করোনা সাম্প্রতিককালে এক বৈশ্বিক মহামারির সৃষ্টি করেছে। সমস্ত পৃথিবীকে অচল করে দিয়েছে চায়নার উহান শহর থেকে ছড়ানো এই ভাইরাস। বিশ্বের তাবদ বিজ্ঞানী ও গবেষকরা এর কার্যকরণ ও প্রতিরোধের উপায় সমূহ জানতে প্রাণপাত করে চলেছেন। ফলস্বরূপ নিত্য নতুন গবেষণালব্ধ ফল আমাদের সামনে আসছে। এই বিষয়ে নতুন সংযোজন হলো দুই বাংলার গবেষকদের যৌথ গবেষণার ফল যা ফুসফুসের বায়ুপথে করোনার গতিবিধি জানতে আমাদের সাহায্য করবে। তাঁদের গবেষণার ফলাফল Physics of Fluids এর বিশেষ সংখ্যা Physics of Fluids এ গৃহীত হয়েছে।
ড. সুভাষ চন্দ্র সাহার নেতৃত্বে তাঁর সহকর্মী বাংলাদেশের অপর তরুণ ড. সাইদুল ইসলাম (ড. সাহার প্রাক্তন পি.এইচ.ডি. ছাত্র), পশ্চিমবঙ্গের ড. অক্ষয় রঞ্জন পাল এবং অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার একদল গবেষক এক যৌথ গবেষণায় দেখিয়েছেন যে করোনার প্রভাবে ডান পাশের ফুসফুস সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
তাঁরা ফুসফুসের সিটি স্ক্যান থেকে 17-generation পর্যন্ত (সাধারণ ফুসফুসে সর্বমোট ২৩ টা generation) প্রস্তুত করা ত্রিমাত্রিক জ্যামিতি কম্পিউটার সিমুলেশন করে দেখিয়েছেন যে করোনা কণা ডান পাশের ফুসফুস সর্বাধিক জমা হয়। তাঁরা আরও দেখিয়েছেন যে প্রায় ৫০% কণা ফুসফুসের আরও গভীরে প্রবেশ করে। প্রধানতঃ নাসা রন্ধ্র ও মুখগহŸরের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এরপর এই ভাইরাস ধীরে ধীরে ফুসফুসের ট্রাকিয়া বাহিত হয়ে আরও ভিতরে প্রবেশ করে। বিজ্ঞানীরা এতদিন ধরে করোনা এই চলনটাকে বোঝার চেষ্টা করছিলেন।
ড. সাহা বলেন ,“এই গবেষণায় আমরা আমাদের দৈনন্দিন কার্যকরণের উপর নির্ভর করে আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসকে তিন ভাগে ভাগ করেছি; সম্পূর্ণ বিশ্রাম, হালকা কার্যক্রম এবং দৌড় অথবা ভারী শারীরিক পরিশ্রম। আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করেছি যে, আমাদের বিশ্রামের সময় করোনা কণা গ্রহণ করলে সেগুলো ফুসফুসের উপরের অংশে বেশী জমা হয়। ভারী শারীরিক পরিশ্রমের সময় অর্থাৎ দ্রæত শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে করোনা কণা ফুসফুসের গভীরে চলে যায়।”
এক প্রশ্নের উত্তরে নিবন্ধনটির প্রধান গবেষক ড. ইসলাম বলেন “এই গবেষণাটিতে ফুসফুসের গায়ে একটি একক বিচ্ছিন্ন করোনা ভাইরাস কণার মিথস্ক্রিয়া দেখানো হয়েছে। যদিও বাস্তবিক পক্ষে ভাইরাস কণা গুলি ড্রপলেট আকারেও থাকতে পারে। আমাদের পরবর্তী গবেষণায় এই ড্রপলেট নিয়ে আমরা কাজ করবো। আর যেহেতু বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য ভাইরাসটি মারাত্মক বলে প্রমাণিত হয়েছে তাই বয়স্ক ব্যক্তিদের ফুসফুসের উপর ভাইরাসটির প্রভাব নিয়ে বিশদ পর্যালোচনা করা হবে।”
ড. সাহা ও ড. ইসলাম, দু’জনেরই বাড়ি বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরায়। বর্তমানে তাঁরা অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভারসিটি অফ টেকনোলজি সিডনী তে অধ্যাপনারত। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসে বাতাসের প্রবাহ আর বিভিন্ন কণার মিথস্ক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। ড. সাহার গবেষণা দল ফুসফুসের সার্ফ্যাক্ট্যান্ট এ প্রেনডিসোলন স্টেরয়েড (Prednisolone steroid) এর কার্যকারিতা ও ওষুধের মাত্রা নিয়েও গবেষণা করছেন। যেটা হাঁপানি, অ্যালার্জি, প্রদাহজনক পরিস্থিতি, স্ব-প্রতিরোধ অক্ষমতা এবং ক্যান্সার সহ অনেক অসুখের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। তাঁদের গবেষণালব্ধ ফলাফল Physical Chemistry, Chemical Physics (PCCP) জার্নাল এ পাঠানো হয়েছে।
এখানে বলে রাখা ভালো যে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও এলসেভিয়ার প্রকাশনা সংস্থার (আইসিএসআর ল্যাব) সমন্বিত জরিপে বিশ্বসেরা ২ শতাংশ বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন ড. সুভাষ চন্দ্র সাহা।
এই গবেষণালব্ধ ফলাফল বর্তমানে ফুসফুসের হাই ডেনসিটি সিটি স্ক্যান (HDCT) ও অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে যাতে ফুসফুসের ক্ষতিগ্রস্ততার হার আগাম নির্ণয়ে সুবিধা হয় ও বহু করোনা আক্রান্ত মানুষের ফুসফুসকে বড় সড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়।
তথ্য সংগ্রহ/অনুলিখন: মোশাররফ হোসেন, বার্তা সম্পাদক, দৈনিক সুপ্রভাত সাতক্ষীরা।