Site icon suprovatsatkhira.com

কলারোয়া পালপাড়ার দেড়শ বছরের মৃৎশিল্প বিলুপ্ত প্রায়

ফারুক হোসাইন রাজ, কলারোয়া : দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর। গ্রামের মাটি থেকে শহরের অট্টালিকায় বসবাস করা মানুষের দৈনন্দিন জীবন জীবিকা নির্বাহে পণ্যের মূল্য থেকে কাজের গতি পথের বিপুল পরিবর্তন এসেছে প্রযুক্তিতে। কালের বিবর্তন ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাবে সাতক্ষীরার কলারোয়া থেকে হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় দেড়শ বছরের পাল বংশের প্রাচীন মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য। গত ৩০ বছরে বিলুপ্ত হয়েছে এক সময়কার নিত্য প্রয়োজনীয় অর্ধ শতাধিক মাটির তৈরি হাঁড়ি পাতিল সানুক কলস গোখাদ্য দেওয়ার নান্দা ধান/চাল সংরক্ষণের হাড়া, জালাসহ পরিবেশ সুরক্ষিত জিনিস পত্র। বয়সের ভারে অধিকাংশ মৃৎশিল্পী মারাও গিয়েছে। সরকারি সহযোগিতার প্রত্যাশায় নারী-পুরুষ মিলে হাতে গোনা ৭ জন দক্ষ মৃৎশিল্পী বেঁচে থাকলেও তারা এখন বৃদ্ধ কোনরকম পৈত্রিক ঐতিহ্য রক্ষায় দিন পার করছেন।

সাতক্ষীরা জেলা সদর থেকে কলারোয়া উপজেলার দুরত্ব ২০ কিলোমিটার উপজপলা থেকে ভারত বর্ডার সিমান্ত ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে। সীমান্তবর্তী এ কৃষি নির্ভর উপজেলাতে এখন প্রায় তিন লক্ষ মানুষের বসবাস । উপজেলা পৌরসদরের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা বেত্রবতী নদীর পাড়ে পাল পাড়ায় শতবর্ষি প্রাচীন বাজারে টালির ছাউনি ঘরে মাটির জিনিস পত্র বানিয়ে চৌদ্দপুরুষের পেশাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। একসময় কাঁচামাল সংগ্রহ করে দাদা বা বাবার সাথে বাল নিজেই সবকিছু তৈরি করতেন। কিন্তু বর্তমানে কাঁচামালের অতিরিক্ত দাম আর বয়োবৃদ্ধ শরীর নিয়ে আগের মতো জিনিসপত্র তৈরি করতে পারেন না। স্ত্রী ছেলে নাতি-নাতনির সহযোগিতায় এখন তার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার একমাত্র সম্বল।

উত্তর মুরারীকাটি গ্রামের ধীরেন্দ্রনাথ পালের স্ত্রী অঞ্জলি পাল বলেন, ২০ বছর আগেও একসাথে যারা মাটির কারখানায় কাজ করেছেন তাদের অধিকাংশই এখন বেঁচে নেই তাদের সাথে সাথেই যেন করাখানাগুলোও বিলীন হয়ে গেছে। এক সময়ে রসের মৌসুমে মাটির ভাড় বিক্রি করে সংসার চালিয়ে অতিরিক্ত টাকা জমিয়েছেন কিন্তু এখন খেজুর গাছের সাথে গাছ কাটার গাছিও বিলুপ্ত হয়ে গেছে যে কারণে আগের মতো আর বেচা বিক্রি নেই। এখন প্লাস্টিকের কদর বেড়েছে কিন্তু মাটির হাড়ি কলস নান্দা জালা এগুলা এখন বিলুপ্ত। কিন্তু একসময় সমাজে এগুলোর রাজত্ব ছিল পরিবারের চাহিদায় অনেক মূল্যও ছিল। আমার পাশেই বিশ জনের মত কারখানা করেছিল সেখানে এখন নিজেই আছি। আমি মারা গেলে এই কাজ আমার পরিবারের আর কেউ করতে পারবে না তারা কেউ সেখানি। আর মাটির তৈরি রস সংগ্রহের ভাঁড় কলস পুতুল অন্যান্য জিনিস বানানোর কাজ সকলেই পারেনা হাতের এ কাজটি অনেক কষ্টসাধ্য তবে প্রশাসন বা অন্যান্য দপ্তর থেকে কেউ খোঁজ নেইনা এই পাল বংশের মৃৎশিল্পীদের।

