Site icon suprovatsatkhira.com

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম কতটা সামাজিক কতটা সংবাদ বান্ধব?-পলাশ আহসান

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম কতটা সামাজিক কতটা সংবাদ বান্ধব?

পলাশ আহসান

দুটো গল্প বলি। প্রথম গল্পটি মৌলভীবাজারের এক প্রত্যন্ত এলাকা জড়িয়ে। বছর তিনেক আগে প্রথমে ইউটিউবে পরে ফেসবুকে একটা ভিডিও প্রচার হলো। একটি বাচ্চা ছেলেকে একজন স্বাস্থ্যবান বয়স্ক লোক বেদম পেটাচ্ছে। সেখান থেকে নিয়ে ফেসবুকেও প্রচার হচ্ছে ছবিটি। ফেসবুক ছবির নিচে লেখা দেখুন ওমুক এলাকার ওমুক কীভাবে শিশু নির্যাতন করেন। এর পর কমেন্টেসে ওই লোক গালির বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন লোকজন। ছবিতে শুধু শিশুটির কান্না আর শোরগোল শোনা যাচ্ছে। যিনি পেটাচ্ছেন তার মুখ দেখা যাচ্ছ না। শোরগোলের ভাষাও বোঝা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে সহযোগী একটি টেলিভিশন পুরো ছবিটি প্রচার করে দিলো। কে মারছে, কেন মারছে, সব বলেই প্রচার করলো। কিন্তু ওই এলাকার মানুষের কারো কোন বক্তব্য নেই। আমি মৌলভীবাজারের ওই এলাকার খবর নিলাম। যে হোটেলের কথা বলা হচ্ছে এই নামের হোটেল সেখানে আছে।এর মালিকও স্বাস্থ্যবান। কিন্তু এরকম বেধড়ক মারপিট করার মানুষ তিনি নন। তিনি সজ্জন হিসাবে এলাকায় পরিচিত। ধন্দে পড়লাম। আমার বিপোর্টার পাঠালাম এলাকার। তিনি আনলেন মূল খবর। এলাকার লোকজন ছবিটি দেখেছেন। তারাই বলছেন এরকম কোন খবর তারা জানেন না। আর যে হোটেল মালিকের কথা বলা হচ্ছে তিনিও বললেন এই ছবিটিই তাদের এলাকার নয়। তবে এই ছবির কথা জেনেছেন এবং বিব্রত হয়েছেন। এঘটনা নিয়ে আমার আগ্রহ ওই সময় চলে যেতে পারতো।

কিন্তু মনে হলো, ছবি এবং ছবির মানুষেরা বাংলাদেশের। কিন্তু এলাকার লোকজন বলছেন এটি তাদের এলাকার নয়। তাহলে কোন এলাকার? কেউ একজন তাহলে মিথ্যাচার করছে। কেনই বা এই মিথ্যাচার? আমার কাছে বিষয়টা জটিল হয়ে উঠলো ক্রমশ। বাঁচিয়ে দিলেন এক বন্ধু। তিনি বই পড়া আইটি বিশেষজ্ঞ। তাঁর কাছে বিষয়টা জানালাম। তিনি আমার কাছে একবেলা সময় নিলেন। তাঁর পর বললেন ছবিটি প্রথম ইন্টারনেটে আপ করা হয় তামিল নাড়ু থেকে। আর আমার প্রতিনিধি, ততদিনে খুঁজে বের করেছে যে হোটেল মালিকের নামে ছবিটি প্রচার হয়েছিল তিনি এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে বুঝলাম কীভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মিথ্যাচারের হাতিয়ার হয়ে উঠছে। এখনতো প্রকাশ্যেই দেখতে পাই প্রতিপক্ষ দমনের ফ্রি অস্ত্র হিসাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়। এর পরের গল্পটি চাঁদপুরের। এ

কজন ইউপি চেয়ারম্যান দরিদ্র মানুষের সহায়তার চাল সরকারি গুদাম থেকে না তুলে বিক্রি করে দেন। কিন্ত কাগজে কলমে দেখান চাল তুলে বিতরণ করেছেন। গুদামের স্টক মিলিয়ে রিপোর্ট করে দিলেন একজন রিপোর্টার। পরদিন ওই চেয়ারম্যান চাল বিক্রির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন সাংবাদিক তার কাছে টাকা চেয়ে পাননি এজন্যে রিপোর্ট করেছেন। আর যেহেতু চাল তখনো গুদামে ছিলো তাই বিক্রির লোভ সামলে তিনি বলতে পারলেন, খুব শিগগির বিতরণ করবেন। এপর্যন্ত ঠিক ছিলো। কিন্ত পরদিন ওই চেয়ারম্যান সাংবাদিকের বিচার চেয়ে আমরণ অনশন শুরু করলেন। এসময় তাঁর সঙ্গি হলো ফেসবুক লাইভ। কান্নাকাটি করে ভাসিয়ে দিলেন। যথারীতি রিপোর্টার মহা বিব্রত। ভালো মন্দ বিচার তো পরে। তার আগে ফেসবুক বন্ধুরা সাংবাদিকের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করলেন। রিপোর্টার যখন তাঁর কাছে থাকা প্রমাণ বের করলেন, তখন বোঝা গেলো চেয়ারম্যান সাহেব কত ভালো অভিনেতা। আর সাংবাদিকরা বুঝলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অপব্যবহারের কাছে সত্য কত অসহায়। এতো গেলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহারের গল্প। কিন্তু ভালো ব্যবহারের গল্পতো প্রতি দিনের প্রতি মুহূর্তের। কারণ এর ব্যবহার মানুষের যোগাযোগ দিনদিন সহজ করছে। এর কল্যাণে এক মানুষের আরেকজনের থেকে না চাইলে বিচ্ছিন্ন হওয়া কঠিন। এর কল্যাণেই মানুষের জীবন এখন দুই ভাগে বিভক্ত। অ্যাকটুয়াল এবং ভার্টুয়াল। মানুষের অংশ হিসাবে সাংবাদিকরাও এই সুবিধা ভোগ করেন। আর সাংবাদিকতা এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, দুটোরই উদ্দেশ্যে যোগাযোগ হওয়ার কারণে সুবিধাভোগীর তালিকায় শীর্ষে থাকছেন সাংবাদিক।

আমার বলতে দ্বীধা নেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবিধা সাংবাদিকতাকেও গতি দিয়েছে। বহু আলোহীন বিষয়ের ওপর আলো ফেলেছে। বহু অপরাধীর কাছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রীতিমত আতঙ্ক। এত কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলে আসলে বলতে চাইলাম, কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে সাংবাদিকতার একটা অ¤øমধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। অনেকটা দিল্লির লাড্ডুর মত। খেলেও পস্তাতে হবে না খেলেও পস্তাতে হবে। তাই খেয়েই সবাই পস্তাতে চায়। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না। কথা ছিলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সুন্দর নাম। শুনলেই মন ভালো হয়ে যায়। সব শ্রেণি পেশার মানুষ এখানে যুক্ত থাকবেন। দ্রæত সবার মতামত সবাব জানবে। তার পর একটা সুন্দর সিদ্ধান্ত পাবে সমাজের মানুষ। কিন্ত সে কী আর হলো? শত শত খারাপ মানুষ ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহারের পদ্ধতি টা বের করে ফেললো। যেকারনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে বিশ্বাস ব্যাপারটা উঠেই গেলো। যে কারণে ফেসবুককে একটা সাধারণ তথ্য দাতা বা ক্লু ছাড়া কিছুই ভাবতে পারেন না সাংবাদিক। এখান থেকে কোন তথ্য নিয়ে তিন যায়গায় নিশ্চিত করার পদ্ধতি মানতে হয়। এমন কী সূত্র হিসাবেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার খুব দুর্বল।

