জন্মিলে মৃত্যু হইবে এই চিরন্তন সত্য কথা নিয়ে কোনো বিতর্ক হবার সুযোগ নেই। তবে জন্ম যেমন কাংখিত তেমনি মৃত্যু তার বিপরীত মেরুতে অনাকাংখিত অপ্রত্যাশীত। জন্ম আমাদের শুভ্র হাসি এনে দেয়। আর মৃত্যু এনে দেয় বেদনার জলরাশি। আর এই দুইকে নিয়েই তো মানবজীবন। তবে মানব জীবনের পরিমাপ কতোটা তা কেবল মৃত্যুই বলতে পারে। এ বিষয় নিয়েও তাই বিতর্কে নামা যায়না। মৃত্যুর আকষ্মিকতা আমাদের হতচকিত করে দেয়।একটি মৃত্যু একটি পরিবারে এনে দেয় স্বজন হারানোর বেদনা। এই মৃত্যুর প্রভাব পড়ে মৃতের বলয়জুড়ে। মানুষ তবু মেনে নেয় এই অমোঘ সত্যটি।
ব্যবধান মাত্র দিন তিনেকের। এরই মধ্যে সাতক্ষীরার মানুষ হারিয়েছে তাদের দুই প্রিয়জনকে। এই দুইজনই ছিলেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল। তারা তাদের জীবনকে খুঁজে পেয়েছেন নিজেদের পেশার মথ্যে । নিবেদিত থেকেছেন তার মধ্যে। জীবনযুদ্ধে তারা যে সফলতা পেয়েছিলেন তা ছড়িয়ে দিয়েছেন জনারণ্যে। এ কারনেই তারা সফল নিজ নিজ ক্ষেত্রে।
হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া যে দুই সফল ব্যক্তির কথা বলছি তারা হলেন অ্যাডভোকেট অরুন ব্যানার্জি। অপর জন একেএম আনিছুর রহমান। অরুন ব্যনার্জি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সাতক্ষীরা করেসপনডেন্ট। অপরদিকে আনিছুর রহমান সাতক্ষীরার দৈনিক সুপ্রভাত পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। সেই সুবাদে তারা সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সদস্য। একেএম আনিছুর রহমান গত ১৬ ডিসেম্বর দুবাইতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। অপরদিকে অরুন ব্যনার্জি গত ১৯ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। অ্যাডভোকেট অরুন ব্যানার্জি একজন আইনজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে আইন পেশায় নিবেদিত থেকে সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন চেষ্টা করে গেছেন। আইনের যুক্তি দিয়ে তিনি এই পেশাকে আরও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন।
আর এ কারণে তিনি ছিলেন সুখ্যাত। তিনি দেওয়ানী মামলায় প্রতিপক্ষের সাথে আইনী যুদ্ধ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সব ধরনের মোহ বিলাস পেছনে ফেলে কেবলমাত্র আইনের ব্যখ্যায় নিজেকে পরিবৃত্ত করেছেন তিনি। এর পাশাপাশি অরুন ব্যানার্জি দীর্ঘদিন যাবত সাংবাদিকতা করে নিজেকে জনকল্যান ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াই করেছেন। খানিকচা প্রচারবিমূখ অবস্থায় নিভৃতে থেকে তিনি মানুষের সেবা দিয়েছেন। অত্যন্ত নির্লোভ এবং সাদাসিদে প্রকৃতির এই মানুষটি সাধারন পোশাক ব্যবহার করতেন। কারও সাথে তাকে ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়নি। একজন সুবক্তা সুলেখক এবং জ্ঞান সমৃদ্দ ভান্ডারের অধিকারী হিসেবে অরুন ব্যানার্জি তথ্য সমৃদ্ধ হয়ে কথা বলতেন।
১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া এই গুনি মানুষটিকে আমরা চিরদিনের মতো বিদায় দিলাম মহা বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর মাস সেই ডিসেম্বরেই। যে ডিসেম্বরে অরুন ব্যানার্জির মতো অগনিত অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা বাঙ্গালি জাতির হাতে তুলে দিয়েছিলন একটি লাল সবুজ পতাকা। মারণ ব্যাধি ক্যান্সার তাকে ক্ষমা করেনি। তাকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। স্তম্ভিত তার স্বজন, শুভাকংখী ও সহকর্মীরা। হারানোর এই বেদনা বুকে বিঁধে থাকলো চিরস্থায়ীভাবে।