মৃত ধীরেন্দ্র পালের ছেলে কৃষ্ণ পাল বলেন, একসময় এ রসের মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০পিছ ভাড় বিক্রি হতো কিন্তু এখন দিনে ১০ পিস বিক্রি করা অসম্ভব হয়ে যায়। আগে দেড় টাকা বা ৫ সিকে’ অর্থ দিয়ে গরুর গাড়ির ১ গাড়ি মাটি ক্রয় করে ৬০ থেকে ৭০ পিস এর মত ভাড় তৈরি করে ২টাকা দরে বিক্রি হতে। কিন্তু এখন মাটি ৩০০টাকা ট্রলি ও কামলা মজুরি ৩৫০টাকা। প্রতিটি জিনিসের দাম দাম বাড়লেও প্রযুক্তির প্লাস্টিকের ব্যবহারের সাথে মাটির সকল জিনিসপত্রের চাহিদা ব্যাপক কমেছে বেচাবিক্রি নেই এজন্য দিনদিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্প।

অনিতা পাল বলেন, যার হাত দিয়েই এ কারখানা সেই শ্বশুর ও শ্বশুরের বাবা সকলেই মারা গেছে এখন শাশুড়ি ছাড়া পরিবারে আর কেউ মাটির তৈরি পরিবারে ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্র বানাতে পারেনা। মাটির তৈরি জিনিস এখন আর কেউ তেমন ব্যবহার করেনা তবে বাড়িতে অযথা সময় ব্যয় না করে শাশুড়ির কাছ থেকে শিখে নিজেদের কারখানায় কোনরকম হোটেলের দইয়ের মালসা বানানোর কাজ করেন তাতে যা অর্থ হয় লাভ না হলেও অভাবের সংসারে কোন রকম টাকা একসাথে পাওয়ার পরে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার কাজে ব্যয় করতে পারেন।
পৌরসভার গদখালী গ্রামের বাক প্রতিবন্ধী নারায়নচন্দ্র পাল (৬৮) তিনিও তার দাদা ও বাবার হাত ধরেই এ কাজ শিখেছিলেন বয়সের ভারে তিনি নুয়ে পড়লেও এখনো তিনি সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তার স্ত্রী আশালতা পাল বলেন, সরকারিভাবে অনেক সুযোগ সুবিধা আসলেও পালপাড়ার মৃৎশিল্পীদের কোনো সুযোগ-সুবিধা আসেনা এ ব্যবসায় তেমন লাভ নেই যদি সরকারিভাবে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হতো তাহলে অবশ্যই মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য কোন রকম টিকিয়ে রাখা যেত। দক্ষ কারিগরের মধ্যে বিশিপাল, শিবেপাল, ষষ্ঠীপাল, কুশিপাল, কেলুপাল, রামপাল, বৈদ্যপাল, নেতাইপাল, দিনুবন্ধু পালসহ ১৮ জনের মত মৃৎশিল্পী মারা গেছেন এক সময় তার অনেক দক্ষ মৃৎশিল্প ছিল যাদের অবদান সমাজে অনস্বীকার্য।

কৃষ্ণপাল বলেন, দাদুর হাত ধরে বাকপ্রতিবন্ধী বাবা মৃৎশিল্পের কাজ শিখেছিলেন তবে এ কাজে লাভ না হওয়ায় আমরা বিভিন্ন পেশায় চলে এসেছি বাবা মারা গেলে এ কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এক সময়ে কলারোয়া থেকে মৃৎশিল্পীদের গড়া হাঁড়ি পাতিল টালিসহ বিভিন্ন জিনিস পত্র জেলার চাহিদা মিটিয়ে বাইরের জেলাতে রপ্তানি হতো। কিন্তু এখন টালির কারখানা ও মৃৎশিল্প প্রায় বিলুপ্ত। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য প্রশাসন বা কোন দপ্তর থেকে এই পাল বংশের কোন মৃৎশিল্পীদের খোঁজ নেন না এমনকি তাদের কোন ধরনের সহায়তা করেন না। সরকার যদি মৃৎশিল্পীদের পাশে এসে দাঁড়ায় তাহলে অবশ্যই প্রাচীন ঐতিহ্য বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে।

কলারোয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও জুবায়ের হোসেন চৌধুরী বলেন, সৃষ্টির আদি থেকেই প্রতিটি পরিবার ও সামাজিক ভারসাম্য রক্ষায় মৃৎশিল্পের গুরুত্ব ও অবদান অনেক বেশি আর মাটির তৈরি সানুকে ভাত খাওয়ার বিশেষত্ব অনেক। প্লাসটিক ও প্রযুক্তিনির্ভর জিনিসপত্র ব্যবহারের কারণে মাটির তৈরি জিনিসের ব্যবহার কমেছে তবে কদর কমেনি। বরং বড় বড় নামীদামি ভিআইপি রেস্টুরেন্টে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। উপজেলাতে যেসকল মৃৎশিল্পীরা রয়েছে তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে তাদের সাথে আলোচনা করা হবে পাশাপাশি মৃৎশিল্পীদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে যাতে তারা সরকারি সহযোগিতার আওতায় আসে সে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version