শেখ শাওন আহমেদ সোহাগ, নিজস্ব প্রতিনিধি: বাল্যবিবাহ সমাজের ব্যাধি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। যে বয়সে কিশোরীদের হাতে বই থাকার কথা সেই বয়সে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়িসহ সন্তান লালন পালন করার মত কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে তাদের। অল্প বয়সে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে এইসব কিশোরীদের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। সরকারি বিধি অনুযায়ী ছেলেদের বিবাহ’র বয়স ২১ এবং মেয়েদের বয়স ১৮ বছর করা হলেও ছেলে- মেয়ের পরিবারের সদস্যদের সমঝোতায় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাল্যবিবাহ হচ্ছে হর-হামেশা।
২০১৫ সালে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলাকে বাংলাদেশের প্রথম বাল্যবিবাহ মুক্ত উপজেলা ঘোষণা করা হয়। অথচ এই ঘোষণা ছিল শুধুই আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে, আবার কখনও প্রশাসনের পরোক্ষ সহযোগিতায় বা খোদ বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটি বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় সম্পন্ন হচ্ছে বাল্যবিয়ে-এমনটাই অভিযোগ সচেতন মহলের।
জানা যায়, গত ১৭ জুন কালিগঞ্জের ভাড়াশিমলা ইউনিয়নের সোনাটিকারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ও সোনাটিকারী গ্রামের হাফেজ আশরাফুল ইসলামের মেয়ে ফারজানা ইয়াসমিনকে জোরপূর্বক একই গ্রামের বাবর আলীর ছেলে আনোয়ারুল ইসলামের (৩৫) সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিয়ের পর লোক জানাজানি হয়ে গেলে ভুক্তভোগী স্কুল ছাত্রীকে পাশ্ববর্তী দেবহাটা উপজেলার নাংলা গ্রামের নুর ইসলাম হুজুরের বাড়িতে আটকে রাখা হয়। পরবর্তীতে মেয়ের বাবা আশরাফ আলী বিষয়টি জানতে পেরে স্থানীয়দের জানালে স্থানীয়রা ফারজানাকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসেন।
এবছরের মার্চ মাসে উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নের মলেঙ্গা গ্রামের রফিকুল ইসলামের মেয়ে ও সুরত আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী হীরা খাতুনের সাথে ওই ইউনিয়নের বন্দিপুর গ্রামের গোলাম রব্বানী গাজীর ছেলে শফিকুল ইসলাম’র (৩১) বাল্যবিবাহ হয়েছে। গত ৮ জুলাই মিথ্যা জন্মনিবন্ধন সনদ প্রদান করে এবং নিজে বিয়ের আসরে উপস্থিত থেকে বাল্যবিয়ে দিতে সহায়তা করার অভিযোগ আছে উপজেলার মথুরেশপুর ইউপি চেয়ারম্যানের রিরুদ্ধে। উপজেলার বসন্তপুর গ্রামে কালিগঞ্জ পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীর সঙ্গে খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা থানার ইলিয়াছ হোসেনের বিয়ের প্রক্রিয়া চলছিল। ওই দিন বেলা ২টার সময় বর পক্ষের লোকজন বাসযোগে মেয়ের বাবার বাড়িতে পৌঁছানোর পর এলাকাবাসী বাল্যবিয়ের বিষয়টি উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শারমিন আক্তারকে অবহিত করে। এরপর মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার অফিসের সুপারভাইজার জয়দেব সরকারের নেতৃত্বে একটি দল ঘটনাস্থলে যাওয়ার সাথে সাথে বর পক্ষের লোকজন দ্রæত বাসে উঠে পালিয়ে যায়। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীর বয়স ১৮ বছর পূর্ণ না হলেও মথুরেশপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৮/৭/২০১৯ তারিখে ভুয়া জন্ম সনদপত্র দেয়ার অভিযোগ ওঠে। সুপারভাইজার জয়দেব সরকার বাল্যবিয়ের বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানিয়ে স্কুল ছাত্রীর মা বাবা’র নিকট হতে লিখিত মুচলেকা নিয়ে তাদের রেহাই দেন। সম্প্রতি ভাড়াশিমলা ইউনিয়নের মোমরেজপুর গ্রামের মঞ্জুর আলীর মেয়ে ও কালিগঞ্জ আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী খাদিজা পারভীনের সাথে মথুরেশপুর ইউনিয়নের গণপতি গ্রামের আব্দুল আজিজ হোসেনের ছেলে আব্দুল আলিমের বাল্যবিবাহ হয়েছে। বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বেজুয়া গ্রামের সুভাষ বসাকের ছেলে পঙ্কজ বসাক’র সাথে দেবহাটা উপজেলার মনোরঞ্জন মন্ডলের দশম শ্রেণিতে পড়–য়া মেয়ে প্রতিমা রাণীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। এছাড়া নলতা ইউনিয়নের ইছাপুর গ্রামের সবুজ মোড়লের মেয়ে ও নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রীর সাথে দেবহাটা উপজেলার জনৈক ব্যক্তির সাথে গোপনে বাল্যবিবাহ হয়েছে। এছাড়াও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি এই উপজেলায় বাল্যবিবাহ হওয়ার অভিযোগ উঠছে। এদিকে বাল্যবিবাহের কারণে একজন নারীর শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. শেখ তৈয়েবুর রহমান জানান, কম বয়সে মা হওয়ার কারণে মা ও গর্ভের সন্তানের শরীরে রক্তশূন্যতাসহ নানা ধরনের রোগের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। গর্ভপাতের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। অনেক সময় মা এবং নবজাতক মারাও যেতে পারে। অপ্রাপ্তবয়স্ক মা প্রতিবন্ধী শিশু জন্মদান করতে পারে। এছাড়াও আরও অনেক উপসর্গ হতে পারে।
বাল্যবিবাহের আইন সম্পর্কে বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট জাফরুল্লাহ ইব্রাহিম বলেন, ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুযায়ী পূর্বে শাস্তি প্রদান করা হতো কিন্তু এটা বাতিল করে ২০১৭ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন চালু করা হয়েছে। সংশোধিত আইনের আওতায় বাল্যবিবাহের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের অপরাধ অনুযায়ী বিভিন্ন দন্ড বা শাস্তির বিধান করা হয়েছে।
কালিগঞ্জ সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সনৎ কুমার গাইন জানান, মানবসমাজে কুসংস্কার ও অজ্ঞতার কারণে বাল্যবিবাহ হচ্ছে। এর কারণে সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে গভীর ক্ষত। একটি মেয়ে তার জীবন সম্পর্কে জানার আগেই সে বউ হচ্ছে, মা হচ্ছে। আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাল্যবিবাহ অত্যন্ত ভয়াবহ একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই আমাদের এই সমস্যার মোকাবিলা করতে হলে সম্মিলিতভাবে কাজ করার বিকল্প নেই। বাল্যবিবাহ রোধ নিয়ে কাজ করা নবযাত্রা প্রকল্পের কালিগঞ্জের ফিল্ড অফিস কো-অর্ডিনেটর আশিষ কুমার হালদার জানান, বাল্যবিবাহ রোধে ‘নবযাত্রা’ প্রকল্প কাজ করে যাচ্ছে। আমরা বাল্যবিবাহ রোধে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক মতবিনিময়, সভা, সেমিনার, কিশোর-কিশোরীদের জন্য জীবন দক্ষতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ, মেইল এনগেজমেন্ট গ্রæপের জন্য জেন্ডার বিষয়ক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন প্রোগ্রাম করে আসছি। এমতাবস্থায় বাল্যবিবাহ রোধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান সচেতন মহল।