Site icon suprovatsatkhira.com

৭ ডিসেম্বর যে ভাবে শত্রু মুক্ত হয় সাতক্ষীরা

মনিরুল ইসলাম মনি: পাকিস্তানী পতাকায় ছাত্র জনতার অগ্নি সংযোগ, অস্ত্র লুট ও ব্যাংক অপারেশন করে সংগৃহীত অর্থ নিয়ে ৭১ এর মার্চে সাতক্ষীরার দামাল ছেলেরা মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল তারই সফল সমাপ্তি ঘটে ৭ই ডিসেম্বর। ১৯৭১ এর এই দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে দখলদার পাকবাহিনী সাতক্ষীরা ছাড়তে বাধ্য হয়। ওই দিন বীরের বেশে এই মাটির সন্তানরা বাংলাদেশের অর্জিত লাল সবুজের পতাকা কাঁধে নিয়ে স্ব-গৌরবে সাতক্ষীরায় বাংলার পতাকা উত্তোলন করে চুমু খেয়েছিল মাটিতে। আজ সেই ৭ই ডিসেম্বর সাতক্ষীরা হানাদার মুক্ত দিবস।

বিজয়ের গৌরবে ৭১ এর এই দিনে যুদ্ধাহত মানুষ আনন্দে উচ্ছলিত হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেদিনের সাহসী সন্তানরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। পাক হানাদার ও তাদের দোসররা মা-বোনের ইজ্জত হরণ করেছিল। ধ্বংস করতে চেয়েছিল বাঙ্গালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে। শত্রæর বুলেটের এত সব আঘাত সহ্য করেও সাতক্ষীরার সন্তানরা প্রায় ৫০টি যুদ্ধ মোকাবিলা করেছিল। আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ শত্রæর ঘাঁটি দখল ,শত্রæ বিতাড়ন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ৭ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের সেই দিনটি ছিল আনন্দ মিশ্রণের এক ঐতিহাসিক দিন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোন সেক্টর গড়ে ওঠেনি তখনও পরবর্তীতে গড়ে ওঠা ৯ম আর ৮ম সেক্টরের অধীনে সাতক্ষীরার ভোমরা ছিল প্রথম ক্যাম্প। এখানেই সূচনা লগ্ন থেকে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল তৎকালীন ই.পি আরদের সহযোগিতায়। আর এখানেই ২৯ এপ্রিল পাক বাহিনীর সাথে তরুণ নবীন মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দীর্ঘ ১৭ ঘণ্টা উভয় পক্ষের গুলি বিনিময়ে পাক বাহিনী হারিয়েছিল তাদের কয়েক জন সেনাকে। আর দুই দফার যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল তিন বীর যোদ্ধা। সাতক্ষীরার মুক্তিযোদ্ধাদের দেশাত্মবোধ আর বিরচিত যুদ্ধের ফলশ্রæতি হিসাবে ৭১ এর নভেম্বরে শ্যামনগর কালিগঞ্জ শত্রæ মুক্ত হয়। অন্যদিকে ৭ই ডিসেম্বর মুহিদ খান দুলুর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী যোদ্ধা দল ধুলিহর ইউনিয়নের বেজেরডাঙ্গায় তখনও গেরিলা অপারেশনের পরিকল্পনা করছে। এরই মধ্যে খবর এলো পাক বাহিনী সাতক্ষীরা ছাড়তে শুরু করেছে। ক্ষিপ্রবেগে এ দলটি চলে আসে সাতক্ষীরা শহরে। ক্যাম্প করলেন পিএন হাই স্কুলে। এফ এফ (ফিডম ফাইটার) ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার ও হুদার নেতৃত্বে আর একটি দল ঢুকে পড়ে সাতক্ষীরা শহরে। তারা থানা, ডাক বাংলো, পিটিআইতে ঘাটি গাড়ে।

 

