শাওন আহম্মেদ সোহাগ, কালিগঞ্জ: তালাক দেওয়ায় প্রতিশোধ নিতে দরজায় ছিটকানি লাগিয়ে ঘরে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে শ্বাশুড়ি ও সন্তানকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। শুক্রবার দিবাগত রাত পৌনে দু’টোর দিকে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার নলতা ইউনিয়নের কাজলা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। মুমুর্ষ অবস্থায় নানী ফতেমা খাতুন (৪৫) ও নাতি ইছাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র নাজমুলকে(৮) ঢাকা মেডিকেলের শেখ হাসিনা বার্ণ ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে।
কালীগঞ্জ উপজেলার কাজলা গ্রামের আব্দুস সাত্তার সরদার জানান, তার মেয়ে নাজমা খাতুনের সঙ্গে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার চৌবাড়িয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে (ভোমরা বন্দরের শ্রমিক) আল আমিনের বিয়ে হয়। নাজমুল নামে তাদের আট বছরের একটি ছেলে আছে।
তার মেয়ে নাজমা শ্বশুর বাড়ির নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গত বছরের এপ্রিল মাসে তার (নাজমা) ভাই শরিফুলের সঙ্গে ভারতের তামিলনাড়–তে কাজ করতে যায়। তিন মাস পর ফিরে এলে আল আমিন তাকে তালাক দিয়ে ছেলে নাজমুলসহ নামজামে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। ৮ বছরের সন্তান নাজমুলকে নানীর কাছে রেখে স্থানীয় ইছাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয়। স্বামীর সাথে ছাড়া ছাড়ি হয়ে যাওয়ায় নাজমা গত বছরের আগষ্ট মাসে তার ভাই শরিফুলের সঙ্গে আবারো ভারতের তামিলনাড়–তে কাজ করতে যায়।
এসময় মোবাইল ফোনে নাজমার সাথে তার খালাত ভাই দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া গ্রামে (বর্তমানে কালীগঞ্জের ভাঙানমারির বাসিন্দা) সবুজ গাতিদার তাকে বিয়ের জন্য বিরক্ত করতো। এ অবস্থায় গত বছরের ডিসেম্বর মাসে নাজমা ভারত থেকে বাড়ি ফিরে আসে।
আব্দুস সাত্তার আরো জানান, একপর্যায়ে চলতি বছরের মে মাসের শেষের দিকে সবুজ গাতিদারের বাবা নবাব আলী গাতিদার ও মা মর্জিনা খাতুন তাদের বাড়িতে এসে ২০ হাজার টাকা কাবিনে সবুজের সাথে নামজার বিয়ে কারিয়ে পুত্রবধু করে বাড়িতে নিয়ে যায়। এর এক সপ্তাহ পর নাজমাকে নিয়ে রাজবাড়িতে একটি কারখানায় কাজে লাগিয়ে দেয় সবুজ গাতিদার। সেখানে মনোমালিন্য সৃষ্টি হলে সবুজ নাজমাকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। জীবন বাঁচাতে রাজবাড়ি থেকে নাজমা পালিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
আগষ্ট মাসের শেষের দিকে নাজমা সবুজকে তালাক দেয়। এত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে স্বামী সবুজ গাতিদার। এরই মধ্যে নিজের মতো বাঁচতে নাজমা কালিগঞ্জের নলতা এলাকার এক ব্যাক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে সৌদি আরবে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ভাষা শিক্ষার জন্য গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় যায়। ওই ব্যাচে তার প্রশিক্ষণ নেওয়ার সূযোগ না পাওয়ায় সেখানেই অবস্থান করছে নাজমা। গত ২ অক্টোবর থেকে নাজমার ভাষা শিক্ষার প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার কথা।
আব্দুস সাত্তার সরদার আরো বলেন, তিনি কাজলা গ্রামের আরিফ আহম্মেদ এর মাছের ঘেরে নৈশপ্রহরী হিসেবে কাজ করেন। তার মেয়ে নাজমা স্বামী সবুজ গাতিদারকে তালাক দেওয়ার পর আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এরই অংশ হিসেবে সবুজ ও তার পরিবারের সদস্যরা শুক্রবার দিবাগত রাত পৌনে দ’ুটোর দিকে তাদের বাড়ির দরজায় বাইরে থেকে ছিকল তুলে দিয়ে জানালা দিয়ে পেট্রোল ছিটিয়ে একটি লাঠির মাথায় কাপড় জড়িয়ে তাতে আগুণ লাগিয়ে ঘরের মধ্যে ছুঁড়ে দেয়। ঘরের মধ্যে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলার একপর্যায়ে তার স্ত্রী (নাজমার মা) ফাতেমা ও নাতি নাজমুল ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে। বাইরের দিক থেকে দরজায় ছিকল লাগিয়ে দেওয়ায় তারা আর বের হতে পারেনি।
কাজলা গ্রামের আব্দুল খালেক সরদার, সোহেল সরদার, আবু মুছা, রুবেল বিশ্বাস, আরিজুল সরদার, সাইফুল সরদার জানান,আগুন জ্বলা অবস্থায় চিৎকার শুনে তারা এসে ফাতেমা ও নাজমুলকে উদ্ধার করে প্রথমে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও পরে খুলনা ৫০০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করান। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাদেরকে শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শেখ হাসিনা বার্ণ ইউনিটের ৮ ও ১১ নং শয্যায় ভর্তি করা হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটের কর্তর্যরত চিকিৎসক ডাঃ তৌফিক আহম্মেদ বলেন, নাজমুলের শরীরের ৯৫ শতাংশ ও ফাতেমার ৭৫ শতাংশ পুড়ে গেছে পেট্রোলের আগুণে। তাদেরকে বাঁচানো কঠিণ হলেও তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গোলাম মোস্তফা জানান, এ ঘটনায় আব্দুস সাত্তার সরদার বাদি হয়ে সবুজ গাতিদার, তার ভাই সুমন গাতিদার, তাদের বাবা নবাব আলী গাতিদার, মা মর্জিনা খাতুনের নাম উল্লে¬খসহ অজ্ঞাতনামা তিনজনের বিরুদ্ধে শনিবার থানায় একটি মামলা (নং-৫) দায়ের করেছেন। মামলার প্রধান আসামী সবুজ গাতিদারকে সাতক্ষীরা জজ কোর্ট এলাকার আব্দুল মান্নানের হোটেল থেকে রবিবার দুপুর সোয়া একটার দিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।