Site icon suprovatsatkhira.com

স্মরণে ভাষা সৈনিক সাতক্ষীরার লুৎফর রহমান

আইয়ূব সরকারের হুলিয়া মাথায় নিয়ে কমরেড মনি সিং ও বারিন দত্তের সাথে দীর্ঘদিন পালিয়ে ছিলেন ভাষাসৈনিক মোঃ লুৎফর রহমান সরদার। সেসময় তার বাড়িতে আসা যাওয়া করতেন ও গোপন মিটিং করতেন অবিভক্ত বাংলার কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুসহ অনেকেই। ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও লুৎফর রহমান যখন ভারতে সংগঠকের দায়িত্বে ছিলেন তখনও বসিরহাটের টাকীতে থাকা তার পরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখতেন মুক্তিযুদ্ধের মেজর জলিল ও শাহজাহান মাস্টারসহ মুক্তিযোদ্ধারা।সেই লুৎফর রহমানের জীবনাবসান ঘটেছে ২০০৭ সালে ঘাতকব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। জীবদ্দশায় তিনি ভাষাসৈনিকের ঐতিহাসিক স্বীকৃতি ও মর্যাদা কোনোটিই পাননি। আজ অবধি একুশে পদকও পাননি তিনি । এই বঞ্চনা এখনও তার পরিবারকে পীড়া দিচ্ছে।

মোঃ লুৎফর রহমান সরদার ছিলেন সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার সখিপুর ইউনিয়নের ধোপাডাঙা গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৩২ সালে জন্মগ্রহনকারী লুৎফর রহমান কালিগঞ্জ উপজেলায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ভর্তি হন সাতক্ষীরার পিএন হাইস্কুলে। ১৯৪৯ সালে সেখান থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ন হবার পর লুৎফর রহমান ভর্তি হন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। অত্যন্ত প্রভাবশালী ডাকসাইটে ছাত্রনেতা লুৎফর রহমান যখন ১৯৫২তে এফএ (ফার্স্ট অব আর্টস, বর্তমানে ইন্টারমিডিয়েট) এর ছাত্র ছিলেন তখনই ডাক আসে ভাষা আন্দোলনের। পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে পাকিস্তান সরকারের রাষ্ট্রভাষা উর্দু ঘোষনার প্রেক্ষিতে যে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, লুৎফর রহমান জড়িত ছিলেন তার সাথে। জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ভাষা আন্দোলনের মিছিলে দফায় দফায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহনের অভিযোগে তাকেসহ মোট ২১ জন ছাত্রকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে। এরপর বন্ধ হয়ে যায় তার লেখাপড়া।

লুৎফর রহমানের স্ত্রী কারিমুন্নেছা বলেন, কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হবার পর তিনি দৈনিক সংবাদের সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী ও সংবাদে কর্মরত সাতক্ষীরার মাহবুব খানের সংস্পর্শে এসে মনি সিং নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এর সাথে সাথে পাকিস্তান সরকারও তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করতে থাকায় তিনি আত্মগোপনে চলে যান। একসাথে আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতিতে নিজেকে আরও সক্রিয় করে তোলেন এবং আইয়ূবের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান লুৎফর রহমান। এসময় আইয়ুব সরকার তাকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরিয়ে দিতে পারলে ১০ হাজার টাকা পরস্কার ঘোষনা করে। ১৯৫৮ সালে দেবহাটার পারুলিয়ার কারিমুন্নেছার সাথে তার যখন বিয়ে হয় তখনও নববধূ কারিমুন্নেছা ও তার পরিবারের লোকজন জানতেন না যে, মোঃ লুৎফর রহমান পাকিস্তান সরকারের হুলিয়া মাথায় নিয়ে গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি করেন।

