Site icon suprovatsatkhira.com

টানা ১৭ ঘন্টার যুদ্ধে পাক-হানাদারের ছোড়া চার গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মাজেদ

ফারুক হোসাইন রাজ, কলারোয়া: তখন ২২ বছর বয়স। ১৯৭১ সালে দেশকে স্বাধীন করতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের মুজাহিদ বাহিনীর চাকরি ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানের ভোমরা ঘোজাডাঙ্গা নামক স্থানের ভেড়িতে পশ্চিম পাকিস্তানী খান সেনাদের বিরুদ্ধে টানা ১৭ ঘন্টা যুদ্ধ করার পরে হানাদারদের ছোড়া ৪টি গুলি বুকে লাগলে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এসময় ঘটনাস্থলে মারা যায় তার সাথে থাকা আরও দুইজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বলছি সাতক্ষীরা কলারোয়া উপজেলার কেড়াগাছি ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মাজেদের রণাঙ্গনের গল্প।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মাজেদ কলারোয়ার কেড়াগাছি ইউনিয়নের বাকসা গ্রামের মৃত বাকের আলী গাজীর ছেলে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মাজেদ আজকের পত্রিকাকে সেই রণাঙ্গনের গল্প শুনিয়ে বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ সাহেব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নৌকা প্রতীকের ভোটে আওয়ামী লীগ দল থেকে জয়লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তান ক্ষমতা হস্তান্তর না করেই পূর্ব-পাকিস্তানের উপরে জুলুম নির্যাতন চালাতে থাকে শিক্ষা সামাজিক অর্থনৈতিক সকল দিক দিয়েই বৈষম্যতা সৃষ্টি করে বঞ্চিত করতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে। বাড়তে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালিদের উপর নির্যাতন। সময় পশ্চিম পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নির্দেশেই সারা পূর্ব পাকিস্তানে স্বৈরশাসন চালতে থাকে। সাতক্ষীরা মহাকুমা যার বর্তমান নাম সাতক্ষীরা জেলায়ও পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদারের জুলুম-নির্যাতন কোন অংশে কমতি ছিল না।

কলারোয়া সহ জেলায় বসবাস করা শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপক্ষের নারী-পুরুষ ও সাধারণ মানুষসহ যুবক যুবতীদের ধরে নিয়ে প্রকাশ্যে হত্যা সহ গৃহবধূ নারীদের তুলে নিয়ে ধর্ষণ এবং বিভিন্নভাবেই বন্দি করে রেখে বর্বর নির্যাতন ও হত্যাকাÐ চালানো হয়েছে। নারী পুরুষদের উপর এমন নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ১৯৭১ সালের মে তখন বাংলা বৈশাখ মাস চলছে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশকে স্বাধীন করতে আমিসহ কলারোয়া উপজেলা থেকে ২৮জনের একটি টিম বীর মমতাজ আহমেদের দিকনির্দেশনায় হাকিমপুর বর্ডারে দেছের খার দলুজ থেকে প্রস্তুতি নিয়ে ভারতের ঘোজাডাঙ্গায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নাম দেই। পূর্বে চাকুরির সুবাদে মুজাহিদ বাহিনী থেকে ট্রেনিং নেওয়া থাকলেও আবারও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সকল সদস্যের সাথে অস্ত্র ও আত্মরক্ষার ট্রেনিং নিয়ে সাতক্ষীরা মহাকুমার ভোমরা ঘোজাডাঙ্গা ভেড়ি নামক স্থানে প্রথম পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। এ সম্মুখযুদ্ধে কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গফফার।

ঘোজাডাঙ্গায় ৪দিনের ট্রেইনিং শেষ হলে সংবাদ বাহকের মাধ্যমে মকবুল খার বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন আমার ৪ মাসের শিশু কন্যা স্ত্রী বাবা-মা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গ্রামের মানুষের সাথে সাথে পশুপাখিও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে স্থানান্তরিত হয়েছিলো। গোলাগুলি বোমা বিস্ফোরণের তাÐবে বিধ্বস্ত আতঙ্কিত চারিদিকটা শুধু খাঁ খাঁ খাঁ করেছিল।

