপেক্ষে মালিকানাধীন জমিতে খাল সরিয়ে দেওয়ার লিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ২০১০ সালে গোপালপুরসহ বেশ কয়েকটি খাল যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় চলে যায়। ২০১২-২০১৩ সালে কপোতাক্ষ খননে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। ২০১৫ সালে গোপালপুর ¯¬ুইজ গেট থেকে ইসলামকাটি ও তেঁতুলিয়ার নয় কিলোমিটার খাল খননে এক কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়। নকশা অনুযায়ি গোপালপুর খালের খালের উপরিভাগ দুই পাড়ের শেষ প্রান্তের মধ্যবর্তী ১২০ ফুট চওড়া ধরা হয়। মোট ৮৫ ফুট চওড়া, তলদেশ ৪৫ ফুট ও বেড়িবাঁধের মাথা(বার্ম) ১০ ফুট চওড়া করার কথা দরপত্রে বলা হয়। তাহলে দু’পাশে ৩৫ ফুট মাথার মধ্যে এক পাশে থাকবে সাড়ে ১৭ ফুট। ছোট এসকেবেটর মেশিন(৭ নং) ব্যবহার করতে বেড়ি বাঁধের ১৫ ফুট বাদ দিয়ে আড়াই ফুট জায়গায় মাটি ফেলা সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে বড় এসকেবেটর মেশিন ব্যবহারের কারণে লম্বা হাতলের জন্য কমপক্ষে আরো ২০ ফুট দূরে মাটি ফেলতে হবে। জমির মালিকরা এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
গোপালপুর খালের দু’পাশের বাসিন্দাদের অভিযোগ, খাল খননের সিডিউল তাদেরকে দেখানো হচ্ছে না। ২০১৫ সালে গেপালপুর খালের নয় কিলোমিটার খননে ব্যয় ধরা হয় এক কোটি ৯০ লাখ টাকা। সে সময় খাল ১২ ফুট খনন করার লক্ষ্য নিয়ে ৮৫ ফুট চওড়া ও ৪০ ফুট তলদেশ করার কথা বলা হয়। এর ছয় বছর পর ওই একই খালের চার কিলোমিটার দৈঘের ১৩ ফুট গভীর করার কথা বলে দুই পাড়ের বেড়িবাঁধসহ ১২০ মিটারের মধ্যে ৮৫ ফুট চওড়া করার কথা বলা হয়েছে। ২০১৫ সালে নয় ফুট গভীর থাকা খালের নামমাত্র গভীর করে দুই পাশে চেচে ছুঁলে খনন দেখানো হয়। এতে নয় কিলোমিটার খাল খননে পুকুর চুরির অভিযোগ উঠেছিল। জমির মালিকদের কোন টাকা দেওয়া হয়নি খনন ও মাটি ফেলার জন্য। তার ছয় বছর না যেতেই ১৩ ফুট গভীর দেখিয়ে মাত্র চার কিলোমিটার খান খনন করতে বরাদ্দ করা হয়েছে দুই কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ফলে আট থেকে নয় ফুট গভীর থাকা গোপালপুর খাল কোন রকমে এক থেকে দেড় ফুট খনন করে ভরা বর্ষা মৌসুমে চার কিলোমিটার খননে একজন সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ও ঠিকাদার যৌথভাবে সরকারি বরাদ্দের দুই তৃতীয়াংশ লুটপাট করবেন।
এ ব্যাপারে গোপালপুর খাল খনন বাস্তবায়নকারি তালা উপজেলা জ্যেষ্ট মৎস্য কর্মকর্তা স্নিগ্ধা খাঁ বাবলীর অফিসে গেলে বুধবার দুপুরে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে শুক্রবার সকালে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রামপালে একটি মৃত্যু বাড়িতে অবস্থান করছেন তিনি। পরে কথা বলবেন।
তালা উপজেলা চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ কুমার শুক্রবার সকালে এ প্রতিবেদককে বলেন, মালিকানাধীন জমির উপর দিয়ে খাল খনন করা হচ্ছে ১২ জুলাই এমন একটি অভিযোগ পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাকে বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নিতে বলেন। তবে তিনি কলাগাছিতে মালিকানাধীন জমির উপর দিয়ে খাল খননের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ওই খালের সমাধান হয়নি আর গোপালপুরের সমস্যা কিভাবে করবেন বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তবে সমস্যা সমাধানে ঠিকাদারের সঙ্গে কোন কথা হয়নি বলে জানান তিনি।
গোপালপুর খাল খননের সংশি¬ষ্ট ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম (ভবন শহীদ) শুক্রবার সকালে এ প্রতিবেদককে মালিকানাধীন জমিতে খাল খননের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মাটি ফেলা হচ্ছে। এতে জমির উর্বরতা বাড়বে। অনিয়ম ও দূর্ণীতির অভিযোগ অস্বীকার করে খনন অনুযায়ি বিল নেওয়ার দাবি করে বলেন, জমির মালিকদের সমস্যা সমাধানে উপজেলা চেয়ারম্যান বৃহষ্পতিবার গোপালপুর খনন এলাকায় গেছেন। খালে জোয়ারভাটা খেলা ও স্থানীয়দের আপত্তির কারণে নির্ধারিত সময়ে কাজ করা যায়নি।
তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস শুক্রবার সকালে এ প্রতিবেদককে জানান, সুমন নরায় গণেশসহ এলাবাসির অভিযোগটি খতিয়ে দেখে প্রযোজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছে। ঢাকা থেকে দরপত্র আহবান হওয়ায় তার কাছে কোন দরপত্রের কপি নেই দাবি করে তিনি বলেন, খনন অনুযায়ি ঠিকাদারকে বিল দেওয়া হবে।