ফারুক হোসাইন রাজ, কলারোয়া : গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মধ্যবিত্ত পরিবারে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা থাকলেও শিক্ষা থেকে ঝরে পড়েনি মেধাবী শিক্ষার্থী আছমা আক্তার মিতা৷ বাবা ফকির সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক বাউল গানের শিল্পী হওয়ায় সংসারিক জীবন থেকে অনেকটা আলাদা পরিবেশে বসবাস করেন৷ বিচ্ছিন্ন এ পরিবারে নূন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। দু’বেলা দুমুঠো অন্ন ঠিকমতো জোটাতেই হিমশিম খাচ্ছেন বাবা-মা। সেখানে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ দেওয়া মানে তাদের পরিবারের এক অন্যরকম ঝামেলা।
পরিবারে এমন দৈন্যদশায় ছোট থেকেই মা’য়ের অক্লান্ত পরিশ্রম একই গ্রামের দিনমজুর নানা–নানীর খুপরি ঘরে থেকে তাদের অনুপ্রেরণায় লেখা পড়া করেন মিতাসহ তার বড় বোন ও মেঝ ভাই।
তবে দমে যাওয়ার মেয়ে নয় আসমা আক্তার মিতা। অভাবের মাঝেও খেয়ে না খেয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। টিউশন উপবৃত্তি ও স্কলারশিপের টাকা দিয়ে তার লেখা পড়ার খরচ যুগিয়ে তারলক্ষ পূরণে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত দিনরাত পড়ালেখা করেছেন৷
শুধু অর্থ আর আভিজাত্য মানুষকে সব কিছু পাইয়ে দেয় না। এজন্য প্রয়োজন প্রবল ইচ্ছাশক্তির। এমনই ইচ্ছাশক্তির অধিকারী এক মারফতি ফকির বাউল শিল্পীর মেয়ে আসমা আক্তার মিতা ৪০তম বিসিএস ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন যে বিদ্যাপিঠ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেছেন মিতা সেই কাজীরহাট ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ এসএম শহিদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, সাতক্ষীরা কলারোয়া উপজেলার ৮ নম্বর কেরেলকাতা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম কিসমত ইলিশপুরের দক্ষিণ পাড়ার ২ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আসমা আক্তার মিতা। তার বাবা মোতাহার হোসেন মন্ডল একজন আধ্যাত্মিক সাধক মারফতি ফকির সম্প্রদায়ের বাউল শিল্পী। তিনি শুরু থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত ফকির মেলায় গান করে থাকেন। তার মা ঝর্ণা খাতুন পেশায় গৃহিণী। এইচএসসি পরীক্ষায় কাজীরহাট ডিগ্রি কলেজের ১২জন এ প্লাস প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিতা গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে সরকারি উপবৃত্তিসহ স্কলারশিপ পেয়েছেন যা তার লেখাপড়ার খরচ বহনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বাবার অভাবের সংসারের মাঝেও নিজেকে দক্ষতার সঙ্গে মেলে ধরেছেন আসমা আক্তার মিতা। শুধু তাই নয়, কলেজের সুনামও মিতা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন এ জন্য তিনি তার সফলতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করেন৷
গত ৩০ মার্চ দুপুরে ৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। পিএসসির চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন। এতে প্রশাসন ক্যাডারে ২৪৫, পুলিশে ৭২, পররাষ্ট্রে ২৫, কৃষিতে ২৫০, শুল্ক ও আবগারিতে ৭২, সহকারী সার্জন ১১২ ও পশুসম্পদে ১২৭ জনসহ মোট ১ হাজার ৯৬৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশ করা হয়েছে। মিতা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৬০ নম্বর সিরিয়াল অর্জন করে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
আসমা আক্তার মিতা একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে এই সফলতা অর্জন করেছেন। যে নানা নানীর কঠোর পরিশ্রম ও অনুপ্রেরণায় আজ ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার স্বপ্নটা পূরণ হয়েছে সেই মহান মানুষ গুলো বেঁচে নেই তার বেঁচে থাকলে তাদের মতো খুশি আর কেহ হতোনা৷ নানী জয়নুর খাতুন হাতের বুননে কাঁথা সেলাই করে তার লেখা পড়ার খরচ দিয়েছেন আবার নানা বরকতুল্য বিশ্বাস সকল ধরনের কাজ করতেন তবে খেজুরের কাছ কেটে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করতেন যাকে গাছি বলা হয়৷ দিনের পর দিন তারা এমন অগণিত পরিশ্রম করে তারা আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন।
এসময় তিনি তাদের রুহের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন৷ বাবার স্নেহ ও শিক্ষকদের আদরমাখা কড়া খেয়াল আজ সাফল্যের অন্যতম পাথেও। তিনি যেন কর্মজীবনে নিজেকে সততার সঙ্গে উৎসর্গ করে দেশ ও জনগনের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন তার জন্য সবার কাছে দোয়া কামনা করেন। নিজের প্রতি দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও মনের উচ্চ আকাঙ্খা থাকলে সাফল্যে পৌঁছাতে অভাব কখনো বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, তিন ভাই-বোনের মধ্যে আসমা খাতুন ছোট। একমাত্র ভাই ফয়সাল হোসেন রিকো দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেও এসএসসি পরীক্ষা দেননি। বর্তমানে সামান্য বেতনে বাস মালিক সমিতির স্টাটারের কাজ করে। সে সবার বড়। বড় বোন রেশমা আক্তার লতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ২০১৫ সালে মাস্টার্স শেষ করেন। বর্তমানে সে চাকরি খুঁজছে।
বড় বোন রেশমা আক্তার লতা বলেন, ছোটবেলায় বাবার কাছে বর্ণমালার হাতেখড়ি হয়েছে আসমার । আসমা উপজেলার কে কে ইপি সম্মিলিত মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এসএসসি পরিক্ষায় এ প্লাস প্রাপ্ত হন। এবং কাজিরহাট ড্রিগ্রি কলেজ থেকে ২০১২ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি পাশ করে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে। জীবন এখানে এসে ডানা মেলে ধরতে শুরু করে তার। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সাতক্ষীরার অজপাড়াগাঁয়ের সেই মেয়টি এখন প্রশাসনে বিসিএস ক্যাডার।
আসমার বাবা সুফিবাদ তরিকার সাধক বাউল শিল্পী মোতাহার হোসেন বলেন, অভাবের সংসারে কষ্ট করে হলেও মেয়েকে লেখাপড়া করিয়ে আজ আল্লাহর রহমত ও সবার দোয়ায় এই সফলতা। তাদের মেয়ে যেন আরও বড় হয়ে এলাকায় মুখ উজ্জ্বল করতে পারে দেশ ও জনগনের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তার জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন তিনি।
স্থানীয় কিসমত ইলিশপুর ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মুজিবুর রহমান মজি বলেন, মিতা ছোট থেকে সৎ অত্যন্ত কোমল স্বভাবের ও পরিশ্রমি মেধাবী শিক্ষার্থী। গ্রামের প্রতিটি মানুষ আজ খুশি যে মিতার পরিশ্রমই সফলতার সাথে এলাকার সুনাম বয়ে এনে ছোট্ট কিসমত ইলিশপুর গ্রামকে আলোকিত করেছেন মিতা।
কলারোয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস বলেন, উপজেলার ৮ নম্বর কেরেলকাতা ইউনিয়নের ইলিশপুর দক্ষিণ পাড়া গ্রামের মেধাবী ছাত্রী আসমা আক্তার ৪০তম বিসিএস এডমিন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার প্রতি উপজেলা প্রসাশনের পক্ষ থেকে রইলো শুভ কামনা।
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/