এদিকে বীর যোদ্ধা আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে আরও একটি দল এবং মুজিব বাহিনীর বীর যোদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকু, আবু নাছিম ময়না, মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে অবস্থান নেন সাতক্ষীরা শহরে। এই ত্রিমুখী আক্রমণের পালা আসতে না আসতেই খবর এলো পাকবাহিনী ও দোসররা ভয়ে পিছু হটছে। বিজয় গৌরবে কাঁধে পিঠে অস্ত্রের বোঝা আর ট্রিগারে আঙুল রেখে যোদ্ধারা সদর্পে পুন: দখল করলেন তাদের প্রিয় মাতৃভূমি। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে অনেককে হতে হয় শহীদ। সবচেয়ে মারাত্মক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ৭ জুন প্রত্যুষে। দেবহাটা থানার টাউন শ্রীপুরে যে মহা পরিকল্পনা করে পাক বাহিনীর ব্যুহভেদ করার অঙ্গীকার করা হয়েছিল তা ফাঁস হয়ে যায়। এ সত্তে¡ও মুক্তিকামী দামাল ছেলেরা সেদিন তাদের অস্ত্র দিয়ে শত্রæ সেনাদের জবাব পাল্টা জবাব দিয়েছিল। ৯ম সেক্টরের সদর দপ্তর টাকি থেকে তিনটি পৃথক গ্রæপ তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকে পড়ে মাতৃভূমির মাটিতে। টাকির ঠিক বিপরীতে টাউন শ্রীপুর এলাকায় অবস্থান ও টহলরত পাক সেনাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার অদম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়ে ক্যাপ্টেন শাহাজাহান মাস্টারের নেতৃত্বে একটি গেরিলা গ্রæপ অবস্থান নেয় ৬ জুন রাতে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় পরদিন সুযোগ বুঝেই ওদের উপর আক্রমণ চালানো হবে। কিন্তু উপর্যুপরি রাত জাগা যুব সেনারা কেউ তখনও ঘুমিয়ে কেউ বা নাশতা করছে। এমনই এক পর্যায়ে খান সেনাদের তৎপরতা ধরা পড়ে। এ সময় একে অন্যকে সতর্ক করা চলতে থাকে। মুহ‚র্তেই আক্রমণাত্মক গুলি ছুটে যায় পাক বাহিনীর সদস্যদের দিকে। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। মূহু মুহু গুলির রেঞ্জে পড়ে বেশ কয়েকজন পাক সেনা লুটিয়ে পড়ে। অপরদিকে শত্রæদের গুলিতে শহীদ হন কাজল, খোকন, নারায়ন ও এক ইঞ্জিনিয়ার ছাত্র সহ ৭ মুক্তিযোদ্ধা। ওদের রক্তে ভেসে যায় শুষ্ক মাটি। বীরত্বপূর্ণ এ যুদ্ধে ব্রাশ ফায়ারে বেশ কয়েকটি গুলি বিধে যায় এরশাদ খান হাবলুর দেহে। সেদিনের ঐ যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সাতক্ষীরা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মসিউর রহমান মসু, মুনজিতপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ কালীন নৌ-কমান্ড সাতক্ষীরা সদর -২ আসনের এমপি মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবি, সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মো: হাসানুজ্জামান, মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ সরকার জানান, ওরা শহীদ হয়েছিল। এ সীমান্তে মোট ৩৩ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকহায়নাদের গুলিতে শহীদ হয়েছিল। গুলি বিদ্ধ হয়েছিল এরশাদ খান হাবলুসহ আরও কমপক্ষে ২০ জন। তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু এই সম্মুখ যুদ্ধে পলাশপলের কামরুল ইসলাম খানের ভূমিকা ছিল খুবই বিরচিত। পাক বাহিনীর অন্যতম খুঁটি মহকুমা হাকিম খালেদ মাহমুদকে গ্রেফতার, তার অফিসের পাকিস্থানী পতাকা নামিয়ে অগ্নি সংযোগ এবং বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন। ট্রেজারি থেকে অস্ত্র আর ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে অর্থ সংগ্রহ সহ মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্ন থেকে শেষ দিনটি পর্যন্ত কামরুল ইসলাম খান রেখেছেন অগ্রণী ভূমিকা। এই সেক্টরে যুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণকারী মুক্তি যোদ্ধাদের মধ্যে রয়েছেন আইয়ূব আলি, স ম আলাউদ্দীন, সালাম, হাবলু, কামরুজ্জামান, এনামুন হক বিশ্বাস, আবু নাছিম ময়না, গনি, রশিদ, আজিবর, খসরু, হাসনে জাহিদ জজ, ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবুর রহমান, মোস্তাফিজ, স.ম. বাবর আলিসহ অসংখ্য মুক্তি যোদ্ধা তারা আজ স্ব স্ব অবস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে। এদের মধ্যে অনেকে শাহাদাত বরণ করেছেন। দেশ মাতৃকার মুক্তি অর্জনে দক্ষিণ পশ্চিম বাংলার দুর্দান্ত প্রভাবশালী ক্যাপ্টেন শাহাজান মাস্টারও আজ লোকান্তরিত। এদিকে সাতক্ষীরায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৯টি গণকবর ও বধ্যভূমি এবং স্মৃতি স্তম্ভ গুলি আজও অরক্ষিত অবহেলার শিকার। সাতক্ষীরা বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সাথে জড়িয়ে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরল গাঁথা ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল যশোরের কেশবপুর সহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভারতে পাড়ি জমানোর জন্য ৪ শতাধিক শরণার্থী সন্ধ্যায় আশ্রয় নিয়েছিল এই বিদ্যালয়ে। খান সেনারা খবর পেয়ে ওই রাতেই তাদেরকে ধরে নিয়ে বিদ্যালয়ের পিছনে নির্মম ভাবে ব্রাশ ফায়ার ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। পরে সেখানে তাদের মাটি চাপা দেওয়া হয়। সেই ইতিহাস গাঁথা বধ্যভূমিটি বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানার দখলে চলে গেছে। যেটা অনেকে দীনেশ কর্মকারের বাড়ি হিসাবে চীনতো। ইতিহাস গাঁথা বধ্যভূমিটির অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। তা না হলে নতুন প্রজন্ম এর ইতিহাস ঐতিহ্য জানা থেকে বঞ্চিত হবে। এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা সদর এমপি নৌ-কমান্ড বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবি জানান, সাতক্ষীরা বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের পিছনে বধ্যভূমি, বাকাল ব্রিজের বধ্যভূমি, পাটকেলঘাটার পারকুমিরা বধ্যভূমি, আলিপুর, ঝাউডাঙ্গাসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইতিহাস খ্যাত ও গৌরবগাথা গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা হবে। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে গণকবর সংরক্ষণ ও পাকা করণের উদ্যোগ গহন করেছে শেখ হাসিনা সরকার। ৭ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক শত্রæমুক্ত দিবসটি উপলক্ষে সাতক্ষীরা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউনিট কমান্ড এর পক্ষ থেকে সমাবেশ ,শহরে আনন্দ র‌্যালিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version