বৈশাখ মাসের শেষের দিকে ঘোজাডাঙ্গা যখন পাকহানাদার সাথে সম্মুখ যুদ্ধ হচ্ছিল। সেই যুদ্ধটি অনবরত ১৭ ঘন্টা যাবত চলেছিল প্রায় দুই শতাধিক খান সেনা হত্যার পরে হঠাৎ পাকহানাদারদের ছোড়া চারটি বুলেট পিঠে বা’পায়ে ও মাজায় লাগলে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। সেখানেই সাথে থাকা আরও দুইজন সহযোদ্ধা শহীদ হয়। দুইদিন পর জ্ঞান ফিরলে দেখি ভারতের বদরতলা হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে আছি। শরীরের বিভিন্ন রক্তঝরা অংশ মুছে দিচ্ছে একজন আয়া।

২২ দিন পর চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হলে আবারও ঘোজাডাঙ্গাসহ কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দেবহাটার কুলিয়া ব্রিজ ধ্বংস চেষ্টা।
তবে ৯মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সাতক্ষীরার সবথেকে দুঃখজনক ঘটনা ছিল শ্রাবণ মাসে। পূর্ব পাকিস্তানীর মানুষ হয়েও রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়ে ঝাউডাঙ্গা বলফিল্ডে আশ্রয় নেওয়া ৬৪ গ্রামের শরণার্থীদের প্রকাশ্যে পাক-হানাদারদের দেখিয়ে দিয়ে হত্যা করিয়েছিলো রাজাকার মতিয়ার রহমান মতি। সেই দেশদ্রোহী রাজাকার মতিয়ার রহমান মতি ও পাকসেনাদের হটাতে মুক্তিযোদ্ধারা পরিকল্পিতভাবে লুকিয়ে হালকা মেশিন গান কাছে নিয়ে ছদ্মবেশ ধরে পুইশাকের ব্যবসা করার কৌশল অবলম্বন করে কয়েক সপ্তাহ পরে ঝাউডাঙ্গা পাথরঘাটা এলাকার এক ব্যক্তির গোয়াল ঘর থেকে রজাকার মতি’কে আটক করে মুখে গামছা বেঁধে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়। এভাবে এলাকা থেকে অত্যাচারী পাক-হানাদার ও রাজাকার মুক্ত করেছিলাম।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পূর্বে সারা দেশে ঘাতকদের স্বৈরশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে আতঙ্কিত অসহায়ত্বে ছিল কলারোয়াসহ সারা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মাজেদ তার রণাঙ্গনের গল্প শোনাতে গিয়ে অশ্রæ ঝরিয়ে আক্ষেপ করে বলেন, দেশকে ভালোবেসে স্ত্রী-সন্তান বাবা-মা সব কিছুর মায়া মোহ ত্যাগ করে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম সেটা ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ প্রেম। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও স্বাধীনতা বিরোধীরা ও তাদের সন্তানানেরা এখনো দেশদ্রোহী কাজের সাথে সেই সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকার না করেই তাদের বিভিন্নভাবে অপমানিত লাঞ্চিত করছে। যারা দেশের জনগণ রাষ্ট্রের মঙ্গল চায় না রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতির বিপক্ষে থাকে তারাই দেশদ্রোহী তারাই রাজাকার তারা কখনো স্বাধীনতার স্বপক্ষের যোদ্ধা হতে পারেনা।

লাখো শহীদের বিনিময়ে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করেছিলাম একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাবো বলে যেখানে মানুষে মানুষে হানাহানি থাকবেনা সম্পত্তি নিয়ে ভোগ দখলের দৌরাত্ম থাকবে না সমাজে গোত্র প্রথা সৃষ্টি করে মানুষে মানুষে রাজনৈতিকতায় ধর্মের বৈষম্য সৃষ্টি করে মারামারি করবে না। স্ত্রী কন্যা সন্তান নিয়ে স্বাধীনভাবে পথ চলতে পারব কিন্তু সেখানে এখন ধর্ষণ সম্পত্তি দখল ৩২ সৃষ্টি করে মারামারি-কাটাকাটি রাজনৈতিকতা হিংসা হিংসি পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধা করেছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে নিজ ভাষায় কথা বলে পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে সকল মানুষ মিলেমিশে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করার জন্য। জননেত্রী শেখ হাসিনা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দিয়েছেন শেষ বয়সে এসেও সাম্মানিক ভাতা পাচ্ছি যা একজন বৃদ্ধের জন্য অনেক বড় পাওয়া।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version