শেখ শাওন আহমেদ সোহাগ: কালিগঞ্জের কৃষ্ণনগরে প্রতারণার মহা ফাঁদে ফেলে নামের আগে ডাক্তার লাগিয়ে রেজাউল ইসলাম ও স্ত্রী রিমা আক্তার অসহায় মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। একই অভিযোগ রয়েছে বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের আকরাম হোসাইনের নামেও। কথিত হোমিও চিকিৎসক রেজাউল ইসলাম উপজেলার কৃষ্ণনগর এলাকার সামছুর রহমানের ছেলে ও কবিরাজ আকরাম হোসাইন বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের হোগলা এলাকার মৃত সৈয়দ আলী গাজীর ছেলে।
নামের আগে ডাক্তার লাগানো রেজাউল ইসলাম তার স্ত্রী রিমা আক্তার ও কথিত জ্বীনের বাদশা আকরামের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগের প্রেক্ষিতে অনুসন্ধানে নামে সাংবাদিকদের একটি টিম। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রথমে সাংবাদিকদের একটি টিম হোমিও চিকিৎসক রেজাউল ও তার স্ত্রী রিমা আক্তারের প্রতারণার ফাঁদ ধরার জন্য উপজেলার মৌতলা এলাকার নাসিমা ও ফাতেমা নামের দুই বোনকে রোগি সাজিয়ে পরিচয় গোপন রেখে রেজাউলের বাড়িতে যায়।
সুস্থ সবল দুই বোনকে নিয়ে রেজাউলের বাড়ির সামনে গেলেই দেখা মেলে স্বামী আর স্ত্রীর বিরাট বিরাট সাইনবোর্ড। উভয় সাইনবোর্ডে লেখা কম্পিউটারের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে জার্মানীর ঔষধ দেওয়া হয়।
রেজাউলের বাড়িতে ঢুকার পর প্রথমে একটি গোল ঘরে সবাইকে বসতে দেওয়া হলো। এরপর একজন এসে জানালো ডাক্তার এসেছে। সেই দুইজন নারীকে নিয়ে পরিচয় গোপন রেখে ভেতরে প্রবেশ করলো ১ জন সংবাদকর্মী। কথিত চিকিৎসক রেজাউল চেম্বারে এসে ভিষণ গভীর মনোযোগ সহকারে রোগীকে দেখছে। এরপর হাতে একটি এনালাইজার মেশিন দিয়ে ল্যাপটবের সাহায্যে বললো তাদের নাকি লিভারে সমস্যা। কথাটি শোনার পর সাংবাদিকসহ চিকিৎসা নিতে আসা দুই বোন আৎকে উঠলো।
ওই সময় ডাক্তার মিচকি মিচকি হাসছে আর বলছে সমস্যা নেই আমি এই রোগের চিকিৎসা করে দিলে সব সমাধান হবে যাবে। তবে আমার ভিজিট দিতে হবে ৩০০ টাকা, টেস্ট ১১শ’ টাকা আর ঐষধ ৪ হাজার টাকা।
রেজাউলের এ কথায় রাজি হয়ে গেলো অনুসন্ধানী টিম। একপর্যায়ে সন্দেহের নজরে তাকাতে লাগলো কথিত রেজাউল ইসলাম। বিষয়টি কিছুটা বুঝতে পেরেই রেজাউলের বাবা, মা আর স্ত্রী সাংবাদিকদের ঘিরে ফেলে অশালিন আচারণ আর ভিডিও করতে শুরু করলো। তখন সংবাদকর্মীরা পরিচয় দিলেও তারা আরও উত্তেজিত হয়ে উঠলো। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কর্তাদের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে তারা।
ওই সময়ে সাংবাদিকরা রেজাউলের বক্তব্য নিতে চাইলে বক্তব্য না দিয়ে উল্টো খারাপ আচারণ সহ সাংবাদিকদের চাঁদাবাজি ও দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। পরবর্তীতে রেজাউল ও তার স্ত্রীর দ্বারা প্রতারণার স্বীকার উপজেলার মথুরেশপুর ইউনিয়নের দুদলি গ্রামের আল- আমিন বলেন, আমার স্ত্রী বেশ কিছুদিন যাবত শারীরিক সমস্যায় ভুগতেছিলো। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য রেজাউলের বাড়িতে যাই। ওই সময়ে বিভিন্ন টেস্ট করার নামে আমার কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে মোটা অংকের টাকা।
একই অভিযোগ করেন সাবিনা খাতুন ও শফিকুল ইসলাম নামে দুই ব্যক্তি। তারা বলেন, পেটে ব্যাথা নিরাময়ের জন্য রেজাউল ডাক্তারের বাড়িতে গেলে হাতে একটি ম্যাশিন দেয়। এরপর রেজাউর বলেন, তাদের নাকি লিভারে সমস্যা হয়েছে। চিকিৎসার জন্য তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানান তারা।
এরপর সাংবাদিকরা হাজির হয় বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের হোগলা গ্রামে। সেখানে যেয়ে দেখা যায় প্রতারণার মহা ফাঁদ। হোগলা গ্রামের মৃত সৈয়দ আলী গাজীর ছেলে আকরাম গাজী পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখা পড়া করেছেন। অথচ রাতরাতি বনে গেছে ডাক্তার ও কবিরাজ পদে।
ক্যান্সার, যৌন, সন্তান না হওয়া নারীদের সন্তান দান থেকে শুরু সব ধরণের চিকিৎসা করেন তিনি। সব চাইতে আশ্চার্যজনক কথা হচ্ছে বিভিন্ন বড় বড় রোগের অপারেশন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সার্জারি জ্বীনেরা। এসব প্রতারণা করে রোগিদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আকরাম হাতিয়ে নিয়েছে মোটা অংকের টাকা। যে সব নারীদের সন্তান হয় না তাদেরকে কবিরাজ আকরামের বাড়িতে রেখে চিকিৎসাও নাকি দিয়ে থাকে জ্বীনের মাধ্যমে।
স্থানীয় মহাদেব কুমার, শাহাজান হোসেন, তৌহিদ, জাকির হোসেনসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, আকরাম নিজেকে জ্বীনের বাদশা পরিচয় দিয়ে রাতারাতি ডাক্তার বনে গেছে। জার্মানি,ফরাসি ও চীন থেকে জ্বীনের ডাক্তার এনে বিভিন্ন বড় বড় রোগের অপারেশন করার নামে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে মোটা অংকের টাকা বলে দাবি তাদের।
অভিযুক্ত আকরামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তৈল ও পানি পড়া দিয়ে থাকি। তবে এখন থেকে এসব কাজ আর করবো না।
এদিকে এসব ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শেখ তৈয়েবুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জ্বীনের দ্বারা অপারেশন এসবের কোন ভিত্তি নেই। এছাড়া অনেকে নামের আগে ডাক্তার লিখে চিকিৎসা সেবার নামে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করছে। যেটি খুবি দু:খ জনক। আমি সিভিল সার্জন স্যারের সাথে কথা বলে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় এসব ভূয়া কবিরাজ ও চিকিৎসক নামধারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।