তাদের বাড়িতে যখন জ্যোতি বসু ও মনি সিংয়ের মত বিখ্যাত নেতারা আসতেন , মিটিং করতেন ও খাওয়া দাওয়া করতেন তখন তারা লুৎফর রহমানকে ‘অরুন’ নামে ডাকতেন। আর এতেই সন্দেহ হয় কারিমুন্নেছার। পরে তিনি জানতে পারেন অরুন তার গোপন নাম এবং তিনি একজন কমিউনিস্ট নেতা। দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক মোঃ লুৎফর রহমান বাড়ি ছেড়ে থাকতেন খুলনার খালিশপুরে। সেখান থেকে পার্টির কাজ পরিচালনা করতেন। আইয়ূব সরকার বারিন দত্ত, মনি সিং, অজয় রায় , নেপাল নাগ, জহুর হোসেন চৌধুরীসহ যে কয়জনের নামে হুলিয়া জারি করে মাথার দাম ঘোষনা করেছিল তাদেরই একজন ছিলেন মোঃ লুৎফর রহমান। তিনি একবার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। সে সময় ভারতেশ^রী হোমসের হেনা দাস দাকে মুক্ত করেন। এর আগে আরও একাধিকবার গ্রেফতার হন তিনি। বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের প্রয়াত পতœী আইভি রহমানের ভাই খুলনার ম্যাজিস্ট্রেট আজিজুর রহমান ভুঁইয়ার আদালত থেকেও তিনি একবার মুক্তি লাভ করেন।

লুৎফর রহমানের বড় ছেলে আবুল কালাম পলাশ থাকেন ঢাকায়। ছোট ছেলে আবু রায়হান তিতু থাকেন গ্রামের বাড়ি ধোপাডাঙায়। তাদের একমাত্র বোন শাহনাজ খান সুইডেন সরকারের অধীনে একটি গুরুত্বপূর্ন পদে চাকরি করেন। শাহনাজ খানের শ^শুর মোঃ নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার একজন সাক্ষী এবং অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার। লুৎফর রহমানের সাথে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। সম্প্রতি অসুস্থ অবস্থায় তিনি লুৎফর রহমানের বাড়িতে এসেছিলেন।

জীবদ্দশায় কেবলমাত্র রাজনীতি ও সমাজসেবায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখায় লুৎফর রহমান পরিবারের প্রতি ছিলেন অনেকটাই উদাসীন। ধার দেনা করেই সংসার নির্বাহ করতে হতো তার। ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধের ডাকে ভারতে যেয়ে প্রশিক্ষনের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করতেন তিনি।এসময় ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল, সাতক্ষীরার বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শাজাহান মাস্টার এবং ভারতের কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুসহ অন্যদের সংস্পর্শে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে তাদের প্রশিক্ষন দেওয়াতেন।

এর আগে ১৯৬৫ সালে দেবহাটার সখিপুর ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে(বর্তমানে চেয়ারম্যান) তৎকালীন মৌলিক গনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী নির্বাচিত ৬ জন মেম্বারের ৫ জনের ভোট লাভ করেন তিনি। তারপরও তিনি প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসতে পারেননি। তাকে সরিয়ে দিয়ে ওই চেয়ার দখল করেন মাত্র ১ জন মেম্বারের ভোট পাওয়া প্রতিপক্ষের আবদুল করিম। আরও জানা যায়, লুৎফর রহমান তার প্রেসিডেন্টের পদ ফিরে পেতে আদালতে মামলা করেছিলেন। কিন্তু তার সেই মামলার রায় যখন দেওয়া হয় ততদিনে ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ফলে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে তিনি আর বসতে পারেননি। লুৎফর রহমান সরদার ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে এসে মাছ প্রতীক নিয়ে সাতক্ষীরার দেবহাটা-কালিগঞ্জ আসনে সংসদ নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হন। তবে এই নির্বাচনে তিনি হেরে যান।

দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের অধিকারী ভাষাসৈনিক লুৎফর রহমান আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরিত হচ্ছেন মানুষের কাছে। সাম্প্রতিককালে তার ধোপাডাঙা গ্রামস্থ কবরটি সুশোভিত করা হয়েছে। তার স্ত্রী কারিমুন্নেছা আক্ষেপ করে বলেন, স্বামী লুৎফর রহমান দেশকে দিয়েছেন অনেক কিছু। অথচ তিনি খালি হাতে চলে গেছেন। আজ অবধি তাকে একুশে পদকও দেওয়া হয়নি। এই বঞ্চনা আমাদের আর কতকাল সইতে হবে জানি না।


১৯৩২ সালে বাবা গোলাম সাত্তার ও মা জয়গুন্নেছার সংসারে জন্ম নেন মোঃ লুৎফর রহমান।
ভাষাসৈনিক লুৎফর রহমানের স্মৃতি ধরে রাখতে এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ। ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধার মতো বিরল মর্যাদার অধিকারী লুৎফর রহমানের পরিবার এখনও অপেক্ষায় তার মরনোত্তর একুশে পদক লাভের। —— সুভাষ চৌধুরী , সাবেক সভাপতি, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version