Site icon suprovatsatkhira.com

কালের বিবর্তনে হারিয়ে গিয়েছে দেবহাটার ঐতিহ্যবাহী জমিদারি নিদর্শন

মীর খায়রুল আলম: সাতক্ষীরার ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলা দেবহাটা। ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ছোট্ট উপজেলাতে ছিল অসংখ্য নিদর্শনে ভরপুর। উপজেলার অবস্থান ভেদে পূর্বে আশাশুনি উপজেলা, পশ্চিমে ভারত-বাংলা ইছামতি সীমান্ত, উত্তরে সাতক্ষীরা সদর এবং দক্ষিণে কালিগঞ্জ উপজেলা অবস্থান। সময়ের বিবর্তনে আজ হারিয়ে গিয়েছে এখানকার ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন। অসংখ্য দেব দেবীর দীর্ঘ অবস্থানের কারণে এখানকার নাম দেবহাটা হয়েছিল বলে জানা যায়। যে কারণে কালের স্বাক্ষী হিসাবে এখনও দন্ডয়মান ভাবে অস্থান করছে দেবহাটার ঐতিহাসিক বনবিবির বট বৃক্ষ। প্রতি বছরের ১লা মাঘ বনবিবির মঙ্গল কামনায় হাজুত-মানত মেলা পালিত হয়।
তাছাড়া ব্রিটিশ শাসনামলেই দেবহাটায় প্রতিষ্ঠিত হয় পৌরসভা, এখানে ছিল ১৮ জমিদারের বাস। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে ইতিহাস ঐতিহ্যের নিদর্শন। বাংলাদেশ-ভারতের আন্তর্জাতিক সীমানা নির্ধারক ইছামতি নদীর তীরঘেসা টাউন শ্রীপুর, সুশীলগাঁতী ও দেবহাটা পাশাপাশি তিনটি গ্রাম। উপমহাদেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. বিধান চন্দ্র রায়েরও পৈতৃক নিবাস ছিল সাতক্ষীরার এই অজপাড়াগাঁ দেবহাটার টাউনশ্রীপুর গ্রামে। প্রায় ১৫০ বছর আগে দেবহাটার টাউনশ্রীপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেবহাটা পৌরসভা। এই গ্রামে ছিল ১৮ জমিদারের বসবাস। কিন্তু কালের বিবর্তনে সব কিছু হারিয়ে গেছে।
ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা ইছামতি নদী কালিগঞ্জ অভিমুখ থেকে দেবহাটার সীমান্তে প্রবেশ করে নওয়াপাড়া, নাংলা গাংআটি, বসন্তপুর, দেবহাটাসদর, সুশিলগাতি, শিবনগর, টাউনশ্রীপুর, চর-রহিমপুর, ভাতশালা, কোমরপুর সীমানা দিয়ে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার সীমান্তঘেঁসা হাড়দ্দাহর পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে বঙ্গপোসাগর অভিমুখে। ব্রিটিশ শাসনামলে এ অঞ্চলে মানুষের আনাগোনা ছিল ভারতের কলকাতায়। ইছামতির ওপারে ভারতের হাসনাবাদ রেল স্টেশন। যার কারণে ব্রিটিশ শাসনামলে এ অঞ্চলে মানুষের দ্বিতীয় ঠিকানা ছিল কলকাতা। সেদিনের দেবহাটা গ্রাম এখন উপজেলা সদর কিন্তু ঐতিহ্যবাহী টাউন শ্রীপুর পৌরসভা এখন একটি অনুন্নত গ্রাম। সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ইছামতি নদীর তীরঘেসা গ্রামটির নাম টাউন শ্রীপুর। ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের জন্মের আগেই ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৭ সালে দেবহাটাকে পৌরসভা ঘোষণা করে। আর এই পৌরসভার কার্যালয় ছিল দেবহাটার টাউন শ্রীপুর গ্রামে। ওই সময় বিভাগীয় শহর খুলনাতেও পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তৎকালীন ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান শঙ্কর রায় চৌধুরীও ছিলেন এই অঞ্চলেরই একজন। ভারতের সেনা প্রধানের দায়িত্ব পালনকালেই ১৯৯৭ সালে শঙ্কর রায় চৌধুরী তাঁর জন্ম ভিটা টাউন শ্রীপুর গ্রামে এসেছিলেন। পাকিস্থান সরকার সম্ভবত ১৯৫০-১৯৫১ সালে টাউন শ্রীপুর পৌরসভা বিলুপ্ত ঘোষণা করে। পাকিস্তান সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তৎকালীন সময়ে রাওয়ালপিন্ডি হাই হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন জমিদার অনীল স্বর্ণকার। কিন্তু দেবহাটা টাউন শ্রীপুরে আর পৌরসভা ফিরে আসেনি। ১৮ জমিদারের বাস থাকা দেবহাটা, টাউন শ্রীপুর ও সুশীলগাঁতী গ্রামে এখন আর নেই তেমন কোন ঐতিহাসিক নিদর্শন। নিদর্শনের মধ্যে জমিদারদের যে কয়েকটি বাড়ি ও ভিটা ছিল যা সংরক্ষনের অভাবে সেগুলোও এখন স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে। জমিদারদের কেউ কেউ ছিলেন অত্যাচারী, আবার কেউ কেউ ছিলেন মানবদরদি। আবার কোনো কোনো জমিদার সমাজে কিছু অবদানও রেখে গেছেন। দেবহাটার টাউন শ্রীপুরে জমিদারদের বিশাল অট্টালিকা, ধর্মীয় উপাসনালয় ও থিয়েটার রুম যার এখন আর তেমন কোন অস্তিত্ব নেই। ব্রিটিশ আমলের আধাপাঁকা রাস্তা এখন পিচঢালা পথ, যার গন্তব্য দেবহাটা থেকে উঠে এসেছে জেলা শহর অভিমুখে। একই সাথে আধুনিকতার ছোয়ায় হারিয়ে গেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের কুমারদের হাতে তৈরী মাটির নিত্য প্রয়োজনীয় প্রাচীন আসবাবপত্র। হারিয়ে গেছে এই এলাকার মানুষের কাছ থেকে তাদের সে সময়ের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম গ্রামীণ হেলিকপ্টার। আধুনিকতার ছোয়ায় সব মিলিয়ে এখানকার শান্তি প্রিয় মানুষ যেমন পেয়েছে চলাচলের পাকা রাস্তা, সুন্দর মনোরম পরিবেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাতের নাগালে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, এমনকি ম্যানগ্রোভ বনের মত একটি সুন্দর নিদর্শন। যা এ উপজেলার পর্যটনের হাতছানি দিচ্ছে। তার পরও প্রাচীন সেই নিদর্শন গুলো এখানকার মানুষের চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version