Site icon suprovatsatkhira.com

সেচ প্রকল্প নিয়ে ষড়যন্ত্র জেলার দুই উপজেলায় ফসল উৎপাদন নিয়ে সংশয়

নিজস্ব প্রতিনিধি : কৃষিখাত এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই সময়ে ক্রমাগতভাবে পিছিয়ে পড়ছে সাতক্ষীরার দুই উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের একাধিক গ্রামের কৃষি। অপরিকল্পিত ঘের, বসতবাড়ি নির্মাণ এবং স্থানীয় খালগুলোর স্থায়ী বেড়ি-বাঁধ না থাকার কারণে প্রতি বছর আগাম বন্যায় তলিয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই এলাকার ৫ হাজার বিঘা জমির ফসল। তিন ফসলি জমিতে এখন একটি ফসল আবাদ হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির সমস্যা আর ভরা মৌসুমে বর্ষায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে পানি বন্ধী হয়ে থাকছে ফসলের মাঠে। ফলে একদিকে যেমন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে, অপরদিকে পানি বৃদ্ধির সময় পুরা ফসলের মাঠে কচুরি পানায় ভরে থাকছে।

শুষ্ক মৌসুমে সেচ প্রকল্প দিয়ে পানি নিষ্কাশনের পাশাপাশি কচুরি পানা সরিয়ে কষ্ট করে ফসল উৎপাদন করতে হচ্ছে কৃষকদের। আর এ কারণে ফসল উৎপাদনে কৃষকদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। ফসল আনা নেওয়ার জন্য বিলে নেই যাতায়াতেরও সু-ব্যবস্থা। ফলে ফসলের মাঠের আইল ধরে অনেক কষ্ট করে ফসল আনতে হয় তাদের। গড়ে এক দশকে দু’একবারও ভালোভাবে ফসল ঘরে তুলতে পারছেন না কৃষকরা। বছরের পর বছর চাষাবাদ করে লাখ লাখ টাকা লোকসান গুনছেন এসব অঞ্চলের কৃষকরা। তার উপর স্থানীয় একটা কুচক্রী মহলের চাঁদাবাজি ও ষড়যন্ত্রের কারণে বছরে এক ফসল উৎপাদন করা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে কৃষকদের মাঝে। এতে ওই অঞ্চলের কৃষকরা পড়েছেন চরম বিপাকে। কুচক্রী মহল থেকে নিস্তার পেতে এবং পিছিয়ে পড়া কৃষিকে এগিয়ে নিতে ওই সকল এলাকার খালের স্থায়ী বেড়ি-বাঁধ নির্মাণ ও বেতনা সংস্কারের দাবি করেছেন স্থানীয়রা।
সম্প্রতি ওই অঞ্চলের কৃষকদের সমস্যার বিষয় জানতে সরেজমিনে গেলে জানা যায়, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বল্লী ইউনিয়নের ঘরচালা, নারায়ণপুর, হাজীপুর, ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের পাথরঘাটা, কলারোয়ার জালালাবাদ ইউনিয়নের কাশিয়াডাঙ্গা, মুরারীকাটি সহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য ৮০’র দশকে হাজীপুর বেতনা নদী হতে ঘরচালা পর্যন্ত মালদাড়ীর খাল খনন করা হয়। খাল খনন পরবর্তী অপরিকল্পিত ঘের, বসতবাড়ি নির্মাণ ও মালদাড়ী খালের কোনপ্রকার ভেড়ি-বাঁধ না থাকাই বেতনার জোয়ার অথবা অল্প বৃষ্টির পানিতে এসকল অঞ্চলের কৃষি জমির ফসল ডুবে যায়। একদিকে বেতনার নদী কচুরিপানাতে ভরাট অপরদিকে খালের কোন ভেড়ি-বাঁধ না থাকার কারণে পানি নিষ্কাশনে চরম সমস্যায় পড়ে যান এই অঞ্চলের কৃষকরা।
বর্ষা মৌসুমে বেতনা নদীতে পানি কানায় কানায় ভরাট থাকার কারণে মালদাড়ী খালের পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না স্থানীয়দের। এতেকরে প্রতি বছর বন্যার কবলে পড়েন অত্র এলাকার কয়েক হাজার পরিবার। বর্ষা মৌসুমের জলাবদ্ধতার পানি শুষ্ক মৌসুমে বোরো ধান চাষেও প্রভাব ফেলে বলে জানান স্থানীয়রা।
