অক্টোবর ৩১, ২০২১
সংরক্ষণ অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে দেবহাটার জমিদার আমলের বিভিন্ন নিদর্শন
মীর খায়রুল আলম: আয়তনে সাতক্ষীরার ছোট্ট উপজেলা দেবহাটা। যার অবস্থান ভারতের চব্বিশ পরগনার সীমান্ত-সংলগ্ন। ১৯৪৭’র পূর্ববতী রাজনৈতিক-সামাজিক ও ধর্মীয় পটভূমি অবিভক্ত ভারতবর্ষের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। আর সাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ-ভারতের জমিদারি প্রথার অতীত-ঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্য এ উপজেলাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছে। ১৭৯৩ ব্রিটিশ বড়লাট লর্ড কর্নওয়ালিস ভারতে জমিদারি প্রথা চালু করেন। এসময় থেকেই সরকারকে নির্দিষ্ট কর দিয়ে জমির মালিক হয়ে যান জমিদাররা। তারা পল্লী এলাকায় এসে প্রজা-সাধারনদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে থাকেন। এজন্য অত্যাচার-নির্যতনও চলে নিরীহ প্রজাদের উপর। প্রতিষ্ঠিত হয় জমিদার কাছারিবাড়ী বিগত কয়েক বছরের ভারতের ইতিহাস থেকে আমরা এসব বিষয়ের পরিচয় পেয়ে থাকি। সাহিত্য-সাংস্কৃতির স্বচ্ছ এই জমিদারি প্রথার বার্নিল চালচিত্রের সন্ধান পাই। দেবহাটার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এখানেও বেশ কয়েক জন জমিদারের বসতি স্থাপন করেছিলেন। তার মধ্যে দেবহাটার সদর ইউনিয়নের দুই-তিনটি গ্রামে তাদের অবস্থান ছিল। দেবহাটা সদর, সুশীলগাঁতী, টাউনশ্রীপুর গ্রামে তারা এসেছিলেন কলকাতা থেকে। এরপর এখানে এসে স্থানীয় ভাবে বসবাস শুরু করেন। গড়ে তোলান সুরম্য অট্টালিকা-সাদৃশ্য বাসগ্রহ, ঘাট বাঁধানো পুকুর, সুউচ্চ প্রাচীর, বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়, মিউনিসিপ্যালটি এমন কি সখের থিয়োটারও। ৪৭’র পরবর্তী দেশ বিভাগের পর তারা প্রায় সবাই ফিরে যান চব্বিশ পারগনার নানা স্থানে। তাই তাদের পরবর্তী প্রজন্মের ইতিহাস অনেকের কাছে অজানা রয়ে গেছে নানা কারণে। এখানকার জমিদারদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষন করা সম্ভব হয়নি। স্মৃতিকথা ও যাচাই-বাছাই এর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের সম্বনয়ে দেবহাটার জমিদারদের মধ্যে অতি সংক্ষেপে পরিচয় তুলে ধরা হল: ফণীভূষণ মন্ডলের আবাস স্থাল ছিল সদর ইউনিয়নে। তার পিতার নাম ছিল বিপিন বিহারী মন্ডল। তিনি গোটা দেবহাটা উপজেলার স্বনামধন্য জমিদার হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। তার উদারতা, মানবতাবোধ, প্রজা-হিতৈষী কর্মকান্ড সর্বজনবিদিত। দেবহাটা ছাড়াও বিভাগ-পূর্ববর্তী সময়ে চব্বিশ পারগনার হাসনাবাদ থানার পাথরঘাটা ও কালীগঞ্জ উপজেলার কোন কোন অঞ্চল তার জমিদারির আওতাভুক্ত ছিল। তার আর্থিক অনুকুল্যে ও সার্বিক পৃষ্টপোষকতায় দেবহাটার ঐতিহ্যবাহী হাইস্কুল গড়ে ওঠে। উচ্চ বংশীয় টাউনশ্রীপুর জমিদারদের বিরূপ মনোভাবে ও সহযোগিতার কারণে স্কুলটি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিবন্ধনের সনদ পায়নি। বাধ্য হয়ে তাকে বেনারশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে নিবন্ধন আনতে হয় ১৯৪৭ সালে। দেবহাটা থানা ও স্কুলের উত্তর পার্শ্বে দাতব্য চিকিৎসালয়টি তার নিজ হাতে নির্মিত। দেবহাটার হাই স্কুলের পূর্ব পার্শ্বে সংলগ্ন তার বিশাল বাসগৃহটি তার স্মৃতি বহন করেছে। তিনি চিন্তায়, দানে-দাক্ষিন্যে, মর্মেও মনস্বি^তায় তার মতো জমিদার পুরুষ সে যুগে বিরল ছিল। টাউনশ্রীপুরের খ্যাতিমান জমিদার উপজেলার সদর ইউনিয়নে শরচ্চন্দ্র। তিনি অত্র এলাকাটিতে উন্নয়নের জোয়ার এনছিলেন। তার