Site icon suprovatsatkhira.com

কীর্তিমানের মৃত্যু নেই

মাজহারুল ইসলাম : সমাজের পিছিয়ে পড়া মেধাবীদের মূল ধারায় টিকিয়ে রাখাই তার নেশা ছিল। গরীব অসহায় খেলোয়াড়দের পোশাকসহ আর্থিক সহায়তা করার মধ্যেও তিনি শুখ খুঁজে পেতেন। তিনি আর কেউ নন। সাতক্ষীরার ক্রীড়াঙ্গনের সাবেক সফল সম্পাদক একে এম আনিছুর রহমান। যিনি গত ১৬ ডিসেম্বর বিদেশের মাটিতে থেকে আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

আলাপ চারিতায় জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য মীর তাজুল ইসলাম রিপন তার অকাল মৃত্যুতে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘সাতক্ষীরা জেলা ক্রীড়াঙ্গনে যতগুলো স্পন্সার ছিল সবার প্রিয় আনিছ ভাই-ই ছিল মূল স্পন্সার। অনেকে হয়তো অনটাইম স্পন্সার হয় কিন্তু যতদিন খেলা হয়েছে টোটাল খেলার তিনিই স্পন্সার ছিলেন। এছাড়া সাতক্ষীরা থেকে যত টিম খেলে বা বাইরে খেলতে যায় তারা চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসলে তিনি ব্যক্তি উদ্যোগে নিজের অর্থে তাদের বেøজারসহ তিন সেট করে বিভিন্ন উপকরণ কিনে দিতেন। যেটা আগে কখনো কেউ করেনি। খুশিতে সবাইকে নিয়ে চায়না বাংলা কিচেনে খাওয়াতেন। এছাড়া গরীব খেলয়াড়দের কেডস কিনে দেয়া, জার্সি কিনে দেয়া, আর্থিক সহায়তা করা এমনকি যারা জাতীয় টিমে খেলতে যায় তাদের সহযোগীতা করতেন। প্লেয়ারদের বাইরে যাতায়াত খরচ, থাকা খাওয়া খরচ সে নিজে দিতেন। অনেক সময় দেখা যায় একজন বিকেএসপিতে চান্স পেয়েছে অথচ আর্থিক অসুবিধার কারণে সে যেতে পারছে না। সেক্ষেত্রে সে সকল প্রকার আর্থিক সুবিধা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাকে হারিয়ে জেলার ক্রীড়াঙ্গন বড় একজন স্পন্সর হারিয়েছে। তাকে হারানোয় জেলা ক্রীড়াঙ্গণে যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়’। তিনি তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।

সাতক্ষীরার ক্রীড়াঙ্গনকে জাতীয় ও আন্তুর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার পিছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন সাতক্ষীরা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক একেএম আনিছুর রহমান। তিনি ছোটবেলা থেকেই খেলার প্রতি খুবই আগ্রহী ছিলেন। শিক্ষা জীবনে বন্ধু সহপাঠীদের নিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবলসহ স্কুল কলেজের মাঠে অসংখ্য খেলায়। খেলার প্রতি অগাধ ভালোবাসার কারণেই বাল্যকাল থেকেই জেলার ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন একেএম আনিছুর রহমান। স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়ন করে নিজের তীব্র জ্যোতি ছড়িয়ে গেছেন জেলার ক্রীড়াঙ্গনে। যা স্বপ্ন দেখেন, তা বাস্তবে রূপ দিতে কখনও পিছপা হননি তিনি। গত কয়েক বছর তারই উদ্যোগে সাতক্ষীরায় অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে দক্ষিণাঞ্চলের ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় ইভেন্ট চায়না-বাংলা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। শুধুই কি ক্রিকেট? কাবাডি, ফুটবল, ভলিবল কিংবা অ্যাথলেটিক্সের প্রত্যেকটি ইভেন্টেই ছিল তার সক্রিয় পদচারণা। ক্রীড়াঙ্গনে গতি ফেরানো ও মাদকাসক্তি থেকে যুব সমাজকে মাঠে ফেরাতে ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর জেলা ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচনে সম্মিলিত ক্লাব ঐক্য পরিষদ থেকে একেএম আনিছুর রহমান সাধারণ সম্পাদক হিসাবে প্রার্থী হন। নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভও করে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি সাতক্ষীরার ক্রীড়াঙ্গনে দীর্ঘদিনের স্থবিরতা দূর করা, মাঠে খেলাধুলা ফিরিয়ে আনা, জাতীয় পর্যায়ের খেলাধুলায় স্থানীয় খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন। তিনি বিপদগামী যুব সমাজকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে, জঙ্গিবাদ থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে খেলাধুলার সব ইভেন্টে উপজেলা পর্যায় থেকে খেলোয়াড় বাছাই করে এবং খেলোয়াড় তৈরিতে জেলার ক্লাবগুলোকে সাধ্যমত সহায়তা করেন। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট ও অন্যান্য টুর্নামেন্টগুলো আরও জাকজমকপূর্ণ করতে জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়েছেন। জেলার সকল পর্যায়ে খেলোয়াড়দের জন্য ক্লাবগুলোকে খেলাধুলার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগঠনের পক্ষ থেকে এবং নিজ উদ্যোগেও সরবরাহ করে গেছেন একেএম আনিছুর রহমান।

সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রেফারিজ এ্যাসোসিয়েশন ও ক্রিকেট আম্পায়ার্স এন্ড স্কোরারার্স এ্যাসোসিয়েশনের জন্য রুম বরাদ্দ দেওয়া, দুস্থ ক্রীড়াবিদদের সহায়তা, প্রাক্তন ক্রীড়াবিদদের নামের তালিকা তৈরী করে ক্রীড়া সংস্থায় সংরক্ষণ এবং তাদের যথাযথ সম্মানের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। যুব সমাজের বর্তমান অবক্ষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন এ.কে.এম আনিছুর রহমান ছিলেন পরিবর্তনে অঙ্গীকারাবদ্ধ। একেএম আনিছুর রহমানের স্বপ্ন ছিল জেলায় একটি পূর্ণাঙ্গ ক্রীড়া কমপ্লেক্স ও একটি মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণের। পাশাপাশি উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়েও ক্রীড়া উদ্যোগ ছড়িয়ে দেওয়া। আপ্রাণ চেষ্টা ছিল সন্ত্রাস ও মাদকাসক্তি থেকে যুব সমাজকে মাঠে ফেরানো। এছাড়াও তিনি সাতক্ষীরার একজন আলোকিত উদ্যোক্তা হিসেবে সফলতার শীর্ষে পৌঁছান। গড়ে তোলেন বরসা এনজিও, বরসা রিসোর্ট, বরসা ট্যুরিজম, চায়না বাংলা শপিং কমপ্লেক্স, চায়না বাংলা ফুড, সিবি হাসপাতাল ও দৈনিক সুপ্রভাত সাতক্ষীরা পত্রিকা। উল্লেখ্য, গত ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে সাতক্ষীরার এই গুণী ব্যক্তি দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তার আকস্মিক মৃত্যুতে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

সাতক্ষীরা টাউন স্পোর্টিং ক্লাবের কর্মকর্তা আশাফুজ্জামান আশু বলেন, ‘আনিছুর রহমান জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও একই সাথে বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি ছিলেন। উনি খুব সাদা মনের মানুষ ছিলেন। জেলার ক্রীড়াঙ্গণকে গতিশীল করার জন্য সে নিজের অর্থ দিয়ে ক্রীড়া সংস্থা পরিচালনা করতেন। ক্রীড়ার মান উন্নয়নের জন্য সবকয়টি প্রচেষ্টা তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন। যেমন ক্রিকেট: ক্রিকেটের কয়েকটা ভাগ আছে তার মধ্যে প্রিমিয়ির ডিভিশন, ফাস্ট ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন এভাবে ভাগ ভাগ করে প্রতিটি ডিভিশনে খেলোয়াড়দেরকে সে নিজ অর্থে জার্সি ও খেলার সরঞ্জাম কিনে দিতেন। খেলাধুলার প্রতি তার অকৃত্রিম মনোযোগ ছিল। আমাদের ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচনে হার-জিত দুটোই ছিল। গত নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্ব›দ্বীতা হয়েছিল। সেখানে লটারিতে সে পরাজিত হয়। এটাকে হারাও বলা যায় না।

এছাড়া তিনি মানুষ হিসেবে অত্যন্ত সাদা মাঠা জীবন যাপন করতেন। সাধারণ মানুষের সাথে তার খোলামেলা চলাফেরা ছিল। এমনকি ক্রীড়া সংস্থায় আমরা রেগুলার যে নাস্তা করতাম সে টাকাও নিজের পকেট থেকে দিতেন। সবসময় বলতেন সংস্থার ফান্ডের অর্থ যেন খরচ না হয়। এককথায় তিনি ক্রীড়ামোদী মানুষ ছিলেন। অন্য দিক থেকে দেখতে গেলে, সাতক্ষীরায় অনেকে ধনী লোক আছে কিন্তু তরুন বয়সে যে উদ্যোগগুলো নিয়েছেন তার প্রশংসা করতে হয়। সামাজিক উদ্যোগের মধ্যে সিবি হাসপাতাল। সাতক্ষীরায় এতবড় সেবা প্রতিষ্ঠান কেউ করার সাহস পায়নি। তাছাড়া তার গড়া সুন্দরবনের বরসা রিসোর্ট দর্শনার্থীদের সুন্দরবন ভ্রমণকে সার্থক করে। চায়না বাংলা শপিং সাতক্ষীরা জেলাকে নতুনভাবে চিনিয়ে দেয়। অল্প বয়সে এত বড় বড় প্রতিষ্ঠান করে সে অনেকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। তার কাছে বিপদ-আপদ, সুবিধা-অসুবিধা, দায়-বিদায় জানিয়ে কেউ বৃথা যায়নি। তার বিষয়ে বললে শেষ হবে না। সর্বপরি একেএম আনিছুর রহমান একজন উদার ও সাদা মনের মানুষ ছিল এটাই বলতে পারি।

মুন্সিপাড়া এরিয়েন্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আইনুল ইসলাম নান্টা বলেন, ‘একেএম আনিছুর রহমান আমাদের ক্লাবের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার মৃত্যুতে জেলার ক্রীড়াঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তার মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমরা এরিয়েন্স ক্লাবের পক্ষ থেকে তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সম বেদানা জানাই এবং তার সকল প্রতিষ্ঠানের সমৃদ্ধি কামনা করি’।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version