এ সময় তারা জানান, আগাম বন্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে গ্রামবাসীরা সেচ প্রকল্পের দাবি জানিয়ে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গ্রামবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে তৎকালীন মহাজোট সরকারের সাতক্ষীরা-২ আসনের সাংসদ এম, এ জব্বার, সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ-সম্পাদক নজরুল ইসলাম, সাবেক উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এস,এম শওকত হোসেন সেচ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধন পরবর্তী বাৎসরিক কয়েক লক্ষ লক্ষ টাকার বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের জন্য বর্ষা মৌসুমে পানির নীচে তলিয়ে থাকা অনাবাদি জমিতে মাছ চাষের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করার কথা জানান তাঁরা। তাঁদের নির্দেশনা মোতাবেক দীর্ঘ ১০বছরেরও বেশি সময় ধরে ৫হাজার বিঘা জমির জলাবদ্ধতার পানি সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে নিষ্কাশন করে বোরো ধান রোপণ করে আসছে গ্রামবাসীরা এবং পানি নিষ্কাশনের জন্য বাৎসরিক কয়েক লক্ষ টাকার বিদ্যুৎ বিল বর্ষা মৌসুমে মাছ চাষ করে সেচ প্রকল্প কমিটির মাধ্যমে পরিশোধ করা হয় বলে জানান তারা।
এ সময় স্থানীয় সেচ প্রকল্প কমিটির সাধারণ-সম্পাদক জাহারুল ইসলাম, কামরুল ইসলাম, আব্দুর রহমান, বদরউদ্দীন, রবিউল ইসলামসহ একাধিক ব্যক্তিরা জানান, মালদাড়ী খালের কোনপ্রকার ভেড়ি-বাঁধ না থাকার কারণে বিলে হাজার হাজার বিঘা জমিতে উন্মুক্ত ভাবে যে মাছ চাষ করা হয় সেটা বর্ষা মৌসুমে অধিকাংশ মাছ খালে অবস্থান করে। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে কৃষকের ছাড়া মাছগুলো হাতিয়ে নিতে বল্লীর ভাটপাড়া এলাকার বজলুর হোসেনের ছেলে কানকাটা খায়রুল ইসলাম ও ঘরচালা এলাকার মৃত. আব্দুর রশিদ মোল্ল্যার ছেলে মিলন হোসেন পাঁয়তারা করতে থাকে। এসময় তারা বিগত সেচ প্রকল্প কমিটির নিকট মোটা অংকের চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দেওয়ায় তারা বিভিন্ন ভাবে গ্রামবাসীদের হয়রানি করেন বলে অভিযোগ করেন তারা। এসময় নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক ইউপি সদস্য বলেন, কখনো যুবলীগ, সেচ্ছাসেবকলীগ আর কখনো বা বঙ্গবন্ধু পেশাজীবী লীগের সাধারণ-সম্পাদক পরিচয়ে এলাকায় চাঁদাবাজি করেন কানকাটা খায়রুল ও মামুন। চাঁদাবাজির কারণে বহুবার স্থানীয়দের হাতে গণ-পিটুনির শিকার হলেও বর্তমানে পুলিশের সাথে তাদের সখ্যতা থাকাই তাদের অপকর্মের প্রতিবাদ করতে ভয় পান স্থানীয়রা।

এ বিষয়ে মালদাড়ী বিলের সেচ প্রকল্প কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান জানান, বেতনা ছাড়া মালদাড়ী বিল অনেক নিচুতে অবস্থিত। এ কারণে বর্ষা মৌসুমে বিলের পানি খালের মধ্যদিয়ে বেতনা নদীতে প্রবেশ করতে পারে না। তাছাড়া বেতনা নদীতে কচুরিপানাতে ভরপুর। এ কারণে বর্ষা মৌসুমে অত্র বিলের পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এসময় তিনি আরো বলেন, মালদাড়ী খালে কোন বেড়ি বাঁধ নাই। এ কারণে অল্প বৃষ্টিতে ফসলি জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এতেকরে চরম সমস্যায় পড়তে