মোশাররফ হোসেন: পাঁচপোতা গ্রামের শওকত হোসেনের স্ত্রী মাছুরা খাতুন। দুই সন্তানের জননী, কয়েক কাঠা ভিটে বাড়ি ছাড়া আর কোন সম্পদ ছিল না। ভুল চিকিৎসায় স্বামী অন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ ২০ বছর অন্ধ স্বামীর সংসারে খুব কষ্টে তাকে জীবিকা নির্বাহ করতে হতো। তিনি স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য দর্জি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে আইজিএ প্রকল্পে বøক বাটিক এর প্রশিক্ষণ নিয়ে পোশাক তৈরি ও তাতে বøক এর কাজ করে পোশাক বিক্রয় করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। অর্জিত অর্থ দিয়ে সে তার সংসার চালিয়ে মেয়েটিকে এম এ পাশ করিয়েছেন ও ছেলেটি নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। বর্তমানে তার আর্থিক অবস্থা পূর্বের তুলনায় অনেক ভালো। তার অর্জিত পুঁজি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে।
শিক্ষা ও চাকুরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী:
দলুইপুর গ্রামের রফিকুল ইসলামের কন্যা মিরা খাতুন। চার ভাই বোনের মধ্যে মিরা খাতুন সবার ছোট। তার বাবা তাকে পোশাক পরিচ্ছদ ও পড়ালেখার কোন খরচ জোগাতে পারত না। তাই শৈশব থেকে হস্ত শিল্পের কাজ করে নিজের খরচ নিজেই উপার্জন করতেন। একদিকে পড়ালেখা অন্য দিকে নিজের রোজগার তাকে খুব কষ্টে ফেলত। তবু সে দমে যায়নি। এসএসসি ফরম পূরণ, এইচএসসি তে ভর্তির টাকা অন্য লোকের নিকট থেকে সাহায্য গ্রহণ করে। তার পরিবার একটা টাকাও দিতে পারেনি। পড়ালেখার পাশাপাশি গৃহপালিত পশু-পাখি পালন করে নিজের এবং পরিবারে খরচ জোগান দিচ্ছে। একজন দরিদ্র দিন মজুরের কন্যা হয়ে অনেক সংগ্রাম করে মাস্টার্স পাশ করে বর্তমানে চাকরি করছে। সে যৌতুক,বাল্যবিবাহ,নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধমূলক কাজ করে যাচ্ছে।
সফল জননী নারী:
জালালাবাদ গ্রামের আব্দুল হামিদ এর স্ত্রী মনোয়ারা খাতুন। তার স্বামী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ছয় সন্তানের জননী মনোয়ারা খাতুন স্বামীর অল্প আয়ের সংসারে বিভিন্ন অভাব অনটনের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেন। স্বামীর স্বল্প আয়ের পাশাপাশি তিনি স্ব উদ্যোগী হয়ে বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ, হাঁস-মুরগি পালন করে সন্তানদের লেখাপড়া খরচ চালিয়ে গেছেন। তার প্রথম পুত্র বিএ পাশ (ব্যবসায়ী)। দ্বিতীয় পুত্র অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ। তৃতীয় পুত্র প্রভাষক,সরকারি হোমিও প্যাথিক মেডিকেল কলেজ, মিরপুর-১৪,ঢাকা। চতুর্থ পুত্র সহকারী কমিশনার (ভূমি), তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ। পঞ্চম পুত্র ৪০ তম বিসিএস এ প্রিলিমিনারী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। তার কন্যা বিএ পাশ। বর্তমানে মনোয়ারা খাতুন সংসার জীবনে অনেক ভালো আছেন এবং সন্তানেরা সকলেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্ব মহিমায় উজ্জ্বল।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী:
কোটা গ্রামের আলাউদ্দীন মোড়লের কন্যা পারভীন খাতুন। তার অনেক কম বয়সে বিয়ে হয় এবং কিছুদিন যেতে না যেতেই স্বামী তার উপর অত্যাচার শুরু করে। তার অমানুষিক নির্যাতনে সে হতবিহŸল হয়ে পড়ে। বাবার বাড়ি ফিরে যাবে কিন্তু বাবা গরিব। শাশুড়ির সহযোগিতায় সে সংসারে টিকে থাকে। তার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে আছে। স্বামীর অত্যাচারে আত্মহননের পথ বেছে নিতে চেয়েছিল কিন্তু সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে তা পারেনি। সিদ্ধান্ত নেয় তাকে সবকিছু পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে। সন্তানদের মানুষ করতে হবে। এজন্য সে সেলাই এর কাজ শেখে। সেলাই থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে গরু ছাগল পালন করে। এরপর ১০ জন মেয়েকে সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করছে। এভাবে তার উপার্জনের পথ সুগম হতে থাকে। কুঁড়ে ঘর থেকে তার পাকা একতলা ভবন তৈরি করেছে। সন্তানদের মানুষ করেছে। পূর্বে নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী:
নাকিলা গ্রামের মোহর আলীর কন্যা জাহানারা বেগম। এলাকার বিভিন্ন মহিলারা মানষিক নির্যাতন, অত্যাচার, সংসারের অস্বচ্ছলতা,বাল্যবিবাহ,যৌতুকের শিকার হলে তিনি তাদের পাশে দাঁড়ান এবং সহযোগিতা করেন। এসব মহিলাদের সমস্যা নিরসনের লক্ষে কিছু মহিলাকে একত্রিত করে তিনি পল্লী সমাজ মহিলা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি সঞ্চয় জমা ও ঋণ বিতরণ শুরু করেন। এর পাশাপাশি মৎস্য,কৃষি, হাঁস-মুরগি পালন, দর্জি প্রশিক্ষণ দিয়ে অনেকের স্বাবলম্বী করেন। সংস্থার নকশি কাঁথা সেন্টারে ৬০ জন মহিলা কাজ করে। এই সংস্থার সাফল্য দেখে বর্তমানে অনেক মহিলা কাজ শিখতে আসছে। তিনি এলাকায় যৌতুক, নারী নির্যাতন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করেন। গরিব অসহায় ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখা ও চিকিৎসার খরচ জোগান। বিভিন্ন সমাজ বিরোধী কর্মকান্ড প্রতিরোধে তিনি এগিয়ে আসেন।