এলাকাটি তৎকালীন ব্রিটিশ শাসন আমলে সাত জমিদারের বসতি ও বাংলাদেশের প্রথম পৌরসভা টাউনশ্রীপুর। তার সবচেয় বড় অবদান শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া। সে সময়ে উপমহাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ভারতের টাকিতে যেতে হত। ১৯৩৯ সালে দিকে নৌকা যোগে যাওয়ার পথে নদী পথে দূর্ঘটনায় প্রায় ১৫/১৬ জনেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রীর মৃত্যু হয়। এতে এলাকা জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। যার কারণে শরচ্চন্দ্র নিজ উদ্যোগে উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপনের সিন্ধান্ত নেন। তার উদ্যোগে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় এবং তারই নামে নামকরণ করা হয়। গ্রামে ১৯১৬ সালে কোলকাতা হাই কোর্টের এ্যড বাবু শরচ্চন্দ্র রায় চৌধূরীর হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় টাউন শ্রীপুর শরচ্চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়। তাছাড়া ১৯২০ সালে খুলনার অঞ্চলে ভয়াবাহ বন্যার কবলে পড়লে তিনি মানবতার ডাক দেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের সঙ্গে নৌকায় করে ত্রাণ, কাপড় নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। সে সময়ের বন্যা সাময়িক বন্ধ হওয়ার পর তিনি সাময়িক সাহায্য করে ক্ষ্যান্ত না হয়ে ভবিষতে আর যেনো এমন পরিস্থিতর সম্মুখিন হতে না হয় সেজন্য তারই চেষ্টায় শযঁষহধ উরংঃৎরপঃ জব-ড়ৎমধরংধরড়হ ঝপযবসব গঠন করন। তিনি পেশায় আইনজীবী হলেও মানবসেবায় অবদান কোন অংশে কম ছিল না। তাছাড়া টাউনশ্রীপুর, সুশীলগাঁতী, এলাকায় যে সমস্ত জমিদারের বাস ছিল তারা হলেন দেবেন্দ্রনাথ গুহ বর্মন, রবীন্দ্রনাথ গুহ বর্মন তেজেন্দ্রনাথ গুহ বর্মন, নরেন্দ্রনাথ রায় সরকার, সুরেন্দ্রনাথ রায় সরকার, অমূল্য রায় সরকার, ফনিমোহন রায় সরকার, লক্ষী নারায়ন রায় চৌধুরী, পাঁচু গোপাল রায় চৌধুরী, বঙ্কিম কুমার রায় চৌধুরী, নির্মল রায় চৌধুরী বৈদ্যনাথ সরদার(এম.এ), অরবিন্দ সরদার(আই.এ), অহিধর ঘোষ। বর্তমান সময়ে ততকালীন সময়ের বসবাসকৃত বিশাল অট্টলিকা গুলো স্থানীয়দের দখলে। তাছাড়া তাদের বসবাসের সুবিধায় ভেঙ্গে নতুন নতুন ভবন নির্মান করা হচ্ছে। তবে, সুধীসমাজের মনে করেন যদি পুরানোদিনের ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা হলে দেবহাটা পর্যাটন শিল্পের সম্ভবনা রুপলাভ করতে পারে। স্থানীয় বাসিন্দা গোপাল কুমার (৩০) জানান, জমিদার আমল শেষ হলেও এখনো তাদের কিছু নিদর্শণ রয়ে গেছে। সে সময় শুনেছি জমদারগন এলাকার রাজত্ব করত। কিন্তু তারা আর কেউ নেই বাংলাদেশে। তাদের সে সব ভবনগুলো আজ সংরক্ষণ অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এগুলো যদি সংরক্ষণ করা যেত তাহলে ঐতিহ্যটি আমাদের পরবতী প্রজন্ম দেখতে পারত। সাথে বিভিন্ন এলাকার মানুষ দেখতে আসত। দেবহাটা সদর ইউপি চেয়ারম্যান আবু বকর গাজী জানান, বাংলাদেশের ২য় পৌরসভা দেবহাটার টাউনশ্রীপুর। যা খুলনা বিভাগের প্রথম। কিন্তু সেই মিউনিসিপ্যাল অফিসটি পরবর্তীতে তুলে নেওয়া হয়। জমিদারি এলাকা হওয়ায় দেবহাটার টাউনশ্রীপুরকে বেশি প্রধান্য দেওয়া হত। পরবর্তীতে আমাদের দাবি ছিল পুনরায় পৌরসভার কিন্তু সেটি ফিরে আসেনি। সেই সাথে জমিদারি আমলের স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের দাবি জানানো হলেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। ধীরে ধীরে সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। 8,971,598 total views, 3,280 views today |
|
|
|