গাজী আল ইমরান, নিজস্ব প্রতিনিধি: সম্প্রতি উপক‚লের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় যে তীব্রতায় তা আঘাত হেনেছে তা সুন্দরবন না থাকলে জানমালের আরও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতো এবং একই সাথে বাঁধের পাশে হয়ে ওঠা বা তৈরি করা সামাজিক বনায়ন না থাকলে বেঁড়িবাধ সহ বিভিন্ন ভাবে আরো বেশি ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল বলে মনে করেন উপক‚লবাসী। উপক‚ল জুড়ে অধিকাংশ বেঁড়িবাধ গুলো টিকিয়ে রেখেছে বাঁধের পাশের বনায়ন। বাঁধ টিকিয়ে রাখতে সরকারি বেসরকারি এবং স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে শত শত মাইল চর বনায়ন।
কিন্তু কিছু মানুষের অতি মুনাফা লাভের আশায় তা আজ ধ্বংসের পথে। জানা যায়, সম্প্রতি জায়কার অর্থায়নে শুরু হয়েছে বেঁড়িবাধ সংস্কার।সংস্কার কাজ হাতে কোদালে নির্দেশনা থাকলেও অতিরিক্ত মুনাফার লোভে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে ভেকু মেশিনের মাধ্যমে। যার ফলে ধ্বংস হচ্ছে চর বনায়নের লক্ষ লক্ষ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। গাছ ধ্বংসের ফলে যেমন ক্ষতি হচ্ছে বাঁধ, একই সাথে হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ। সূত্র মতে জানা যায়, গ্যালাক্সী এসোসিয়েট, আনিতা এন্টারপ্রাইজ এবং মামুন সাহারা কাগজপত্রে কাজ পেলেও বাস্তবে তাদের কোন কর্মকর্তা নেই। শ্যামনগর উপজেলার মোট ১৫ কিঃমিঃ বেঁড়িবাধ ১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
কয়েকটা হাত বদল হয়ে কাজ হচ্ছে মাঠ পর্যায়ে। ঠিকাদার থেকে সাব ঠিকাদার এরপর আবার রয়েছে ভেকু মালিক। একাধিক হাত বদলিয়ে কাজ হচ্ছে ওয়াপদা সংস্কারের। ওয়াপদা সংস্কারে বেঁড়িবাধের পাশ থেকে ৪০ শতাংশ এবং দূর থেকে ৬০ শতাংশ মাটি ব্যবহারের কথা থাকলেও তা রয়েছে শুধুমাত্র কাগজ কলমে।বেঁড়িবাধের পাশ থেকেই মাটি নিয়ে সংস্কার হচ্ছে বেঁড়িবাধ। শ্যামনগর পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসডি জাকির হোসেন বলেন ভেকু দিয়ে কাজ করার কোন বিধান নেই। দ্রæত কাজ করার জন্য আমরা ভেকু দিয়ে কাজ করার অনুমতি দিয়েছি।আমরা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে বলেছি গাছ বাঁচিয়ে কাজ করতে। কিন্তু তারা যদি না করে থাকে তাহলে বিষয়টি দেখা হবে।
বেঁড়িবাধ সংস্কারের ক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ মাটি বেঁড়িবাধের পাশ থেকে এবং ৬০ শতাংশ মাটি অন্যত্র থেকে নিয়ে কাজ করার কথা আছে এমনটি জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু আমি নতুন এসেছি বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নয়। এবিষয়ে কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কনসালটেন্ট নুরুজ্জামান এর সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন আমি দায়িত্বে নেই। ভেকু দিয়ে কাজ করার ফলে যেমন বনায়ন ধ্বংস হচ্ছে ঠিক একই সাথে বেড়িবাঁধ টেকসই হচ্ছে না বলে মনে করেন এলাকাবাসী। স্থানীয় ভাবে জানা যায়, বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পূর্ব দুর্গাবাটিতে দুটি, ভামিয়ার শেষ ভাগে দুটি এবং পদ্মপুকুর উত্তর ঝাপা বড় কেওড়া বাগান পার হয়ে দুর্গামন্দিরের সামনে পাতাখালীর সিমানায় দুটি ভেকু দিয়ে চলছে বেঁড়িবাধ সংস্কারের কাজ।
পাতা খালির অনিমেষ মন্ডল বলেন, ভেকু দিয়ে বাঁধ দেওয়া মানে ঘোড়ায় চড়ে হেটে চলার মতো। এভাবে ভেকু দিয়ে কাজ করলে চর বনায়নের কোন গাছ থাকবে না, আর গাছ না থাকলে নদীর স্রোতে বাঁধের মাটিও আটকাবে না। ভেকুতে মাটি কাটলে অল্প টাকায় হয়ে যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাভের পরিমাণ বেশি হয়। তিনি বলেন ঝোড়া কোদালে মাটি কাটলে সময় বেশি লাগলেও কাজটা সুন্দর এবং দীর্ঘস্থায়ী হতো। দূর্গাবাটি গ্রামের নজরুল ইসলাম বলেন,ভেকু দিয়ে কাজ করার ফলে চরের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ধ্বংস হচ্ছে, এছাড়া এভাবে মাটি দিয়ে সংস্কার করার ফলে যখন তখন বেঁড়িবাধের মাটি ধ্বসে পড়তে পারে।
এসময় তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ চান। সূত্রমতে জানা যায়, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তার কার্যাদেশ অনুযায়ী যে পরিমাণ বরাদ্দ পেয়েছে তার ৩ ভাগের ১ অংশ খরচ করে ভেকু দিয়ে কাজ করাচ্ছে।অধিক মুনাফার লোভে একদিকে যেমন পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে ঠিক একইভাবে উপক‚লের মানুষের টেকসই বেড়িবাঁধ স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না। উপক‚ল বাসী দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণের হাতছানি দেখতে পেলেও তা হয়তোবা দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে এমনটাই মনে করছে অনেকে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে বছর জুড়ে বিভিন্ন ভাবে সংগ্রাম করে টিকে থাকা উপক‚লের মানুষগুলো প্রতারিত হয়ে থাকে বিভিন্নভাবে। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় আর তা সহ্য করে নীরবে। দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে অধিকার বঞ্চিত মানুষগুলো ¯েøাগান দিতে থাকে ”ত্রাণ নয়, প্রাণ চাই” ”ত্রাণ নয়,টেকসই বেড়িবাঁধ চাই” অথচ সেই বঞ্চিত মানুষগুলোকে আবারো ঠকানো হচ্ছে বলে মনে করেন উপক‚লবাসী।
টেকসই বেড়িবাঁধ চেয়ে যারা কাফনের কাপড় পরে বেড়িবাঁধের উপর মানববন্ধন করে তাদের অধিকার আদায়ে মরিয়া হয়েছিল সেই সব মানুষের সাথে বেঁড়িবাধ সংস্কারের নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রতারণা করছেন বলে মনে করেন এলাকাবাসী। পদ্মপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান বলেন, আমাদের এখানে ভেকু দিয়ে কাজ চলছে। কিছু জায়গায় গাছ কাটা পড়তে দেখেছি। তবে তাদের ম্যানুয়ালে কি আছে সেটা তো দেখিনি। বুড়িগোয়ালীনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবু ভবতোষ কুমার মন্ডল বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড আমাদের কোনো বিষয়ে অবগত করেনি। তবে যতটুকু জেনেছি ওয়াপদার মাথা ১৪ ফিট, নদীর পাশে ¯েøাব ২৬ ফিট, ভিতরের পাশে ২২ থেকে ২৪ ফিট ¯েøাব থাকার কথা রয়েছে এবং ওয়াপদার মাথা পূর্বের থেকে প্রায় সাড়ে তিন ফিট উচু হওয়ার কথা। তবে ম্যানুয়াল চেয়েও কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে না পাওয়ায় আমরা দেখভাল করতে পারছি না।
তিনি বলেন ভেকু দিয়ে কাজ করলে বেঁড়িবাধ টেকসই হওয়ার চেয়ে পূর্বের তুলনায় আরো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।যখন গোড়া থেকে মাটি কাটা হচ্ছে তখন বেঁড়িবাধের গোড়া টেকসই হচ্ছে না। উভয় পাশের গোড়া থেকে এভাবে মাটি কাটলে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে পানির ঢেউয়ে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছি।
এছাড়া ভেকু দিয়ে কাজ হওয়ায় বেড়িবাঁধের পাশে থাকা বনায়ন ধ্বংস হচ্ছে। যার ফলে বেঁড়িবাধের আরো বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে মনে করি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভেকু মালিক বলেন,আমরা মাত্র ৫০ হাজার টাকা চেইন চুক্তিতে কাজ করছি। সাব কন্ট্রাক্টর এর নিকট থেকে আমরা কাজ নিয়েছি। ১০০ ফুট কাজ করলে সাব কন্ট্রাক্টর আমাদের ৫০ হাজার টাকা বুঝিয়ে দেন এর বেশি আর কিছু বলতে পারবো না।