শেখ শাওন আহমেদ সোহাগ: জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে বিশ্বজুড়ে। এর ফলে যেসব দেশ সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। আর এ দেশের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা রয়েছে চরম ঝুঁকির মধ্যে।
প্রতিবছর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগের সম্মুখিন হতে হচ্ছে এ জেলার মানুষের। ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, লবণাক্ততা, অতিবৃষ্টি, জলাবন্ধতা,নদীভাঙন, নদীতে পানির জোয়ার বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ অ লের জনগোষ্ঠিকে নানাভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আর এসব দুর্যোগে শিশু ও নারীরা সবচাইতে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। প্রান্তিক এলাকার নারী ও শিশুরা বিভিন্ন রোগের কবলে পড়ছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট নেতিবাচক প্রভাবের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম অরক্ষিত দেশের একটি এবং এর উপকূলীয় অ ল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। জার্মান ওয়াচ গেøাবাল-এর জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিআরআই-২০১৭) অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ শীর্ষ দশের একটি দেশ। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তঃসরকারী প্যানেল (আইপিসিসি) ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, বাংলাদেশ ২০৫০ সালের মধ্যে তার ১৭ শতাংশ জমি এবং তার খাদ্য উৎপাদনের ৩০ শতাংশ ক্ষতি হারাতে চলেছে।
আরও এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৫৮ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত উপকূলীয় অ লে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার প্রভাবে প্রায় ১ মিলিয়ন হেক্টর জমি লবণাক্ত হয়ে গেছে। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায় উপকূলীয় এলাকায় আবাদযোগ্য জমির উর্বরতা মারাত্বকভাবে হ্রাস পেয়েছিলো। এর ফলে ফসলের উৎপাদন ৮০% কমে গিয়েছিলো এবং চিংড়ির উৎপাদন হেক্টর প্রতি ২,৩০৫ কেজি থেকে ৮ কেজিতে নেমে গিয়েছিলো। বর্তমান বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ছাড়াও পরিবেশগত, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফলস্বরুপ নারীদের জীবিকা ওই সব অ লে দ্রæত অবনতি ঘটছে।
গত কয়েক বছর যাবত একের পর এক বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সাতক্ষীরার মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। যার ফলে এখানকার অর্থনীতি আজ হুমকির মুখে। নদী গর্ভে বাপ-দাদার ভিটে-মাটি বিলিন হয়ে যাওয়ায় অনেকে নিজ জন্মস্থান ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে অন্য জায়গায়।
বর্তমানে জেলার মধ্যে সবচাইতে দূর অবস্থার মধ্যে রয়েছে আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়ন। এই অ লে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। ৫ টি পয়েন্ট দিয়ে নদীর জোয়ারের পানি বাঁধ ওভার ফ্লো হয়ে ভেঙে প্লাবিত হয়েছে ১০ টি গ্রাম। কয়েক হাজার মানুষ মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
প্রথমে স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা চালায়। পরে ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৯ মাসের প্রেচেষ্টায় কেয়ার নির্মাণের মাধ্যমে জোয়ার ভাটা মুক্ত হয়।
তবে দুঃখের বিষয় এর কয়েক মাস পর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। ওই সময়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৈরি করা কেয়ার আবারও ওভার ফ্লো হয়।
সেই থেকে জোয়ার ভাটার সাথে বসবাস করছে হাজারো মানুষ। স্থায়ী ভেড়িবাঁধ নির্মাণে আজও তেমন কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও ইয়াসের ফলে লোকালয় পানি ঢুকে বসতবাড়ি হারিয়ে দুই বছর যাবত প্রায় শতাধিক পরিবার বাঁধের উপর বসবাস করে আসছে।
গত কয়েক দিন আগে প্রতাপনগরের একটি মসজিদ খোলপেটুয়ার জোয়ার-ভাটার তোড়ে ভেঙে পড়েছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ঘটনা ঘটেই চলেছে এই ইউনিয়নে।
জেলার কালিগঞ্জের উপকূলীয় মথুরেশপুর ইউনিয়নের হাড়দ্দহা গ্রামের আব্দুস সবুর, সজীব হোসেন, শের আলী, হাসানুর রহমান জানান, ঘুর্ণিঝড় ইয়াসে কালিন্দী নদীর বাঁধ ভেঙে যেয়ে তলিয়ে যায় তাদের বাড়িঘর, ফসলি জমিসহ মৎস্যঘের। এর ফলে তারা আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে জানান।
তারা আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কয়েক মাস পর হঠাৎ একদিন রাতে ৫/৬ মিনিটের একটি ঝড়ে তাদের হাড়দ্দহা এলাকার প্রায় ২০ টি বাড়ি লন্ড-ভন্ড হয়ে যায়। এছাড়া কয়েকবার অতিবৃষ্টির কারণে তাদের ফসলি জমিসহ মৎস্যঘের ডুবে যাওয়ায় তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে বলে জানিয়েছে।
শ্যামনগর উপজেলার চুনা এলাকার পারভীন আক্তার, জাকারিয়া, জবেদ আলী, আজিজুর রহমান, গাবুরা এলাকার মতিয়ার রহমান, ইশারাত আলী ও মনিরা পারভীন জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে তাদের বাড়ি-ঘর ভেঙে যায়। ওই সময়ে তারা খোলা আকাশের নিচে বসবাস করতো। প্রায় প্রতিবছর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
জলবায়ু নিয়ে কাজ করা বিন্দু নারী উন্নয়ন সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক জান্নাতুল মাওয়া বলেন, সব ধরণের দুর্যোগেই নারী, কিশোরী, গর্ভবতী, বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধীরা অধিক ঝুঁকির সম্মুখিন হয়। ঘরহারা নারী ও কিশোরীরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করে এবং যৌন হয়রানির স্বীকার হয়। বয়স্ক, গর্ভবতী এবং প্রতিবন্ধীদের চলাচলের সমস্যা দেখা যায়। তার পাশাপাশি সকলের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ে। শিশুরা নানান ধরণের সংকটে পড়ে। নারী শিশুরা বাল্য বিবাহের শিকার হয়।
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় জেলা প্রশাসক হুমায়ুন করিব বলেন, এনিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর জোয়ার বৃদ্ধির ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি যাতে প্রবেশ না করে, সেজন্য বাঁধগুলো টেকসই করার চেষ্টা করছি।
জলাবন্ধতা দূরসহ আরও যে সমস্যা রয়েছে সেগুলোকে রোধ করার জন্য জেলা প্রশাসক অফিস কাজ করছে বলে জানান তিনি।