Site icon suprovatsatkhira.com

শ্যামনগরের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারেকের মুক্তিযুদ্ধের গল্প

এস এম মোস্তফা কামাল: প্রত্যাশিত আর আত্মত্যাগী অর্জন স্বাধীন বাংলাদেশ। মানবিক মর্যাদাবোধ, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার অশেষ আকুতি, বাঙালিত্বের প্রতি পূর্ণ সমর্থন আর সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্রের বাসিন্দা হবার দুর্নিবার প্রত্যয়ের চূড়ান্ত পটভূমি একাত্তরের ৯ মাসব্যাপী অগ্নিঝরা সংগ্রাম। পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে বিজয়ের যে দলিল বিশ্বের মানচিত্রে রক্তের অক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে, তা এ ভূখন্ডের বাসিন্দাদের স্বাধিকারের দেশপ্রেমের সমুন্নত চেতনা, সংহতি আর অসাম্প্রদায়িক উদার মনোভাব নারই ফসল। মুক্তিযুদ্ধের নির্মম বাস্তবতা আর কালিক বিনষ্টি, ধ্বংস যজ্ঞের ভয়াবহতা আর স্বজন হারানোর হাহাকার, শত্রæকে পরাজিত করে বিজয়ের আনন্দে উল্লাসিত হবার গর্বিত মুহ‚র্তসহ প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন অনুষঙ্গকে ধারণ করে দিনদিন রুদ্ধ হয়ে চলেছে। বিশেষত, ষাটের দশকের গল্পকাররা মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর বৃত্তান্তকে ভিত্তি করে যে-সব গল্প লিখেছেন, সেই ধারার সম্প্রসারণ ঘটছে অজস্র বৈচিত্র আর অনুষঙ্গে, উত্তর প্রজন্মের গল্পকারদের লেখনীতে। ব্যক্তিক অভিজ্ঞতার নির্যাস আর নিজ দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগ, স্বাদেশিকতা প্রভৃতি তাঁদের শিল্পী মানসে যে গভীর অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, এর স্বাক্ষর রয়েছে এসব গল্পের বর্ণনায়, ভাব বস্তু নির্বাচনে, কুশীলবদের আবেগ-সংবেদনা আর উপলব্ধিকে যথোপযুক্ত শব্দরাশির আশ্রয়ে নিবিড়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের গল্প। মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তুঙ্গ ভাব লোকের দিকে ধাবিত করলেও কখনও কখনও পরোক্ষ বর্ণনায়, স্মৃতিচারণে এমনকি নেপথ্যে বিশেষ ভাব পরিমল সঞ্চারের আগ্রহও এক্ষেত্রে সহায়ক হাতিয়ার হিসেবে গল্প দেহে প্রযুক্ত হয়েছে। ফলে কল্পনা এবং বাস্তবের দোলাচল একাকার হয়ে পাঠকের মনোলোকে গড়ে ওঠে এক নতুন ভুবন, যেখানে বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনার সমান্তরালে তাকেই গড়ে নিতে হয় আরেক লেখায় গল্পকারের গল্পে, যা পাঠের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের মুক্তিযোদ্ধার গল্প। ৪ ডিসেম্বর বুধবার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারেক এক সাক্ষাৎকারে দৈনিক সুপ্রভাত সাতক্ষীরা পত্রিকার শ্যামনগর ব্যুরো প্রধান এস এম মোস্তফা কামাল এর সাথে মুক্তিযুদ্ধ গল্প বলেন। শ্যামনগর উপজেলা সদরের সন্নিকটে নকিপুর গ্রামের মৃত জবেদ আলী গাজীর পুত্র জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারেক গাজী। তার দুই পুত্র ও দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক শ্রম ও জনশক্তি কমান্ডার আব্দুল বারেক গাজী মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনালেন। গল্প শোনাতে আবেগ দুঃখ ও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে তার যুদ্ধকালীন ভয়াবহ ঘটনার বিবরণ তুলে ধরলেন। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারেক গাজী জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ ই মার্চের ভাষণ বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে শ্রবণ করে দেশ মাতৃকায় ভক্তি শ্রদ্ধা এনে অনুপ্রেরণা যোগান। সে অনুপ্রেরণায় পাকিস্তানিদের ভয়াবহ অত্যাচার, নির্যাতন, খুন, লুট ও নারী নির্যাতনসহ নানাবিধ অপকর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যে কোন মূল্যে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। শ্যামনগরে পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারে স্কুল কলেজ ছাত্র ও যুবকদের খোঁজ নিয়ে তাদের দলে ভেড়াতে বাধ্য