একজন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকই নন শুধু একেএম আনিছুর রহমান। তিনি ছিলেন বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র সিবি হাসডাতালের ম্বত্ত¡াধিকারী । ছিলেন আধুনিক শপিংমল চায়না বাংলা শপিং কমপ্লেক্সেরও স্বত্ত¡াধিকারী। চায়না ফুডস এবং আধুনিক মানের রিসোর্ট বরষা রিসোর্ট এর মালিক আনিছুর রহমান বরষা নামের একটি এনজিওর নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থেকে তিনি দিয়েছেন স্বাস্থ্যসেবা এবং কল্যানমূলক নানা সেবা। ব্যবসার এই জগতে তিনি ছিলেন নিভৃতচারী। সাধারন পোশাক আশাক ছিল তার পছন্দের। সফল ব্যবসায়ী হিসেবে একেএম আনিছুর রহমান নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জনারণ্যে। প্রাতিষ্ঠানিক বলয়ে থেকে তিনি জনসম্পৃক্ত হয়ে ওঠেন। জেলা শহরে একটি দৈনিক দাঁড় করিয়ে আনিছুর রহমান একজন সফল সম্পাদক প্রকাশক হিসেবে গনমাধ্যম জগতেও নিজেকে পরিচিত করে তোলেন। হৃদরোগ যন্ত্রণা তাকেও ক্ষমা করেনি। ছিনিয়ে নিয়েছে তার জীবন। সেই সাথে সাতক্ষীরার দুই গুনি মানুষের যেনো নক্ষত্র পতন হলো চোখের নিমেষে। সৃষ্টি হলো এক গভীর শুন্যতার।
প্রয়াত অরুন ব্যানার্জির সাথে আমার প্রায়ই দেখা হতো প্রাত:ভ্রমণকালে। কিন্তু দীর্ঘদিনের অসুস্থতার কারণে তিনি প্রাত:ভ্রমন থেকে সরেছিলেন বহুদিন । একই কারণ আমারও। তাই অনেকদিন দেখা হয়নি তার সাথে । কিন্তু যেদিন শেষ দেখা হলো সেদিন তিনি ছিলেন পুস্পশোভিত মুদিতচক্ষু এক নীরব নিথর নিষ্প্রাণ শায়িত শবদেহী জাতীয় পতাকাবেষ্টিত এক মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্যালুট গ্রহনকালের বিউগলের করুণ সুরের মাঝে। তাকে গার্ড অব অনার দিয়ে ফুলেল অন্তিম শোভাযাত্রায় চির বিদায় দিলেন স্বজনরা। স্বজন শুভাকাংখী সহকর্মী আইনজীবী ও সংবাদ কর্মীদের শোক সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন তিনি। আর কয়েক দিনের শ^াসরুদ্ধকর প্রতীক্ষার পর আনিছুর রহমানের কফিন দুর আকাশসীমা ভেদ করে বাংলাদেশের মাটি ছুঁয়েছে। চোখের জল ফুলেল শ্রদ্ধা ভালবাসায় সিক্ত হয়ে স্বজন ও শুভাকাংখী সহকর্মীদের কাছ থেকে চির বিদায় নিয়ে তিনিও আজ অন্তিম শয়ানে শায়িত হবেন।
যেতে নাহি দিব হায়, তবু চলে যায় এই চিরন্তন সত্য বাক্যটি বারবার আছড়ে পড়বে তাদের স্বজনদের হৃদয় মাঝে।
এই লেখাটি শেষ করতেই খবর এলো বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক নেতা ফিনানসিয়াল হেরাল্ডের সম্পাদক জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি এবং বিএফইউজের সাবেক সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদকে ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। কোভিড আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়াইয়ে হেরে যান তিনি। শনিবার দুপুরে শেষ নি:শ^াস ত্যাগ করেন এই কৃতীপুরুষ। আমরা তাকে হারিয়ে আরও এক গভীর শুন্যতার মাঝে পড়ে রইলাম। —– সুভাষ চৌধুরী , সাবেক সভাপতি সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব।