মার্চ ৮, ২০২১
প্লাস্টিক মাদুরে বাজার সয়লাব: বিলুপ্ত হতে চলেছে মাদুর শিল্প
সমীর রায়, নিজস্ব প্রতিনিধি : প্লাস্টিক মাদুরে বাজার সয়লাব। বিলুপ্ত হতে চলেছে মাদুর শিল্প। কপোতাক্ষ নদের তীরে আশাশুনি উপজেলার বড়দল হাটটি দক্ষিনাঞ্চলে মাদুরের সবচেয়ে বড় হাট। বর্তমানে কপোতাক্ষ নদটি যেমন পলিমাটি পড়ে সরু নালায় পরিণত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে তেমনি উদ্বেগজনকভাবে সরবরাহ কমতে থাকায় বড়দল হাটটি নিঃশেষ হওয়ার দিন গুনছে। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় কুটিরশিল্পটি বাঁচাতে সরকারি বে-সরকারি সহযোগিতা কামনা করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিবৃন্দ ও মাদুর শিল্পের উপর জীবন জীবিকা ধারণকারী শত শত মানুষ। মেলি বা পাতির মাদুরে শুয়ে গরমকালে এক ধরনের শীতল অনুভূতি হয়। কিন্তু প্লাস্টিকের মাদুরে শুলে গায়ে ঘাম দিবে বা পিঠ ভিজে যাবে। মাদুর তৈরীর কাঁচামালকে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন নামে বলা হয়। তার মধ্যে কেউ পাতি বলে, কেউ বেতি বলে আর এ এলাকার মানুষ এটাকে মেলি বলে থাকে। উপজেলার বড়দল ইউনিয়নসহ পার্শ্ববর্তী প্রায় সব ইউনিয়নের মধ্যবিত্ত বা নিæমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ এক সময় মাদুর বুনে বাজারে বিক্রি করতো। ইংরেজ আমল থেকে শুরু করে এখানকার মাদুর কপোতাক্ষ মরিচ্চাপ ঘুরে ইছামতি হয়ে কলকাতা বাজারে পৌঁছে যেত। তখন এ এলাকার মাদুর ব্যবসায়ীদের দেশব্যাপী ছিল রমরমা ব্যবসা। ফকরাবাদ গ্রামের মাদুর বিক্রেতা ধনঞ্জয় মন্ডল জানালেন এ এলাকার মাদুরের উত্থান পতনের কাহিনি। তিনি বলেন বাপ ঠাকুরদার কাছে শুনেছি মেলি পাওয়া যেত বিভিন্ন নদীর চরে বা জঙ্গলের চরে। সেখান থেকে এলাকার মানুষ নৌকা করে বিনা পয়সায় কেটে নিয়ে আসতো দল বেঁধে। এখন নদীর চর কেউ না কেউ হয় ইজারা নিয়ে বা জবর দখল করে চিংড়ি চাষ করতে থাকায় মেলির উৎস প্রায় শেষ বললেও ভুল হয় না। তবে মেলি চাষ লাভজনক হওয়ায় এখন অনেকেই আমাদের এলাকায় চাষ করতে শুরু করেছে।
মেলি চাষের জন্য নিচু জমি প্রয়োজন। আষাঢ় মাসে মেলির জড়ু বা গেইড় রোপণ করতে হয়। ভালভাবে পানি, নিড়ানি ও সার দিতে পারলে ৪ মাসের মধ্যে ১ থেকে ৫ হাত পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। প্রথমবার রোপণ করার পর পানি, সার, শ্রমিক ও ঘেরা বেড়া দিয়ে এক বিঘা জমিতে ১০-১১ হাজার টাকা খরচ হয়। ভাল উৎপাদন হলে এক বিঘায় ৫/৬ পোন (৮০ তাড়ি বা গোল্লায় ১ পোন) মেলি হয়ে থাকে। ১ পোন ৭/৮ হাজার টাকা বিক্রি হয়। আবার জৈষ্ঠ্য মাসে ২য় বার কর্তন করা যায়। তবে সেগুলো একটু কম দামে বিক্রি হয়ে থাকে। আমাদের এলাকা এক ফসলের। পৌষ মাসে ধান কেটে ঘরে তুলে আমাদের আর কোন কাজ থাকে না। তাই পরবর্তী বছরে আবার ধান চাষাবাদ শুরু না হওয়া পর্যন্ত বাড়ীর মেয়েরা বা বয়স্ক ব্যক্তিরা মাদুর বুনে থাকে। একটি মাদুর পাটের সুতোর তাঁতে ফেলে বুনতে গেলে দুজনের প্রায় ৫ ঘণ্টা সময় লাগে। সংসারের কাজ সামলিয়ে এক সপ্তাহে প্রায় ৮-১০টি মাদুর তৈরী করা যায়। এ গুলো বিক্রি হয় বিভিন্ন দামে। ৬ প্রকার মাদুর একেকটি ৮০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। ৮ হাজার টাকার এক পোন মেলিতে প্রায় ১৩ হাজার মাদুর বিক্রি হতে পারে। এ ব্যবসাটি প্লাস্টিকের ক্ষতিকারক পণ্য এসে নষ্ট করে দিচ্ছে। এখন পরিশ্রমের ঠিকমত মূল্য পাওয়ায় মাদুর শিল্পের শ্রমিকরা অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছে। তারা পার্শ্ববর্তী ইটভাটায় শ্রম দিচ্ছে বা অন্য কোথাও শ্রম দিয়ে কোন রকমে টিকে আছে। বড়দল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল আলিম বলেন- মাদুর শিল্পটি আমাদের এলাকার খুবই ঐতিহ্যবাহী এবং লাভজনক একটি শিল্প। আমার ইউনিয়নের প্রায় ৮০ ভাগ নারী পুরুষ এ শিল্পের সাথে জড়িত। প্লাস্টিকের মাদুর এসে এলাকার ব্যবসা এবং ঐহিত্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আগের মত সহজে মেলি পাওয়া যায় না। অন্য জায়গায় শ্রমের মূল্য বেশি তাই সেখানে পুরুষেরা চলে যাচ্ছে। ফলে বাড়ীর নারী ও বয়ষ্ক ব্যক্তিরা বাড়ীর অন্যান্য কাজ সেরে মাদুর তৈরী করে এজন্য উৎপাদন কমে গেছে। তবে ব্যবসাটি লাভজনক হওয়ায় নতুন করে মেলির চাষাবাদ শুরু হয়েছে। ইউনিয়নের জেলপাতুয়া, মাদিয়া, হেতালবুনিয়া, বড়দল, বামনডাঙ্গা, নড়েরাবাদ, ফকরাবাদসহ বিভিন্ন গ্রামে দিন দিন মেলি চাষে আগ্রহ বাড়ছে। মেলি বা পাতি উৎপাদনে বিঘা প্রতি যে খরচ তাতে সরকারি বেসরকারি সহযোগতা পেলে চাষীরা আরও আগ্রহী হতো। তাই আমার এলাকার হারানো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে নিতে স্বাস্থ্যকর মাদুর শিল্পকে বাঁচাতে মাদুর শ্রমিকদের পক্ষে প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি। 8,413,572 total views, 1,725 views today |
|
|
|