ফারুক হোসাইন রাজ, কলারোয়া: জলাবদ্ধতায় ডুবান্ত জমি এখন এক ফসলী ইরি ধান আবাদের অপেক্ষায় দীর্ঘদিন যাবৎ অনাবাদি নেই বরং পানিতে টইটুম্বুর সেই জমিতে মৌসুমে পানিফল যার আঞ্চলিক নাম পনিসিঙ্গাড়া ফল চাষ করায় হাঁসি ফুটেছে সাতক্ষীরা কলারোয়ার গোপীনাথপুর এলাকার কৃষি পরিবারে। রবিবার (২১ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ৭টার দিকে কলারোয়া পৌর সদরের গোপীনাথপুরের পানি ফলের চাষ দেখতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পারহাউজ এলাকা সংলগ্ন যশোর – সাতক্ষীরা মহাসড়কের দুই ধারে গোলাকৃতির ছোট সবুজ পাতার গাছটির শেকড় লতার মত নিচে থাকলেও পানির ওপরে ভেসে থাকে পাতাগুলো, অনেকটা কচুড়িপানার মতো গাছে ঢেকে রয়েছে জলাবদ্ধতার বিস্তীর্ণ জায়গা গুলো। দুই জাতের লাল ও সবুজ রঙের ফলের দু’পাশে দুইটি শিং-এর মত লম্বা কাঁটা থাকে, তাই আকৃতিগত কারণে স্থানীয়ভাবে এটি পানি সিংড়া নামেও বেশ পরিচিত।
খোসা ছাড়ালে বেরিয়ে আসে এর সাদা অংশটি, যেটি বেশ মিষ্টি ও সুস্বাদু। চাষিদের মধ্যে অনেকে বাঁশের খুঁটি পুতে সীমানা করে পরিচর্যা করছে ৩ থেকে সাড়ে ৪ ফুট পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে পানির উপর নিজের চাষ করা পানিফল গাছ আবার অনেকে দলবদ্ধ ভাবে খাওয়ার উপযোগী পানিফল নেওয়া যাবে এমন ভাবে প্রতিটি গাছ পানি থেকে উঁচু করে ফল সংগ্রহে ব্যাস্ত সময় পার করছেন। ফল সংগ্রহকারীদের মধ্যে বেশিরভাগ অদম্য নারী তারা দিনমজুর দিয়ে ক্ষেত থেকে পাত্রে ফল সংগ্রহ করে উচু জায়গায় নিয়ে পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ফল খাওয়ার উপযোগী করে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পানিফল ক্রয় করতে আসা পাইকারি ও খুচরা ক্রেতাদের মাঝে বিক্রি ও বাজারজাতের জন্য প্রস্তুত করছে।
এ অঞ্চলের চাষিরা গাছে ফল আসার ১২দিন পর থেকে প্রতিদিন সকাল ৬টা হতে বেলা ১১টা পর্যন্ত পানিফল ক্ষেত থেকে তুলতে দলবদ্ধভাবে এমন ব্যাস্ত সময় পার করেন যেন সকালের খাদ্যে খাওয়ার সময়টাও তাদের মধ্যে নেই মনে করে দিলেও যেন বিরক্তির ভাব আসে। গোপীনাথপুর এলাকার পানিফল চাষি শহীদ গাজী দৈনিক সুপ্রভাত সাতক্ষীরা’কে জানায়, জলাবদ্ধতার কারণে ইরি ধান ছাড়া দ্বিতীয় কোন ফসল এ অঞ্চলের কৃষকদের ঘরে উঠতোনা জমি থাকতেও একসময় চাষাবাদ করা ছেড়ে দিয়ে অনেকে কঠিন দুরবস্থার মধ্যে পরিবার নিয়ে জীবন যাপন করেছেন। কিন্তু বিগত ২০০৮ সালে আজিবর নামে এক কৃষক পার্শ্ববর্তী কালিগঞ্জ উপজেলা থেকে বীজ ফল এনে অপ্রচলিত এই ফলের চাষ শুরু করেন।
সেই থেকে ডোবা জমির পানিতে সম্ভাবনাময় সুস্বাদু পানিসিঙ্গাড়া ফল অতি অল্প খরচে চাষ করে অল্প সময় ৬মাসেই ৩ ফসলি জমির থেকেও বেশি অর্থ রোজগার করে সবলম্বি এ অঞ্চলের চাষিরা। পানিফল চাষ অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় আগ্রহ বেড়ে ২৬জন বানিজ্যিক ও ক্ষুদ্র মিলিয়ে প্রায় শতাধিক কৃষক বর্তমানে ১৫০ বিঘার মত জমিতে মৌসুম ভিত্তিক আবাদ করছে পানিফল। গোপিনাথপুর এলাকার পানিফল চাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, বাংলা জৈষ্ঠ্যমাসের শেষ দিকে গোপীনাথপুর এলাকার কৃষকেরা ইরি ধান কেটে গোলা ৯০ভাগ গোলা ভরতে পারে না এর মধ্যেই জমিতে পানি জমতে থাকে এ জন্য অন্য কোন ফসল না হওয়ায় পানিফল চাষ করে সকল অভাব মোচন হয়েছে। আষাড় মাস থেকে জলবদ্ধ জমিতে পানিফল চাষের বিজতলা প্রস্তুত ও রোপন শুরু হয় তিন মাস পর আশ্বিন মাসের শুরুতে ক্ষেতভরা গাছে ফুল আসে রোপণের ১১০ দিন পর থেকে ফল ভাঙ্গা যায় পৌষ মাস পর্যন্ত। এক বিঘা জমি লিজ বা হারি নিয়ে জমি প্রস্তুতে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয় নিজের জমি হলে খরচ কম হয়।
গাছে পচন খেয়াল করতে হয় এছাড়া পরিচর্যায় বাড়ত খরচ নেই, ফল সংগ্রহে সকাল ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত পুরুষদের মজুরি ২৫০ টাকা ও মহিলাদের ১৮০টাকা দিয়ে (২০ কাঠায় ১ বিঘা) কাঠাপ্রতি ১০ দিন পর পর ১ মনের বেশি ফল গাছ থেকে সংগ্রহ করে যশোর, ঝিকরগাছা, নাভারন, বাঁগআঁচড়া, সাতমাইল, কলারোয়া, সাতক্ষীরা, আঠারো মাইলসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পাইকারি ব্যাবসায়ীদের কাছে ১০টাকা কেজি দরে মনপ্রতি ৪০০টাকাই বিক্রি করা হয়। একজন ফল ভাঙ্গা শ্রমিক নিদ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ২ মন ফল ভাঙতে পারেন। সাম্প্রতিক পাইকারি ক্রেতা নিয়মিত না পাওয়াতে রাস্তার ধারে টেবিলের উপর রেখে অল্প দামে ফল বিক্রি করে অনেক লোকশানের মধ্যে পড়তে হচ্ছে চাষিদের। অন্য জেলা বা বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে কৃষি অধিদপ্তর থেকে কোন ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যায় না তবে কৃষি অধিদপ্তর থেকে সহযোগিতা পেলে বানিজ্যিক ভাবে চাষাবাদ করে কৃষকেরা আরও লাভবান হবে।
পানিফল ব্যাবসায়ী আব্দুল গফুর জানায়, শুরুতে ৬০ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হলেও এখন পাইকারি ১০টাকা কেজি দরে ক্রয় করে রাস্তার ধারে টেবিলের উপর রেখে ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে প্রতিদিন সাড়ে ৩মন পর্যন্ত খুচরা বিক্রি করেন তিনি। গাছে ফল থাকার ৬ মাসে খুচরা বিক্রি করে খরচ বাদে ৬০ হাজার টাকার মত লাভ থাকে। বর্তমানে উপজেলার গোপিনাথপুর, তেলকাড়া, শুভঙ্করকাটি, গোয়ালচাতর, কুশোডাঙ্গা, মুরারীকাটি ও কেঁড়াগাছি সহ বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে পানিফল চাষ হচ্ছে।
ব্রজবাকসা ইসলামপুর দাখিল মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছাত্র শামিম হোসেন জানায়, পানিফল খাওয়ার নিয়ম ও স্বাদ আগে বুঝতামনা কিন্তু খাওয়ার পরে দেখলাম এটা অত্যন্ত সুস্বাদু পুষ্টি সম্পন্ন ফল রান্না করেও খাওয়া যায়। মাত্র ২০ টাকায় ১কেজিতে প্রায় ৪০ থেকে ৫০পিছ সুস্বাদু পানিফল হয় যা পরিবারের সকলে কাঁচা খেতে পারি। তবে এ ফলের স্বাধ যাতে সারা দেশের মানুষ পেতে পারে পাশাপাশি চাষিদের আরও সাবলম্বি করতে কলারোয়া থেকে অন্য জেলায় রপ্তানির জন্য সরকারের কৃষি বিভাগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার আহŸান জানান তিনি।
