Site icon suprovatsatkhira.com

জীবন সংগ্রামে সফল হওয়া দেবহাটার ৫ নারীর আত্মকথা

মীর খায়রুল আলম : জীবন সংগ্রামে সমাজ, পরিবারের নানা বাধা কাটিয়ে সফলতার মুখ দেখেছেন দেবহাটার ৫ নারী। তৃণমূল থেকে উঠে আসা এসব নারীদের ৫টি ক্যাটাগরিতে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়িত ‘‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’’ শীর্ষক কর্মসূচীর আওতায় খুঁজে বের করে সম্মাননা প্রদান করেছে। এসব নারীদের আত্মতৃপ্তি ও অনুসরণীয় করতে তাদের সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। এদের জীবনে রয়েছে আলাদা আলাদা জীবন কাহিনি। তাদের সেই সংগ্রামের কাহিনি ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরা হলো:
শিক্ষা ও চাকুরির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী : একজন শিশু কন্যা থেকে সফল নারী আসমা পারভীন। তিনি বহেরা গ্রামের এমামুদ্দিন সরদারের কন্যা। বাবা মায়ের ৪ সন্তানের মধ্যে সে ছিল বড়। দরিদ্র পিতা মাতার সংসারে অভাব অনাটন থাকায় পরিবার থেকে লেখা পড়ার কোন খরচ পেতেন না তিনি। তাই নিজ চেষ্টায় ইংরেজিতে এম,এ পাশ করেন। এরপর গোপালগঞ্জের সরকারি বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। বর্তমান শিক্ষাকতা করে তার সুখে দিন কাটছে।
সফল জননী : জোহরা খাতুন। তিনি নওয়াপাড়া গ্রামের মৃত আক্কাজ আলী মোল্লার স্ত্রী ও একজন সফল জননী। তার রয়েছে ৫ ছেলে সন্তান। স্বামী ছিলেন সামান্য সরকারী কর্মচারী। উচ্চ রক্তচাপ জনিত কারণে চাকরিরত অবস্থায় তার স্বামী মারা যায়। এতে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়ে। স্বামীর অল্প পেনশনের টাকা দিয়ে সংসার আর ছেলেদের লেখাপড়ার খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন তিনি নিজ বাড়িতে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন শুরু করেন। হাঁস-মুরগি পালন করে ছেলে মেয়েদের পড়া লেখার খরচ জোগাতেন। তার ছেলেরা সবাই ছিল মেধাবী ও পরিশ্রমী। একই বই পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ছেলেরা পড়ত। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সাফল্যের সাথে পড়াশোনা করে ৩ ছেলে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সর্বোচ্চ মেধার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়। যার মধ্যে আকবার হোসেন মোল্ল্যা, সিলেট শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পরিকল্পনাও উন্নয়ন বিভাগ) উপ-পরিচালক। আর এক ছেলে মনিরুজ্জামান (মনি) বর্তমান নওয়াপাড়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য, আফসার আলী (বাবলু)প্রভাষক, নর্দান ইউনিভার্সিটি, ঢাকা। আখতার হোসেন (ডাবলু) দেবহাটা প্রেসক্লাবের সদস্য, আলমগীর হোসেন উপ-সচিব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নব উদ্দামে জীবন শুরু : কহিনুর বেগম, পিতা-আবুল কাশেম, গ্রাম- চিনেডাংগা, দেবহাটা, সাতক্ষীরা। তার পিতার অবস্থা অনেক ভালো ছিল। কিন্তু তার বিয়ে হয় এক দরিদ্র পরিবারে। তার স্বামীর কোন জমি-জমা ছিল না। পিতার নিকট থেকে সামান্য জমি নিয়ে সেখানে বসবাসের জন্য বাড়ি তৈরি করে এবং সংসারে উন্নয়ন করার পরিকল্পনা শুরু করে। এরই মধ্যে একটি পুত্র সন্তান হয় এবং ছেলেটি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তখন থেকে সংসারে অশান্তি শুরু হয় এবং তার উপর স্বামীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু হয়। এমনকি খাওয়া পরা পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। সে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পিতার দেওয়া জমি স্বামীর নামে লিখে দেয়। তারপরেও নির্যাতনের মাত্রা কমেনি। এক পর্যায়ে স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেয়। তারপর থেকে কহিনুরের জীবন নতুন করে শুরু হয়। বাড়িতে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন শুরু করে সে। সেখান থেকে যে অর্থ উপার্জন হয় তা দিয়ে সংসারের যাবতীয় খরচ মেটাতে থাকেন। বর্তমানে গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং নতুন উদ্দামে নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে জীবন শুরু করেছে কহিনুর।
অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী : জীবন সংগ্রামে দারিদ্র্যতাকে পিছনে ফেলে সাফল্য অর্জন করেছেন মাধবী রানী ঘোষ। তিনি ১৯৭৪ সালে ২১ নভেম্বর কালীগঞ্জ উপজেলার ভাড়াশিমলা ইউনিয়নের খারাট গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ৫ ভাই-বোনের মধ্যে সে তৃতীয়। যার ফলে বেশি লেখাপড়া শেখতে পারিনি সে। এরপর ১৯৯২ সালে দেবহাটা উপজেলার সখিপুর গ্রামের দিনমজুর অমল কুমার ঘোষের সাথে বিবাহ হয় তার । বিয়ের ৭ বছর পর একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। মেয়ের বয়স যখন ১ বছর তখন তার স্বামী মার যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর সংসার এবং মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালানো পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন সে অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ শুরু করে। দিনমজুরের কাজের পাশাপাশি নিজের সামান্য জমিতে চাষ শুরু করে সে। সাথে সাথে বাড়িতে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন শুরু করে এবং সেখান থেকে যে অর্থ উপার্জন হয় তা দিয়ে তার সংসারের যাবতীয় খরচ মেটায়। বর্তমানে তার মেয়ে প্রিয়াংকা রানী ঘোষ গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া-লেখা করছে। তাকে আর দিনমজুরের কাজ করতে হয় না। গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জন করছেন।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান : একজন নারী হয়েও জীবন সংগ্রামের মাঝে সমাজের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে রিংকু রানী বিশ্বাস। তার স্বামী তাপস বিশ্বাস একজন গ্রাম্য ডাক্তার। স্বামীর বাড়ি উত্তর সখিপুরে। স্বামীর সংসারের অবস্থা মোটামুটি ভালো ছিল। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে এসে তেমন সময় পার হত না তার। তখন চিন্তা করতেন সংসারের বাইরে মানুষের জন্য কিছু করার। এলাকার অনেক মানুষ আছে যারা তার কাছে আসত। তাই তিনি নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন বাড়িতে যেয়ে যেয়ে তাদের স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতনতা করেন। স্বামী ডাক্তার হওয়ায় স্বাস্থ্য সেবিকার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বিনামূল্যে মানুষের সেবা করা শুরু করেন। বিভিন্ন ঔষধপত্র দেওয়া থেকে শুরু করে কীভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা থাকতে হয়, যাদের ছেলে-মেয়ে স্কুলে যায় না তাদের স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা করা, গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে সমাধানের ব্যবস্থা করা সহ এলাকার মানুষের বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান করেন। ছাড়া মন্দিরের বিভিন্ন আসবাবপত্র ক্রয় সহ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সার্বিক সহযোগিতা করে থাকেন তিনি।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version