Site icon suprovatsatkhira.com

করোনায় কামার পল্লীতে নেই ঈদের আমেজ

এমএ মামুন, দেবহাটা : আর মাত্র কয়েকদিন পর মুসলমান ধর্মের সব চেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পবিত্র ঈদুল আযহা। আর এ ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে কামারদের ব্যস্ত সময় কাটানোর কথা থাকলেও দেবহাটা উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারের কামারদের কর্মব্যস্ততা নেই বললেও চলে। তাদের মধ্যে নেই ঈদের আমেজ। করোনায় প্রায় সব প্রকার ব্যবসা স্থবির হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে মধ্য বিত্ত ও নি¤œ আয়ের পরিবার গুলোকে কিছুটা অভাব-অনাটনের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। আর তারা কোরবানি দেয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। যে কারণে কোরবানি দিতে ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই মধ্য বিত্ত ও নি¤œ আয়ের এই পরিবারের। আর এতে প্রভাব পড়ছে স্থানীয় কামারদের মাঝে। করোনার কারণে তেমন জমে উঠছে না কোরবানির ঈদের হাট।

এবছর কোরবানির ঈদকে ঘিরে কামার পল্লীতে দা, ছুরি, চাপাতি, নারিকেল কোরানিসহ অন্যান্য দেশীয় লোহার জিনিসপত্র তৈরি করছে ঢিলেঢালা ভাবে। ঈদ উপলক্ষে দা, চাপাতি ও ছুরির চাহিদা কম থাকায় বিপাকে পরেছে কামাররা। বছরের অন্য সময়ের চেয়ে কোরবানির ঈদে তাদের আয় রোজগার বেশি হওয়ার কথা থাকলেও তা নেই এবার। আগের দিনগুলোতে দা, কুড়াল, বঁটি, চাকু, কোদালসহ লোহার যন্ত্র তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করলেও আজকের দিনে তা অনেক অংশে কমে দাঁড়িয়েছে। দিনের শেষে রাতেও বিরাম ছিল না এসব কারিগরদের। সব সময় শুন-শান আর ট্যুং-টাং শব্দে মুখরিত হত কামারশালা গুলো। বিশেষ করে কামারদের এই ব্যস্ততা জানান দেয় ঈদুল আযহার অতি সন্নিকটে।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কেউ হাতুড়ি দিয়ে লোহা পেটাচ্ছে, কেউ হপার টানছে, কেউবা আবার তৈরি করা সামগ্রীতে শান (ধার) দিচ্ছে। কোরবানির পশুর চামড়া ছাড়ানো থেকে শুরু করে গোস্ত কাটার কাজে ব্যবহার করা হয় কামারশালার বিভিন্ন শৈল্পিক সামগ্রী। উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজারের কামার পল্লীর কারিগরদের নেই তেমন ব্যস্ততা। অধিকাংশ দোকানেই কিছু সংখ্যক যন্ত্রপাতি তৈরি করা হচ্ছে। কামারদের হাতে তৈরি করা এসব দা, বটি, চাকু, কুড়াল কিনতেও ক্রেতাদের আগের মত দেখা যায় না।