করায় তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সংকল্প করেন। তিনি শ্যামনগরে লতিফ, মজিদ সরদার, ফজলু সহ কয়েকজনকে নিয়ে শ্যামনগরের ভারত সীমান্তে কুলতলী বর্ডার পার হয়ে ভারতের বশিরহাট জামরুলতলায় চলে যান। সেখানে ফজলু এমপি ও আতিয়ার কমান্ডার তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করে ভারতের টাকি থেকে বিহার চাকুরিয়া ট্রেনিং ক্যাম্পে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী দ্বারা ১ মাস ৭ দিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ভারতের নদীয়া জেলার কল্যাণীতে কয়েকদিন প্রশিক্ষণ ফল প্রকাশ করে হাতিয়ার নিয়ে বাংলাদেশের সাতক্ষীরায় হাকিমপুর ক্যাম্পে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধা হাতিয়ার নিয়ে ৩ টি গ্রæপে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারদের উপর হামলা করে। এ হামলা ৬ দিন অনবরত চলতে থাকে। ৫ জন ইপিআর নিহত হলেও শত শত লোক মারা যান। এ সমস্ত এলাকায় ঘরবাড়ি, মিল-কলকারখানা, ফসলি ক্ষেত ও গাছপালা ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়। হাকিমপুর থেকে পুনরায় ভারতের হিংলগঞ্জএ ট্রেনিং করে বাংলাদেশের বসন্তপুর পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়। এখানে কয়েকদিন যুদ্ধ করার পর শ্যামনগরের নৈকাটি ও পরে ভারতে কানাইকাটিতে আশ্রয় নেওয়া হয়। কানাইকাটি থেকে শ্যামনগরে ভয়াবহ যুদ্ধের রুপ নিলে চন্ডিপুরের ফজলু সরদার সহ ৮ জন ধৃত হয় পাকিস্তানিদের হাতে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস সহ ৪ জন শহীদ হয়। কৈখালী ভারত সীমান্তে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে দীর্ঘ ১ মাস যাবৎ গানবোটের সাথে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে অশ্রæ সজলে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারেক জানান, এ সময় শ্যামনগরে যুদ্ধরত অবস্থায় তিনি সহ মজিদ, লতিফ, হাবিল, হাসেম, আবুল, মিজান, নিরাপদ ও ইন্তাজ সহ তাদেরকে পাকিস্তানি সৈন্যরা চার দিক থেকে আটকে ফেলেন। ভয়াবহতার দিক বিবেচনায় এনে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অসহায়ত্বকে সহায়ক শক্তিতে রুপান্তর করে ধানখেত ও খাল-বিল দিয়ে পলায়ন করে ভেটখালী সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দফায় দফায় পাকিস্তানীদের পরাজিত করে মুন্সিগঞ্জ, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, ঝালকাটি হয়ে ঢাকায় গিয়ে যুদ্ধের সমাপ্তি হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের সংবাদ পেয়ে তারা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানেন। মুক্তিযোদ্ধার নেতৃবৃন্দের নির্দেশে ঢাকার মেলোশিয়া ক্যাম্পে হাতিয়ার জমা দিয়ে বীর দর্পে শ্যামনগরে আগমন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারেক। ৬৯ বছর বয়সী আব্দুল বারেক জানান, বর্তমান সরকার তাদেরকে যথেষ্ট মূল্যায়ন অব্যাহত রাখায় তাদের ত্যাগ তিতিক্ষা দুঃখ কষ্ট ভুলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা দেখতে পাচ্ছেন। যে বিক্ষুব্ধ কাল পর্বের ইতিহাস ও জনজীবনের বিপন্নতাকে এসব গল্প ধারণ করেছে, তা থেকে সমসাময়িক বাংলাদেশের সামগ্রিক ধারণা পাওয়া না গেলেও একালের তরুণ প্রজন্ম নিঃসন্দেহে বিষয়টি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠবে। মুক্তিযুদ্ধ একইসঙ্গে আমাদের জাতীয় জীবনের চরম শোক ও পরম প্রাপ্তির অধ্যায়। প্রিয়জনকে হারানোর মর্মন্তুদ বেদনা আর অজস্র বিয়োগব্যথার বিনিময়ে অর্জিত রক্তিম স্বাধীনতার মাহাত্ম্য অনুধাবনে এসব গল্পের প্রাসঙ্গিকতা তাই অনস্বীকার্য বলে দাবি করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারেক। মুক্তিযুদ্ধকে গল্প সম্পর্কে একটি অতি সংক্ষিপ্ত ধারণা দিতে চেষ্টা করেছি। স্বাধীনতার এ মাসে বর্তমান প্রজন্মের জানার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়ায় দৈনিক সুপ্রভাত সাতক্ষীরা পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version