হয় কৃষকদের। সেচ প্রকল্পের বিদ্যুৎ বিল বহন করার জন্য বহু বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে ওই সমস্ত অনাবাদি জমিতে মাছ চাষ করে আসছে কৃষকরা। তবে সম্প্রতি একটা মহল মাছ চাষে বাধাবিঘœ সৃষ্টি করছে। এখন তাদের কারণে বছরে এই ৫হাজার জমিতে একটি ফসল উৎপাদন করা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। এখন স্থানীয় গ্রামবাসীরা যদি মাছ চাষ না করে তাহলে তাদের পক্ষে কখনো দুই, তিন লক্ষ টাকার বিদ্যুৎ বিল বহন করে বোরো ধান চাষ করা সম্ভব না। এতেকরে বছরের পর বছর ওই সমস্ত জমি অনাবাদি থেকে যাবে। এ কারণে খালের বেড়ি বাঁধ নির্মাণ অথবা মাছ চাষে যেন কোন সমস্যা সৃষ্টি নাহয় সেটার জন্য জেলা প্রশাসকসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।
এ বিষয়ে বল্লী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, সেচ প্রকল্প কমিটির কাছে খায়রুল চাঁদা দাবি করেছিল বলে শুনেছি। তবে এবিষয়ে বিস্তারিত জানাতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, ২০০৯ সাথে যখন আমি ইউপি চেয়ারম্যান ছিলাম তখন আমার স্বর্ণের আংটি বিক্রয় করে সেচ প্রকল্পের বিল পরিশোধ করি। পরবর্তীতে তৎকালীন সাংসদ এম,এ জব্বার, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ-সম্পাদক ও তৎকালীন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও সাবেক উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তৎকালীন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এস,এম শওকত হোসেনের নির্দেশনা মোতাবেক প্রায় তিন শত সদস্য বিশিষ্ট সেচ প্রকল্প কমিটির মাধ্যমে মালদাড়ী বিলে গ্রামবাসীরা উন্মুক্ত ভাবে মাছ চাষ করে সেচ প্রকল্পের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতো। তবে সম্প্রতি একটা মহল এটা নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে একটা ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে। এনিয়ে বহুবার বসাবসি হলেও তারা আইনের ঊর্ধ্বে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ-সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, ২০০৯ সালে তৎকালীন সাংসদ এস,এম জব্বার ও আমি অত্র এলাকার কয়েক হাজার হাজার বিঘা জমির জলাবদ্ধতা নিষ্কাশনের জন্য একটা সেচ প্রকল্প চালু করি। যেহেতু বর্ষা মৌসুমে ঐসকল এলাকার ফসলি জমি পানির নীচে তলিয়ে থাকে। সে কারণে সেচ প্রকল্পের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করার জন্য বর্ষা মৌসুমে ওই সকল অনাবাদি জমিতে মাছ চাষকরে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করার জন্য বলা হয়। তবে বর্তমানে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে সেটা সম্পর্কে তিনি অবগত নন বলে জানান।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দেবাশীষ চৌধুরী বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন তিনি। তবে ওই এলাকার সমস্যাগুলো সমাধানে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে সমাধান করা হবে। এ সময় অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। তবে এ বিষয়ে স্থানীয়রা লিখিত ভাবে অভিযোগ দিলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version