Site icon suprovatsatkhira.com

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তান্ডবে লন্ডভন্ড সাতক্ষীরা বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত বিস্তীর্ণ এলাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে গোটা সাতক্ষীরা জেলা। উপকুলীয় চারটি উপজেলার ২০ টিরও বেশী পয়েন্টে নদ নদীর গ্রাম রক্ষা বেড়িবাঁধ ভেঙে নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। পানিতে ভেসে গেছে হাজার হাজার বিঘা মৎস্য ঘের ও ফসলি জমি। ঝড়ের তান্ডবে উড়ে গেছে কয়েক হাজার কাঁচা বাড়ি ঘর ও বিধ্বস্ত হয়েছে সহস্্রাধিক আধাপাকা বাড়ি। কয়েক লাখ গাছপালা উপড়ে পড়েছে। অনেক রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে সাতক্ষীরার ব্রান্ড খ্যাত আমের।
এদিকে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে নারী শিশু ও বৃদ্ধসহ ৩ লাখ ৭০ হাজার মানুষ সামাজিক দুরত্ব না মেনেই ঠাসা ঠাসি করে অবস্থান করছে। করোনা কালে তাদের আশ্রয় কেন্দ্রে স্বাস্থ্য বিধি মেনে নিয়ে আসা হলেও ঝড়ের রাত থেকে সে অবস্থা আর স্থায়ী হয়নি। ঝড়ের রাতে বাঁধ ভেঙে তিন উপজেলার ২৩ গ্রামে সমুদ্রের লোনা পানি প্রবেশ করায় সেখানে খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
সুন্দরবন সংলগ্ন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পদ্মাপুকুর, গবুরা ও আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের কয়েকটি স্পটে কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া নদীর ভেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চাউলখোলা এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২০০ ফুটের মত এলাকা ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এছাড়া কামালকাটি ও চন্ডিপুর এলাকায় পানি ওভার ফ্লো হয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকছে।

এছাড়া গাবুরা ইউনিয়নের জেলেখানি ও নাপিতখালী এলাকায় বাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এছাড়া আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের সুভদ্রকাটি, কুড়িকাউনিয়া, চাকলা, হিজলা, দিঘলাররাইট, কোলা ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি ঢুকছে বলে নিশ্চিত করেছেন আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মীর আলিফ রেজা। সেগুলি মেরামতের চেষ্টা চলছে।

সাতক্ষীরা জেলার সাতটি উপজেলায় বিভিন্ন ফলজ ও বনজ বৃক্ষ ভেঙে পড়েছে। কিছু কিছু এলাকায় গাছ পড়ে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুতের তারের ওপর গাছ পড়ায় এবং খুটি উপড়ে পড়ায় জেলায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্ধ রয়েছে ইন্টারনেট পরিসেবা। অসংখ্য কাঁচা ঘরবাড়ী ও টিনের চাল উড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

সাতক্ষীরা আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী জানান, ঘন্টায় ১০০-১২০ কিলোমিটার গতিবেগে বিকেল ৪ টার পর থেকে সুন্দরবন উপকুলে আম্পান আছড়ে পড়ে। এরপর সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত ১৪৮ কিলোমিটার গতিবেগে পশ্চিম দিকে ঝড়ো হাওয়াটি জেলা শহরের ওপর আঘাত হানে।

এদিকে শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আ.ন.ম আবুজর গিফারী জানান, আম্পনের কারনে নদীর পানি ৩ থেকে ৪ ফুট বৃদ্ধি পেয়ে নদীর প্রবল জোয়ারে মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের দাঁতনেখালি, দূর্গাবাটি, পদ্মপুকুর ও গাবুরার বেশ কয়েকটি পয়েন্টে ভেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। কয়েকটি স্থানে ওভারফ্লো হয়ে বিভিন্ন এলাকায় পানি ঢুকে বিস্তির্ণ এলাকা প্লাবিত করে। কাঁচা ও টিনের ঘরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গাছ-গাছালি উপড়ে রাস্তা-ঘাট ও বাড়ী ঘরের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। নিকটস্থ এলাকায় মাটি পাওয়া না যাওয়ায় বাঁধ সংস্কারে সমস্যা দেখা দিয়েছে।

সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর আলিফ রেজা জানান, আশাশুনি উপজেলার উপকূলীয় প্রতানগর. ক্রীউলা. আনুলিয়া ও খাজরা ইউনিয়নের অইশে পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে গেছে। ইতোমধ্যে চাকলা, দিঘলারাইট, কুড়িকাউনিয়া, হিজলা, কোলা, শ্রীউলা, হাজরাকালি, দয়ারগাট, বিছট, বাহাদুরপুর গ্রামসহ আরও অনেক গ্রাম প¬াবিত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনই বলা সম্ভব নয়।

আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু হেনা শাকিল জানান, ইউনিয়নের একটিও টিনের ছাউনি ও কাঁচাঘরবাড়ির অস্তিত্ব নেই। সবগুলো ঝড়ে ধসে পড়েছে। টিনের ছাউনি উড়ে গেছে।

কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক রাসেল জানন, ভাড়াশিমলা এলাকার খারহাটে ইছামতি নদীর বাঁধ এবং মথুরেশপুর চিংড়া বাঁধ ভেঙে অনেক কাঁচা ঘর, গাছপালা ভেঙে গেছে। প্লাবিত হয়েছে তিনটি গ্রাম।

দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাজিয়া আফরিন জানান, ঝড়ে উপজেলার প্রায় গুলো গ্রামে ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি নিরুপনে কাজ চলছে।
কলারোয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জানান, উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশী ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। এলাকাটি কপোতাক্ষ তীরে হওয়ায় সেখানে শতাধিক কাঁচা ও আধাপাকা ঘরবাড়ি বিধ্বস্থ হয়েছে। গৃহহীন হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। এ ছাড়া দেয়াড়া জালালাবাদসহ সব গুলো ইউনিয়নে উন্নত জাতের আবাদ করা আমসহ কৃষির ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে।

তালা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ কুমার বলেন, ঝড়ে নদীক‚লের ভ‚মিহীন মানুষের সব ঘরগুলো উড়ে গেছে। ভেঙে পড়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ গাছালি।

সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী জানান, বুধবার রাত ১২টায় ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ঘণ্টায় ৭২ কিলোমিটার গতিবেগে অতিক্রম করছে। ধীরে ধীরে গতিবেগ কমে যাবে। সাতক্ষীরায় সর্বোচ্চ ১৪৮ কিলোমিটার গতিবেগে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান।

এদিকে জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হয়েছে ১৪৫টি সাইক্লোন সেল্টার ও ১ হাজার ৭০০ টি স্কুল কলেজসহ আশ্রয়কেন্দ্রে ৩ লাখ ৭০ হাজার মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। জেলায় ১২ হাজার সেচ্ছাসেবকের পাশাপাশি ১০৩ জনের মেডিকেল টিম স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত রয়েছে।

মরিচ্চাপসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি ২ থেকে ৩ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ও গাবুরা, মুন্সিগঞ্জ ও আশাশুনি উপজেলার দয়ারঘাট, হাজরাকাটি, কুড়িকাউনিয়া, মনিপুরি ও বিছট এলাকার ভেড়িবাঁধে ভয়াবহ ফাটল দেখা দিয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানান, ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা সংশ্লিষ্ট বিভাগকে সাথে নিয়ে তালিকা তৈরির কাজ করছে। তাদের কাছ থেকে তালিকা পেলে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির চিত্র জানা যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাধগুলো জরুরী সংস্কারের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version