শেখ শাওন আহমেদ সোহাগ, কালিগঞ্জ: সাতক্ষীরার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে আদি যমুনা নদী।
বঙ্গোপসাগর থেকে সুন্দরবন হয়ে শ্যামনগর-কালিগঞ্জ স্পর্শ করে ইছামতি-কালিন্দীর সংযোগ পর্যন্ত আদি যমুনা নদী বিস্তৃত। যার কুল কুল ধ্বনিতে মুখরিত ছিলো সাতক্ষীরার দক্ষিণ জনপদ। ৩২ কিলোমিটার দৈঘ্যের এ নদীর সাথে ৫০টিরও বেশি বিল ও খালের সংযোগ ছিলো। তবে সেই আদি যমুনা নদীর এখন আর কোন স্রোত নেই, কোন কুল কুল ধ্বনিও নেই। বরং আছে হাহাকার আর অতীতের ধূসর স্মৃতি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, স¤্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ এ অঞ্চলের স্বাধীন নৃপতি রাজা প্রতাপাদিত্যের সাথে এই নদীতেই নৌযুদ্ধে লিপ্ত হন। মোঘল আমলে স্বাধীন নৃপতিগণ যমুনার দুই তীরে সেনা ঘাটি, নৌপোতসহ অসংখ্য স্থাপনা নির্মাণ করেন। তার মধ্যে কালিগঞ্জের মৌতলার জাহাজঘাটা এবং শ্যামনগরের ইশ্বরীপুরের হাম্মামখানা আজও সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে। ইংরেজ বণিক ফ্রেডারিক ডুডলির নাম অনুসারে দুদলি গ্রাম এবং রাজা বসন্ত রায়ের নাম অনুসারে বসন্তপুর গ্রাম যমুনা নদীর তীরে আজও অতীত স্মৃতি বহন করে চলেছে।
জানা যায়, যমুনা নদী হয়ে ইউরোপ থেকে বণিকরা ভারতের কলিকাতা পর্যন্ত বাণিজ্যিক জাহাজ এবং সৈন্যবাহি জাহাজ পরিচালনা করতো। সুন্দরবন হতে ফিরিঙ্গী, বর্গী এবং বর্মী জলদস্যুরা শ্যামনগর ও কালিগঞ্জের যমুনা নদীর তীরবর্তী গ্রামে হানা দিতো। কেউ কেউ বলে থাকেন-সম্ভবত এ কারণেই কবি লিখেছেন, ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে’। এই রূপ স্মৃতি বিজড়িত ছিলো আদি যমুনা নদী।
ঐতিহ্যের এই আদি যমুনা নদীতে একসময়ে চলতো বড় বড় জাহাজ, পালতোলা নৌকা, নদীকে ঘিরে জীবিকা নির্বাহ করতেন সাধারণ মানুষ। কিছুকাল আগেও এই নদীতে ছিল দু’কুল ছাপানো ঢেউ। আজ সেসব কথা যেন শুধুই স্মৃতি। পলি জমে নদীর তলদেশ ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় ভূমিদস্যু কর্তৃক নদীর দু’পাশ ভরাট করায় এর প্রশস্ততা কমে যাচ্ছে। যমুনা নদীতে নেট-পাটা ব্যবহার করে মাছ ধরার কারণে নদীর পানি প্রবাহের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই নদী এখন খালে পরিণত হয়েছে।বর্ষাকালে পানির মৃদু প্রবাহ থাকলেও শুকনো মৌসুমে বহুস্থানে পানি থাকে না। কালিগঞ্জ উপজেলার মথুরেশপুর, পিরোজপুর, দুদলি, রায়পুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নদীর মাঝে স্থানীয়দের কেউ কেউ নেট-পাটা ব্যবহার করছে। যার কারণে নদীর পানি প্রবাহের ব্যাপক বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। নদীর পাশে প্রভাবশালীরা বিভিন্ন কারখানা নির্মাণ করেছে। এসব কারখানার বর্জ্য নদীতে ফেলছে। ফলে নদী ভরাট হওয়াসহ পানি দূষিত হচ্ছে। বর্তমানে কালিগঞ্জের সীমান্ত পেরিয়ে শ্যামনগর উপজেলার প্রবেশের পর যমুনার নদী আর দৃশ্যমান নয়। নদী খেকোরা সবটাই গিলে খেয়েছে। নদীর উপর ইট ভাটা, রাস্তা, বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ হয়েছে।
যমুনা বাঁচাও আন্দোলনের কালিগঞ্জ উপজেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাফরুল্লাহ ইব্রাহিম বলেন, ইছামতি নদী থেকে উৎপত্তি শ্যামনগর-কালিগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আদি যমুনা নদীর একসময়ে ভরা যৌবন ছিলো। এককালের প্রমত্তা যমুনা জবর দখলের কারণে নাব্যতা হারিয়েছে। নদীর দু’পাশে প্রভাবশালীরা দখল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করছে, যা নিন্দনীয়।
উপজেলার কুশুলিয়া ইউনিয়নরে মহৎপুর এলাকার অসিত সেন জানান, আদি যমুনা নদী এখন প্রায় মরে গেছে। এইভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে নদীর আর কোন অস্তিত্ব থাকবে না। তিনি আরও বলেন, এই নদীর পানি ব্যবহার করে কৃষকরা তাদের ফসলের জমিতে সেচ দিতো। জেলেরা নদীতে জাল পেতে মাছ ধরে সেই মাছ বাজারে বিক্রি জিবিকা নির্বাহ করতো।
বর্তমানে কতিপয় স্বার্থান্বেষী ভূমিদস্যু নদী দখলের উৎসবে মেতে উঠেছে। জনগুরুত্ব¡পূর্ণ এই নদী দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করায় পানি প্রবাহ চরমভাবে বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে এই অঞ্চলের মানুষ চরম ক্ষতির সম্মুখিন হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রয়েছে নীরব দর্শকের ভূমিকায়। অবৈধ দখলকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় তিনি ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। এমনতাবস্থায় অতিদ্রæত যমুনা নদীর পানি প্রবাহ সৃষ্টির জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সচেতন মহল।
সাতক্ষীরার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে আদি যমুনা নদী
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/