এতক্ষণ তো বললাম কেতাবি কথাবার্তা। আসলে অনুশীলন টা কী, পাঠক চলুন দেখে আসি। বাংলাদেশে বর্তমানে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা তিন কোটির কাছাকাছি। বাংলাদেশ ফেসবুকের দ্বিতীয় বড় বাজার। মুঠোফোনে এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। যে কারণে মুহূর্তেই মানুষ তথ্য অন্যকে জানিয়ে দিতে পারে। কিন্ত সে তো সাংবাদিক নয়। তাই পদ্ধতিগত ভাবে দিতে পারে না। যে কারণে ভুর মাছ হয়ে যায় লাশ। মশা মারার ধোঁয়া হয়ে ওঠে অগ্নিকাÐ। কিন্তু আমাদের গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত অনেকের আচরণ ফেসবুক গ্রাহকের মত। লেখার শুরুতে বলছিলাম তামিল নাড়ুর ছবি মৌলভীবাজারের ছবি হিসাবে চালিয়ে দেয়ার গল্প। আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আজকের দিনের সাংবাদিকতার একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আপনি পুরোপুরি বাদ দিতে পারবেন না আবার চোখ বন্ধ করে বিশ্বাসও করতে পারবেন না। তবে সাবধান হতে পারবেন। কাজ করতে গিয়ে দেখেছি ঢাকার বাইরে এই সংকট সবচেয়ে বেশি। সাংবাদিক সাহেবের দূর গ্রামের ছবি তথ্যের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে।

সাংবাদিকের মনে রাখা দরকার তিনি যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনুসরণ করেন এটা দুর্বৃত্তরা জানে। সেই দিক থেকে বলতে গেলে এটা সাংবাদিকের জন্যে পাতা ফাঁদ। সত্যের সঙ্গে মিথ্যে মিশিয়ে চটকদার লেখা বা ছবি থাকতেই পারে। প্রথম কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত কোন ছবি ব্যবহার না করা ভালো। যাচাইয়ের পর নিশ্চিত হয়ে তথ্যটি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ছবির ব্যপারে আবারো সাবধান। কারণ ভার্টুয়াল জগতে ছবির তৈরির মিথ্যাচারের হাজারটা ফাঁদ রয়েছে। কার মাথায় কার দেহ, কার পাশে কে থাকলে কার সুবিধা এসব নিশ্চিত হওয়া কী এত সহজ? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলতে আমরা সাধারণত বুঝি ফেসবুক আর ইউটিউব। এর মধ্যে ফেসবুক বেশি ব্যবহৃত। সাংবাদিকের মনে রাখা দরকার ফেসবুকের যে এত অপব্যবহার হতে পারে এটা জাকারবার্গ সাহেব নিজেও জানেন। কিন্তু তিনি পাক্কা ব্যবসায়ী। কোন অপব্যবহারের দায় তিনি কখনো নেবেন না।

আপনার সমাজ সমুদ্রে তলিয়ে গেলেও না। ১৮টি ভাষায় ফেসবুক পরিচালিত হয়। এর মধ্যে একদল জলদস্যুও ভাষাও রয়েছে। কারণ তারা ডাকাতি আর ফেসবুক ছাড়া আর কিছুই করে না। তারা ঠিক ঠাক লাইক কমেন্টস দিতে পারলেই ফেসবুক খুশি। কী তাদের কাজ এনিয়ে জাকারবার্গের মাথা ব্যাথা নেই। একথা বললাম একারণে যে কে কী ষড়যন্ত্র করছে বা কে কত খরাপ ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করছেন তা জেনে কর্তৃপক্ষের কোন লাভ নেই। তারা সব সময় লাইকারদের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। সুতরাং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের চ্যালেঞ্জ সাংবাদিককেই নিতে হবে। তাঁর লেখায় বলায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে মূল ধারার গণমাধ্যমের একটা পরিস্কার বিভক্তি রেখা টানতে পারতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষও যেন এই দুই মাধ্যমের পার্থক্য বুঝতে পারেন সে দায়িত্বও নিতে হবে সাংবাদিককেই। খুব সত্যি কথা হচ্ছে, অপ্রত্যাশিত ভাবে আজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মূল ধারার গণমাধ্যম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এই চ্যলেঞ্জ প্রতিটি সাংবাদিকের। এটি ঠিকঠাক মোকাবেলা না করতে পারলে, সাংবাদিকের অস্তিত্ব সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পলাশ আহসান
যুগ্ম প্রধান বার্তা সম্পাদক, ৭১ টেলিভিশন।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version