নিজস্ব প্রতিনিধি: সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যন্ত্রপাতি সরবরাহের নামে সাজানো টেন্ডারে শতভাগ সরকারি অর্থ লোপাটের ঘটনায় মামলা দায়ের হয়েছে। মঙ্গলবার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) খুলনা জেলা সমন্বিত কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করা হয়। দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক জালালউদ্দিন বাদী হয়ে এ মামলাটি করেন। মামলায় সাতক্ষীরার তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. তওহীদুর রহমানসহ ৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর আগে দুদকের অনুসন্ধানে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যন্ত্রপাতি সরবরাহের নামে সাজানো টেন্ডারে শতভাগ সরকারি অর্থ লোপাটের প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকার কার্যাদেশের মধ্যে ১৬ কোটি ৬১ লাখ টাকাই লোপাট করা হয়েছে। বাকি প্রায় ২ কোটি ২৬ লাখ টাকা কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ কেটে রাখা হয়। যন্ত্রপাতি কেনাকাটার নামে ভুয়া রেজিস্টার দেখিয়ে আত্মসাতের রাস্তা তৈরি করেন সাতক্ষীরার তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. তওহীদুর রহমান। তার তত্ত¡াবধানে ঠিকাদারসহ ৮ সদস্যের একটি সিন্ডিকেট নানা কৌশলে ওই হাসপাতালের কেনাকাটাসহ অন্যান্য খাতে এক বছরের জন্য সরকারি বরাদ্দের পুরোটাই গিলে ফেলে। দূর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নিবিড় অনুসন্ধানে এসব তথ্য মিলেছে বলে জানা গেছে। দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তারা বলেন, সাতক্ষীরায় সরকারি হাসপাতালে কেনাকাটার নামে প্রায় শতভাগ অর্থ জালিয়াতির মাধ্যমে লোপাট করা হয়েছে। এই দূর্নীতির সঙ্গে সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. তওহীদুর রহমানসহ ৯ জন জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। এর সঙ্গে জড়িত সিভিল সার্জন ছাড়াও আরও ৮ জনের মধ্যে একই পরিবারের চারজনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
মামলার অন্য আসামীরা হলেন, রাজধানী ঢাকার ২৫/১, তোপখানা রোডের বেঙ্গল সায়েন্টেফিক অ্যান্ড সার্জিকেল কোম্পানির কর্ণধার মো. জাহেরউদ্দিন সরকার। তার ছেলে মো. আহসান হাবিব। জাহের উদ্দিনের বাবা মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার হাজী আবদুস সাত্তার সরকার এবং তার ভগ্নিপতি ইউনিভার্সেল ট্রেড কর্পোরেশনের কর্ণধার মো. আসাদুর রহমান। এই চারজনের নামে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ২৫/১ নং তোপখানা রোড। দূর্নীতির সঙ্গে জড়িত চক্রের অপর সদস্যরা হলেন, সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন দফতরের স্টোরকিপার একেএম ফজলুল হক, হিসাবরক্ষক আনোয়ার হোসেন, জাহের উদ্দিন সরকারের নিয়োগকৃত প্রতিনিধি কাজী আবু বকর সিদ্দিক ও মহাখালী নিমিউ অ্যান্ড টিসির সহকারী প্রকৌশলী এএইচএম আবদুল কুদ্দুস। দুদকের অনুসন্ধানে সিভিল সার্জন ডা. তওহীদুর রহমানসহ এই ৯ জনের বিরুদ্ধে ১৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডা. তওহীদুর রহমান ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও এর আওতাধীন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনার একটি তালিকা তৈরি করেন। তালিকা অনুযায়ী এর স্পেসিফিকেশন ও বর্তমান বাজারদর প্রেরণের জন্য মহাখালীর নিমিউ অ্যান্ড টিসির চিফ টেকনিক্যাল ম্যানেজারকে অনুরোধ করেন। তা পাওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের সহকারী প্রকৌশলী এএইচএম আবদুল কুদ্দুস নিজেই টেন্ডার সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে নিজে তৎপর হয়ে ওঠেন। কোনো ধরনের বাজারদর সংগ্রহ বা যাচাই না করে ১৫৯ ধরণের মেডিকেল যন্ত্রপাতির স্পেসিফিকেশনসহ নিজের মনগড়া দর তৈরি করে সাতক্ষীরায় সিভিল সার্জনের কাছে পাঠান। ওই স্পেসিফিকেশনসহ দরপত্র পেয়ে তৎপর হয়ে ওঠেন সিভিল সার্জন ডা. তওহীদুর রহমান। তিনি সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা হাসপাতালের চাহিদাপত্র বা প্রয়োজন না থাকা সত্তে¡ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৫৯ ধরনের যন্ত্রপাতি কিনতে ২০১৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর টেন্ডার বা দরপত্র আহবান করেন। টেন্ডার আহবানের পর আগে থেকে ঠিক করে রাখা একই পরিবারের মালিকানাধীন তিনটি প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেয়। বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিক্যাল কোম্পানি, ইউনিভার্সেল ট্রেড কর্পোরেশন ও মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের তিন প্রতিষ্ঠান সাজানো টেন্ডারে অংশ নিয়ে পরিকল্পনামতো দর দিয়ে আলাদাভাবে দরপত্র জমা দেয়। অনুসন্ধানকালে দুদক জানতে পারে, মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের লাইসেন্স জাহের উদ্দিন সরকারের পিতা মো. আবদুর সাত্তার সরকার এবং ছেলে মো. আহসান হাবীবের যৌথ নামে। বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিক্যাল কোম্পানির লাইসেন্স তার নিজ নামে এবং ইউনিভার্সেল ট্রেড কর্পোরেশনের লাইসেন্স তার ভগ্নিপতি মো. আসাদুর রহমান নামে করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কাগজ-কলমে তিনটি প্রতিষ্ঠান দেখা গেলেও বাস্তবে দাখিলকৃত তিনটি দর প্রস্তাবকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক মূলত জাহের উদ্দিন সরকারই।
অফিস প্রধান হিসেবে জাহের উদ্দিন সরকার নিজেই যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করেন। মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের পক্ষে আর্থিক ক্ষমতা ছাড়া দরপত্র দাখিলসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তার ম্যানেজার (প্রশাসন ও অপারেশন) কাজী আবু বক্কর সিদ্দিককে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি প্রদান করেন। কাজী আবু বক্কর সিদ্দিক দাখিলকৃত দরপত্রে কৌশলে অন্যান্য দরপত্রের চেয়ে আইটেম অনুযায়ী কম মূল্য উল্লেখ করেন। অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভায় ওই তিনটি দরপত্র গ্রহণযোগ্য হয়। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে সদস্য হিসেবে মহাখালীর নিমিউ অ্যান্ড টিসির সহকারী প্রকৌশলী এএইচএম আবদুল কুদ্দুস অন্তর্ভুক্ত হন। অথচ তার কর্তৃপক্ষ তাকে এ কাজে মনোনয়ন করেনি। তিনি অবৈধভাবে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে উপস্থিত হয়ে মনগড়া দর গ্রহণে সহায়তা করেন। পরিকল্পিতভাবে দর দিয়ে সর্বনিæ দরদাতা হন মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। এভাবে সাজানো দরপত্রে সিভিল সার্জন ডা. তওহীদুর রহমান ২০১৮ সালের ১৩ মে ১০৬টি আইটেমের যন্ত্রপাতির জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (কার্যাদেশ) প্রদান করেন। ওইদিনই তিনি জাহের উদ্দিন সরকারের মনোনীত প্রতিনিধি কাজী আবু বক্কর সিদ্দিকের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেন। চুক্তি অনুযায়ী ১০৬ আইটেমের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই ভুয়া চালান ওই বছর ৩১ মে সিভিল সার্জন বরাবর দাখিল করে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের স্টোরকিপার একেএম ফজলুল হক তাতে স্বাক্ষর ও সিল দিয়ে যন্ত্রপাতিবিহীন চালান গ্রহণ করেন। পরে তিনি (একেএম ফজলুল হক) সার্ভে কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর স্ক্যান করে চালানের অপর পৃষ্ঠায় বসিয়ে ৭ জুন যন্ত্রপাতি সার্ভে হয়েছে মর্মে উল্লেখ করেন। তাতে তিনি নিজে স্বাক্ষর করে সিল প্রদান করেন। এছাড়া স্টক রেজিস্টারে মেডিকেল অফিসারের প্রত্যয়ন করার নিয়ম থাকলেও তা না করে সিভিল সার্জন ডা. তওহীদুর রহমানের প্রত্যয়নে নতুন স্টক রেজিস্টার খুলে ১৩ মে স্টক রেজিস্টারে মিথ্যাভাবে যন্ত্রপাতি সরবরাহ দেখানো হয়। স্টক রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ যন্ত্রপাতি সরবরাহ বুঝে নেয়ার সত্যতা প্রমাণে রেজিস্টারের রিমার্কস কলামে ডা. তওহীদুর রহমান স্বাক্ষর করেন। যা ছিল অবৈধ। দুদকের অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, এরপরও দরপত্র আহবান না করে ডা. তওহীদুর রহমান পরে আরও দু’দফায় মিথ্যা চালানে স্বাক্ষর করেন।
বিষয়টি ফাঁস হলে তড়িঘড়ি ওই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার জাহের উদ্দিন সরকার বিভিন্ন স্থান থেকে কিছু যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে তার প্রতিনিধির মাধ্যমে স্টোরকিপার একেএম ফজলুল হক ও আনোয়ার হোসেনের সহায়তায় সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন অফিসের ইপিআই স্টোরে এবং অফিসের বারান্দায় বেশ কিছু বাক্স বন্ধ অবস্থায় রাখার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া কিছু যন্ত্রপাতি খোলা অবস্থায় সদর হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার ও অন্যান্য স্থানে রাখা হয়।
এ বিষয়ে দুদকের খুলনার উপ-পরিচালক নাজমলি হাসান তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান বুধবার মামলার তথ্য দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হবে। এরপর তাদের গ্রেপ্তারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দূর্নীতি
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/