কেননা নতুন চাকু তৈরি করতে ৫০-৬০ টাকা, দা ও বটি দুই শ’ থেকে ৪৫০ টাকা, কাচি ৫০-৬০ টাকা, ফোঁড় (ঘাস মারা যন্ত্র) ২৫-৩০ টাকা, কোপা ৪শত থেকে ৫শত টাকা কেজি, লাফনা(মাটিকাটা যন্ত্র) দেড় শত থেকে ২শত টাকা কেজি দরে বিক্রয় হচ্ছে। একদিকে মহামারি করোনা। অপরদিকে, শান দেওয়া বটি ৫০ টাকা, কাচি ৩০ টাকা, দা ৫০ টাকা, কোপা ১০০ টাকা, চাকু ১৫ টাকা হওয়ায় হাতে তৈরি করা যন্ত্রের পরিবর্তে আধুনিকে ঝুঁকে পড়ছেন ক্রেতারা। তাছাড়া আধুনিক মেশিনের মাধ্যমে অনেক কম টাকায় এসব যন্ত্রপাতি পাওয়া যাচ্ছে। সে কারণে অনেকেই কামারদের কাছে যান না। তবে কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ীও রয়েছে, যারা শুধু ঈদের সময়ই এ ব্যবসা করে থাকেন। অন্যান্য সময়ের চেয়ে এবছর ঈদুল আযহার সময় তেমন কর্মব্যস্ততা বাড়েনি বলে জানান অনেকে।
উপজেলার ঈদগাহ কামার পল্লীর কার্ত্তিক কর্মকার বলেন, পূর্ব পুরুষের পেশা হিসেবে বর্তমান এ পেশায় কর্মরত আছি। আগের দিনগুলোতে প্রতিদিন হাজার টাকা মত আয় হত। কিন্তু বর্তমানে গড়ে ৪শত টাকা হারে আয় হয়। তবে আমাদের মূল টার্গেট থাকে কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র্র করে। সারা বিশ্বে মহামারি করোনা দেখা দেওয়ায় বিগত বছরের তুলনায় এবার ঈদে কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েছে বলে জানান তিনি। অপর কর্মকার নিতাই বলেন, কোরবানিকে কেন্দ্র করে কিছুটা অর্ডার আসতে শুরু করেছে। তবে, কাজের চাপ খুব বেশি না থাকলেও কয়লার সমস্যার কারণে কাজের ক্ষতি হচ্ছে। কাজ এগোচ্ছে না। যন্ত্র তৈরির জ্বালানি কয়লার দামও বাড়তি। তাছাড়া দিন-রাত সারাক্ষণ আগুনের পাশেই বসেই কাটাতে হয়।
কামারেরা আরও জানান, এভাবে যদি লোহা ও কয়লার দাম বাড়তেই থাকে তাহলে এ পেশাকে টিকিয়ে রাখাই কঠিন হবে। এই পেশা ছাড়ছেন না কেননা বাপ দাদা পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া ঐতিহ্য। একাজ ছাড়া অন্য কাজ শিখিনি। তাই এই পেশা ছাড়ার উপায় নেই। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা দেশের ঐতিহ্যবাহী এ পেশাটি ধীরে ধীরে বিলুপ্তই হয়ে যাচ্ছে প্রায়। আশির দশকেও গ্রাম গঞ্জের যেখানে সেখানে কামারশালা দেখা যেত। কিন্তু এখন আর এগুলো সচরাচর চোখে পড়ে না। এর প্রধান কারণ, শারীরিক ক্ষতি, অধিক পরিশ্রমী, উপযুক্ত মজুরি না পাওয়া এবং সর্বোপরি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও মহামারি করোনা। তবে প্রতি বছর কোরবানির ঈদ এলেই কিছুটা কদর বাড়ে কামারদের। এরপর থেকে বছরের অবশিষ্ট দিনগুলোতে অধিকাংশ কামারেরাই থাকেন প্রায় কর্মহীন। যেকারণে অভাব অনটনেই চলছে দরিদ্র কামারদের জীবন সংসার। হচ্ছে না তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন। ফলে অনেক কামারই তাদের এই আদি পেশা ছেড়ে বেছে নিচ্ছেন বিকল্প পেশা। সারাদেশে মহামারি করোনা ও বন্যার কারণে এবার গত ঈদের চেয়ে কাজ কম। বাজারে আমদানিকৃত হাতিয়ার আসায় তাদের তৈরি জিনিসের চাহিদা বহুগুণে কমে গেছে। ফলে পূর্ব পুরুষদের এই পেশা ধরে রাখা দুষ্কর হবে বলেও জানান তারা।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version