চাষি ফারুক হোসেন বলেন, পাঁচ বিঘা জমিতে পানিফল চাষ করে প্রতিদিন মন প্রতি ফল পাইকারী ৪০০ টাকা ও খুচরা ৭০০ টাকা মন দরে বিক্রি করেন। অনেক সময় পাইকারি ক্রেতা না পাওয়ায় রাস্তার ধারে ২৪ জনের মত চাষিরা বসে অল্প দামে বিক্রি করেন। পাইকারি ক্রেতা পেলে প্রতিদিন এক বিঘা জমি থেকে ২০মন ফল বিক্রি করা যায় যার বাজার মূল্য প্রায় ৮ হাজার টাকা। ১বিঘা জমি থেকে ১০ দিন পর পর মাসে ৩ বার ফল ভাঙ্গা যায় প্রতিবারে ২০ মন করে এক মাসে ৬০ মন উৎপাদিত পানি সিঙ্গাড়া ফল ২৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। ৫ বিঘা জমি থেকে ৩মাসে প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ টাকার মত ফল বিক্রি হয় খরচ বাদে প্রায় দেড় লক্ষ টাকার মত লাভ থাকে যা অন্য ফসলের থেকে লাভজনক এ জন্য পানিফল চাষে আগ্রহ বেড়েছে অনেকের। কলারোয়া থেকে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার মন উৎপাদিত পানিফল জেলার চাহিদা মিটিয়ে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলাতে বিক্রি হয়। বাংলা ভাদ্র থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত চাষীরা পানিফলের আবাদ করেন। আর বেচাকেনা চলে বাংলা কার্তিক, অগ্রহায়ণ থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত। তবে পানিফল চাষ ও রপ্তানির ক্ষেত্রে কৃষি অধিদপ্তর থেকে সহযোগিতা পেলে চাষিরা আরও আগ্রহ নিয়ে পতিত জলাবদ্ধ জমিতে আবাদ করে লাভবান হতে পারবে।
এ ব্যাপারে কলারোয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রফিকুল ইসলাম জানায়, পানিফল চাষিদের জন্য সরকারি কোন বরাদ্দ নেই শুধুমাত্র পরামর্শ দেওয়া হয়। চলতি মৌসুমে উপজেলার ৩৭ হেক্টর জমিতে পুষ্টিকর ও সুস্বাদু পানি ফলের চাষ হয়েছে। মৌসুমি ফল হলেও পানিফলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এতে অনেক পতিত অগভীর জলাবদ্ধ জমির ব্যবহার যেমন নিশ্চিত হচ্ছে, তেমনি কর্মসংস্থানও হচ্ছে। অল্প খরচে অধিক ফলন হওয়ায় লাভবান হচ্ছে চাষীরা, উপজেলাতে শতাধিক পানিফল ব্যাবসায়ী ও ২শতাধিক ক্ষুদ্র মাঝারি ও বানিজ্যিক চাষি রয়েছে দেশের অন্যান্য জেলায় পানিফলের চাষাবাদ হয় না।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ নুরুল ইসলাম জানায়, জেলাতে প্রায় ১৩৭ হেক্টর জমিতে পানিফল চাষ হচ্ছে। এ ফলে সরকারি নির্দিষ্ট কোন বরাদ্দ নেই তবে স্থানীয় উপসহকারী কৃষি অফিসারগন সার্বক্ষণিক পানিফল চাষিদের পরামর্শ দিচ্ছেন। মৌসুমে পানিফলকে ঘিরে শতাধিক নারী পুরুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, পতিত জলাবদ্ধ জমি ফেলে না রেখে পানিফল চাষের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে চাষিদের। এ চাষাবাদ অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় চাষের ক্ষেত্র বাড়ছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে কৃষকরা আগ্রহ প্রকাশ করলে সার্বিক সহায়তা করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।