জুলাই ২১, ২০২০
সুন্দরবনে মাছের পাশ বন্ধ: অনাহারে জেলেদের জীবন
গাজী আল ইমরান, নিজস্ব প্রতিনিধি : সুন্দরবনে মাছের পাশ পারমিট বন্ধ হওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছে সুন্দরবন উপক‚লের হাজার হাজার জেলে পরিবার। যাদের নুন আনতে পানতা ফুরায় সুন্দরবনের উপরে নির্ভরশীল এমন পরিবারগুলোর দিন কাটছে না খেয়ে না দেয়ে। অধিকাংশ জেলে পরিবার জড়িয়েছে সুদের জালে। পহেলা জুলাই থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বন বিভাগ। ২৪ জুন থেকে সুন্দরবনে প্রবেশের জন্য সব পাশ ও পারমিট দেওয়া বন্ধ রেখেছে বন বিভাগ। এর আগে গত বছর দুই মাস সুন্দরবনে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। নদীর ধারে বসবাস জেলেরা মাছ ধরেই দিনপাত করে থাকেন। অধিকাংশ জেলেরা মাছ ধরা ছাড়া আর অন্য কোনো কাজের সাথে সম্পৃক্ত নয়, এছাড়া অনেকেই মাছ ধরা ছাড়া আর অন্য কোনো কাজ পারেন না। সুন্দরবন উপক‚লে কথা হয় কয়েকজন জেলের সাথে, কথা বলতেই তারা বলতে থাকেন তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা। বংশ পরম্পরা জেলে পেশার সাথে যুক্ত মদজি আলী বলেন, বংশ পরম-পরায় অনুযায়ী দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে জঙ্গলের সাথে সম্পর্ক, পাশ পারমিট খুবই প্রয়োজন। পাশ না পেলে না খেয়ে মরে যেতে হবে। আমি তো সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল, পাশ বন্ধ থাকায় এখন বাড়িতে বসা, ঋণের উপর চলতে হচ্ছে। তিনি আক্ষেপের সাথে বলেন, সুন্দরবনে প্রবেশের পাশ দিলে সুন্দরবনের বরং উপকার হবে, কোন ক্ষতি হবে না। পাশ না দিলে কাঁকড়া, মাছ নির্দিষ্ট সময়ে মারা যাবে, তাতে ক্ষতি হবে। তিনি আরো বলেন আগে জানতাম জানুয়ারি – ফেব্রæয়ারি এই ২ মাস পাশ বন্ধ থাকে কিন্তু এখন দেখছি ইচ্ছা মত বন্ধ থাকে। বনজীবী নারীদের সর্দার শেফালি বেগম বলেন, এখন জম্মের খারাপ অবস্থা, এক দিকে করোনা ভাইরাস, ঘূর্ণিঝড় আম্পান, অন্য দিকে জীবিকা নির্বাহের একটি মাত্র পথ সেটিও প্রবেশ বন্ধ। এলাকায় অনেক কাঁকড়া মাছের প্রোজেক্ট ছিল, সেখানেও কিছু মানুষ কাজ করতো কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ফলে নদী ভাঙনে সব শেষ হয়ে গেছে। অনেকেই মাছ শাক মেরে সংসার চালাতে চেয়েছিল কিন্তু পাশ পারমিট বন্ধ হওয়ায় সেই পথও বন্ধ হয়েছে। বনে প্রবেশের পাশ পারমিটটা খুবই প্রয়োজন বনজীবীদের জন্য। তিনি আরো বলেন,সরকারি ভাবে যদি সুন্দরবনে প্রবেশে বন্ধ থাকে, তাহলে তো প্রচার হওয়ার কথা কিন্তু তা আগে থেকে প্রচার করা হয়নি। ছবেদ আলী বলেন, জঙ্গলে যাওয়া ছাড়া আমি কোন কাজ করি না, পারিওনা। অনেক ছোট বেলা থেকে জঙ্গলে যাই, কখনো মাছ ধরতে, কখনো কাঁকড়া ধরতে, কখনো মধু সংগ্রহের কাজে, কোন দিন অন্য কাজের কথা চিন্তা করি না। মাঝে জঙ্গলে যাওয়ার জন্য ১ মাসের বাজার করি, যাওয়ার দিন সকালে শুনি পাশ দেবে না বন বিভাগ। সারা বছর যদি সুন্দরবনে পাশ পারমিট বন্ধ থাকে তাহলে আরো বনের ক্ষতি হবে লাভ হবে না, কারণ নিদিষ্ট সময় মাছ- কাঁকড়া না ধরলে সেগুলো মারা যাবে। তিনি আরো বলেন, পাশ পারমিট না দিলে চুরি ডাকাতি বৃদ্ধি পাবে, পরিবারে অশান্তি দেখা দেবে। দীর্ঘ দিন পাশ বন্ধ থাকলে বনজীবীরা ভিন্ন পেশা বেছে নেবে, ফলে বনজীবীরা তাদের পেশা হারাবে। এ সময়ে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি থেকে বাঁচতে তাদের মাস্ক ব্যবহারের কথা বললে তারা বলেন, করোনা ভাইরাসের কথা আমাদের মনেই নেই, কারণ আয় উপার্জন নেই। আয় না থাকলে তো এমনিই মরতে হবে, তা আর করোনার ভয়ে মাক্স পরে কি হবে। পাশ পারমিট বন্ধ বিষয়ে বুড়িগোয়ালীনি ইউপি চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডল বলেন, পাশ বন্ধ থাকায় সুন্দরবন উপক‚লের জেলেরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। বনবিভাগ এলাকার নদীতেও মাছ ধরা বন্ধ করেছে। মাছ ধরা বন্ধ থাকায় ঋণের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে জেলে পরিবার গুলো। পশ্চিম সুন্দরবনের সহকারী বন সংরক্ষণ কর্মকর্তা বলেন, সুন্দরবনে মৎস্য সম্পদ রক্ষায় ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানস এর (আইআরএমপি) সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৯ সালে সুন্দরবন বন বিভাগ একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। যার অংশ হিসেবে প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের (পূর্ব ও পশ্চিম) সব নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধ থাকবে। এই দুই মাস সুন্দরবনের নদী খালে থাকা বেশির ভাগ মাছের প্রজনন মৌসুম। যার ফলে এ সময় মাছ ধরা বন্ধ থাকলে সুন্দরবনের নদী খালে যেমন মাছ বৃদ্ধি পাবে, তেমনি অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদসহ সব জীবের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিবছর একই সময়ে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে মাছ আহরণ নিষিদ্ধ থাকবে। এ সময়ে চোরা শিকারিরা যাতে মেতে না উঠতে পারে সে জন্য বনে টহল জোরদার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা ২৪ জুন থেকে সুন্দরবনে প্রবেশের জন্য জেলেদের পাশ পারমিট দেওয়া বন্ধ রেখেছি। ২৩ তারিখ পর্যন্ত যাদের পাশ-পারমিট দেওয়া হয়েছে তাদেরকে ৩০ জুনের মধ্যে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ৩০ জুনের পরে কাউকে বনের ভেতরে পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। 8,953,095 total views, 8,845 views today |
|
|
|