যশোর প্রতিনিধি: সফলতার দ্বারপ্রান্তে যশোর শিক্ষাবোর্ডের অনলাইন প্রশ্নব্যাংক। ইতোমধ্যে বোর্ডের চাহিদার আটগুণ প্রশ্ন জমা পড়েছে এ ব্যাংকে। যা দিয়ে শিক্ষাবোর্ড জেএসসি এবং এসএসসির নির্বাচনীসহ অভ্যন্তরীণ সব পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারছে। পর্যায়ক্রমে যশোর শিক্ষাবোর্ডের আওতায় আনুমানিক ৫০ হাজার শিক্ষককে প্রশ্নব্যাংকের আওতায় আনার চেষ্টা করা হবে শিক্ষাবোর্ডের পক্ষ থেকে।
যশোর শিক্ষাবোর্ডের অধীন প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষককে সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন তৈরি করার জন্যে উৎসাহিত করা হচ্ছে। প্রশ্নব্যাংকের আওতায় এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রত্যেক শিক্ষক যাতে প্রশ্ন তৈরির কাজটি যথাযথভাবে করেন সেটি রীতিমত তদারকি করা হবে। জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসাররা এ ধরনের তদারকি করবেন বলে শিক্ষাবোর্ড কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। একইসাথে প্রশ্নব্যাংকের কারণে বছরে কমপক্ষে ৬৫ লাখ টাকা খরচ কমবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর।
শিক্ষাবোর্ডসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, প্রশ্নব্যাংক কেবলমাত্র প্রশ্নের জন্যে তৈরি হয়নি। এটি প্রাথমিকভাবে যশোর শিক্ষাবোর্ডের অধীন প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষককে পাঠ্যপুস্তক পড়তে বাধ্য করবে। কারণ তাদেরকে প্রশ্নব্যাংকে বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন আপলোড করতে হবে। যারা এটি করবেন না তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সংশ্লিষ্ট দপ্তর।
কেবল প্রশ্নপত্র সরবরাহ না, প্রশ্নব্যাংক প্রশিক্ষকেরও ভূমিকা পালন করবে। কারণ, ৫০ হাজার শিক্ষক দায় এড়াতে যে যার মতো করে প্রশ্ন লিখে আপলোড করলেই প্রশ্নব্যাংকের সফটওয়্যার তা গ্রহণ করবে না। প্রশ্নটি অবশ্যই সৃজনশীল পদ্ধতিতে হতে হবে। আর সৃজনশীল পদ্ধতিতে হতে হলে চার ধাপে প্রশ্ন তৈরি হতে হবে। এটি আত্মস্থ করতে পাঠ্যপুস্তক পড়ার কোনো রকম কোনো বিকল্প নেই। কারণ পাঠ্যপুস্তকের প্রতিটি অধ্যায়ের প্রথমে থাকা শিখন ফল প্রশ্নব্যাংকের সফটওয়্যারে দিতে হবে। এসব শিক্ষককে আলাদাভাবে কোনো প্রশিক্ষণ নেয়া লাগবে না। প্রশ্নব্যাংকে নিজেদের তৈরি প্রশ্ন আপলোড করতে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তিনি প্রশিক্ষিত হয়ে যাবেন।
শিক্ষাবোর্ড কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, একজন শিক্ষক যতখুশি, যখন খুশি প্রশ্ন আপলোড করতে পারবেন। ওই শিক্ষকের কোনো প্রশ্ন যদি পাবলিক পরীক্ষার জন্যে গৃহিত হয় তাহলে তিনি বাড়ি বসে তার জন্যে সম্মানি পাবেন। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতে এবং শিক্ষামন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রশ্নব্যাংক শতভাগ বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লেগেছে যশোর শিক্ষাবোর্ড। কারণ এ মডেল জাতীয়ভাবে বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। কেবল তাই না, এটি বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায়ও ব্যবহার হতে পারে। বোর্ড কর্মকর্তারা বলছেন, দু’এক বছরের মধ্যে অভিন্ন প্রশ্নে সারাদেশে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে পারে। তখন প্রশ্নব্যাংক শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে যথেষ্ট সহযোগিতা করতে পারবে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। এতদিন জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসাররা প্রশ্নব্যাংক সম্পর্কে এক প্রকার অজ্ঞ ছিলেন। তারা এ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতেন না। ফলে, প্রশ্নব্যাংকের কার্যক্রম নিয়ে শিক্ষকরা কী করেন না করেন সে সম্পর্কে কোনো তদারকি করতেন না শিক্ষা কর্মকর্তারা। সেই অবস্থা সামনে আর থাকছে না।
শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ তাদের আওতাধীন সকল জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে বোর্ডে ডেকে প্রশ্নব্যাংক সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে। কেবল তাই না। অনলাইন প্রশ্নব্যাংকের সফটওয়্যারের মাধ্যমে জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসাররা যাতে মনিটরিং করতে পারেন সেজন্যে নতুন করে অপশন চালু করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ওই অপশনটি চালু হলে শিক্ষা অফিসাররা নিজ নিজ দপ্তরে বসে দেখতে পারবেন কোন প্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষক কী করছেন। কারা প্রশ্ন আপলোড করেছেন। কারা সময়মতো প্রশ্নপত্র ডাউনলোড করেছেন ইত্যাদি। মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা অফিসারদের তদারকি বৃদ্ধি পেলে শিক্ষকরা চাইলেও আর ফাঁকিবাজি করতে পারবেন না। একইসাথে প্রশ্নব্যাংকে জমা হবে লাখ লাখ প্রশ্ন। যেখান থেকে যাচাই বাছাই করে মানসম্মত প্রশ্নপত্র তৈরি করা সহজ হবে।
প্রশ্নব্যাংক কেবল প্রশ্নপত্রের স্বচ্ছতা এবং নির্ভুলতা আনবে না। অভিভাবকদের অর্থনৈতিক সাশ্রয়ও দিবে। সরকারের নীতি নির্ধারকরা যেসব কারণে এটি গ্রহণ করেছেন তার মধ্যে এটি একটি। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১৭টি বিষয়ের প্রশ্নপত্রের জন্যে শিক্ষাবোর্ড মাত্র ১০ টাকা করে গ্রহণ করবে। বোর্ড কর্মকর্তাদের ধারণা, একটি শ্রেণির সবকটি প্রশ্নপত্র ছাপা পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৭০ থেকে ৮০ টাকা খরচ হয়। সেখানে প্রশ্নব্যাংক থেকে প্রশ্নপত্র গ্রহণ করে খরচ হবে মাত্র ১০ টাকা। সেই হিসেবে যশোর শিক্ষাবোর্ডে অধীন দু’ হাজার ৮শ’ স্কুলের ৯৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ কমবে। এসব কারণে প্রশ্নব্যাংকের উদ্যোগে অভিভাবকরাও খুশি। তারা বলছেন, এতে শিক্ষকদের অনৈতিকতা দূর হবে। এক ধরনের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাবেন অভিভাবকরা।
এদিকে, প্রশ্নব্যাংক থেকে প্রশ্নপত্র ডাউনলোডের ক্ষেত্রে প্রত্যেক প্রধান শিক্ষককে শতভাগ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কোনো কারণে যদি প্রশ্নব্যাংকের প্রশ্ন ‘এদিকওদিক’ হয় তার জন্যে সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষকই দায়ী থাকবেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, পরীক্ষা শুরুর মাত্র দু’ ঘণ্টা আগে প্রধান শিক্ষকের আইডিতে প্রশ্নপত্র দেয়া হবে। তিনি তার নিজের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে ওই প্রশ্নপত্র ডাউনলোড করবেন। আর এটি করার সময় যদি কোনো রকম ফাঁস হয় তাহলে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে মন্ত্রণালয়। এমনকী তার বেতন বন্ধসহ কঠোর শাস্তির আওতায় আনার চিন্তা করছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
প্রধান শিক্ষকদের দুর্বল দিক যেগুলো শিক্ষাবোর্ড কর্মকর্তাদের চোখে ধরা পড়েছে তা হচ্ছে, প্রধান শিক্ষকরা তাদের পাসওয়ার্ড অন্য শিক্ষকদের কাছে দিয়ে প্রশ্নপত্র ডাউনলোড করতে বলেন। যেকারণে পরীক্ষা শুরুর আগেই জানাজানি হওয়ার একটা ভয় থেকে যায়। আবার ডাউনলোডের পর ফটোকপি করার সময় ওই দোকানে মূলকপি রেখে আসার ঘটনাও ধরা পড়েছে। যার ফলে ফটোকপির দোকান থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। এসব কারণে প্রধান শিক্ষকরা যাতে নিজেরাই প্রশ্নপত্র ডাউনলোড করেন সেই বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষাবোর্ড।
শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু কিছু শিক্ষকের কারণে শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমান সরকারের অর্জন ¤øান হয়ে যাচ্ছে। ওইসব শিক্ষকের অনৈতিকতার কারণে ভালো কাজে গøানি লাগছে। প্রশ্নব্যাংক এসব অনৈতিক কর্মকান্ড ঠেকাবে। এই অনলাইন পদ্ধতি যশোর শিক্ষাবোর্ডে শতভাগ বাস্তবায়নের পর যখন অন্যান্য বোর্ডেও কার্যকর হবে তখন গোটা দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে বলে মনে করছেন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ নীতিনির্ধারকরা।
এসব বিষয়ে যশোর শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর মাধব চন্দ্র রুদ্র বলেন, অনলাইন প্রশ্নব্যাংক সফলতার দ্বারপ্রান্তে। শিক্ষাবোর্ডের পূর্ণাঙ্গ সেট প্রশ্ন করতে একশ’ দুটির মতো প্রশ্ন লাগে। সেখানে আটশ’ প্রশ ইতোমধ্যে জমা পড়েছে। প্রশ্ন ব্যাংক শিক্ষকদের দক্ষ করে তুলবে। এসব কারণে বোর্ডের অধীন সকল শিক্ষককে পর্যায়ক্রমে প্রশ্ন আপলোড করতে নানাভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
সফলতার দিকে যশোর শিক্ষাবোর্ডের অনলাইন প্রশ্নব্যাংক
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/