Site icon suprovatsatkhira.com

আইলায় বিধ্বস্ত বাধ নির্মাণ: একটি গণআন্দোলন

অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী
আজ ভয়াল ২৫ মে, আইলা দিবস। এদিন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগের প্রথম আঘাতে আক্রান্ত হয় গাবুরা পদ্মপুকুরসহ সাতক্ষীরার নিন্মাঞ্চল। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে আলোচনা হচ্ছিল যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলসহ সমুদ্র সংলগ্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে। শ্যামনগরের গাবুরার মত দ্বীপ ইউনিয়নের অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়ার আশংকা বেশী। বিষয়টি নীতি নির্ধারক কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করানো ছিল জরুরী। যেহেতু পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটে চলেছে, সেহেতু গাবুরার মত দ্বীপাঞ্চলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সম্ভাব্য পদক্ষেপ কি হতে পারে, তা নিয়ে ভাবা জরুরী ছিল।
উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ ব্যবস্থাপনাকে বিবেচনা না করে তথা কথিত সবুজ বিপ্লবের কথা বলে উপকূলীয় অঞ্চল দিয়ে নির্মাণ করা হয় উপকূলীয় বাঁধ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেতৃত্বে তৈরী বাঁধ উপকূলীয় নদীর প্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সাগর সংযুক্ত সকল প্রবাহমান নদীতে আড়াআডি বাঁধ দিয়ে প্রবাহ বিচ্ছিন্ন করা হয়। নদীর পানি ঠেকাতে যেয়ে পানির সাথে আসা পলিকে বাঁধের বাইরের নদীতে পড়ার ব্যবস্থা করে দেয়। ফলে দ্রুত নদীর তলদেশ উঁচু হতে শুরু করে। অন্যদিকে বাধের কারণে অভ্যন্তরীণ নদী, খালসমূহ প্রবাহ হারিয়ে দ্রুত ভরাট হতে হয়ে জলপ্রবাহের পথ রুদ্ধ করে তোলে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের স্ফীত পানি ধারণ করার ক্ষমতা বাধের বাইরের নদী যেমন হারিয়ে ফেলে, তেমনি দীর্ঘদিন ধরে অবহেলার কারণে বাঁধের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সবুজ বিপ্লবের গালভরা বুলি ব্যর্থ করে ৮০ দশক থেকে শুরু হয় কৃষি জমিতে লোনা পানি তুলে বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষ। আর্ন্তজাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা অত্যধিক থাকায় দ্রুত অপরিকল্পিত চিংড়ী চাষের আওতায় সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনির প্রায় সমগ্র উপকূলীয় এলাকা চলে আসে। এতে লাগামহীন মুনাফার আগ্রাসনে বাঁধের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়ে। পাউবোর অসৎ কর্মকর্তাদের অবৈধ সুবিধা প্রদান করে যত্রতত্র বাধ কেটে বা বাধ ফুটো করে লোনা পানি উত্তোলনের পথ তৈরী করা হয়। ফলে বাঁধের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়ে। অবৈধ চিংড়ী চাষের প্রভাবে দ্রুত ক্ষুদ্র জমির মালিকরা জমি হারায় আর ব্যাপক সংখ্যক কৃষি শ্রমিক ও বর্গাচাষী কর্মহীন হয়ে পড়ে। এলাকাতে চিংড়ী চাষকে নীল চাষের আগ্রাসী রূপের সাথে তুলনা করে অবিলম্বে বন্ধ করা বা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আন্দোলন গড়ে উঠে। পাশাপাশি দুর্বল বাধকে সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের দাবি তোলা হয় জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা থেকে উপকূলীয় জনপদকে নিরাপদ রাখতে।
উপকূলীয় বাঁধ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ- পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রম নিয়ে মানুষের অভিযোগ ছিল প্রথম থেকেই। বাঁধ নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও বাঁধের সাথে যুক্ত স্লুইস গেটসমূহের ব্যবহারের মাধ্যমে এলাকা ঝুঁকিমুক্ত করার কাজে ছিল সীমাহীন অনীহা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সাথে পাউবোর ছিল ব্যাপক দূরত্ব। ১৯৮০ সালের পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে বাঁধ সংস্কার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। নিয়মিত বাঁধ সংস্কার না হওয়ায় বাঁধের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। বাঁধ এতই জীর্ণ হয়ে পড়ে যে অনেক স্থানে পায়ে হেটে চলাও ছিল দুষ্কর। চিংড়ি ঘের মালিকরা অবৈধভাবে ঘেরে লোনাপানি তুলতে বাঁধ কেটে বা ফুটো করে পাইপ ঢুকায়, যা বাঁধকে আরো দুর্বল করে দেয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড বিষয়টি সম্পর্কে জ্ঞাত থাকলেও কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। ফলে বাঁধ পুরোপুরি ভংগুর হয়ে পড়ে।
পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগরের পানির স্তর বেড়ে যাওয়ায় উপকূলীয় এলাকা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত প্রচার হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রগতিসহ সম-চেতনার কয়েকটি উন্নয়ন সংগঠন উপকূলীয় বাঁধ ব্যবস্থাপনার বিষয় ও পরিকল্পিত প্রবাহ সৃষ্টির মাধ্যমে উপকূলীয় ভূমি উঁচু করে মানুষের আবাসকে নিরাপদ করার বিষয়টি স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারের উপর মহল পর্যন্ত অবগত করানোর কাজ শুরু করে। জাতীয় পর্যায়ে অক্সফাম জিবি এর সহযোগিতায় গড়ে ওঠা গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়ীত্ব¡শীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান-সিএসআরএল এ কার্যক্রমের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। বিশেষ করে শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা সকল মহলে তুলে ধরা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে গাবুরা। প্রগতি, সিএসআরএল এর মাধ্যমে সুন্দরবন সংলগ্ন দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার মানুষের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির বিষয়টি বোঝাতে সক্ষম হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অক্সফ্যাম ইন্টারন্যাশনাল এর পক্ষ থেকে ভিডিও ডকুমেন্টশন করার একটি উচ্চ পর্যায়ের দল ১১ মে ২০০৯-এ গাবুরাতে আসে। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলোÑএ ভিডিও ডকুমেন্টেশন কার্যক্রমের পরিসমাপ্তি ঘটে ২৫ মে আইলায় সম্পদ ও প্রাণহানির ঘটনার বাস্তব দৃশ্য দিয়ে।
২৫ মে আইলার আক্রমণের আগে থেকেই প্রগতি ঝুঁকিযুক্ত উপকূলীয় বাঁধ সংস্কার, জলবায়ুর উষ্ণতার কারণে বেড়ে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষম উপকূলীয় বাঁধের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং উপকূলীয় পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনাকে বিবেচনা করে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি করে আসছিল। সুন্দরবনের প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা ও নদীর প্রবাহ স্বাভাবিক রেখে পলির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়। কিন্তু প্রগতি ও সিএসআরএল এর আবেদন দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় আনে নি। চলমান এ গণ আন্দোলন যখন কর্তৃপক্ষের কুম্ভকর্ণ নিদ্রা ভাঙাতে ব্যস্ত ঠিক তখন জনগণের সকল আশংকাকে সত্যি প্রমাণ করে ঘটে যায় প্রলঙ্করী ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আইলা।
২৫ মে ২০০৯ তারিখ সামুদ্রিক সাইক্লোন আইলা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হানে। বাংলাদেশ অংশে ১৪টি জেলা আক্রান্ত হয় এবং এর মধ্যে সাতক্ষীরা ও খুলনা বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যান্য উপজেলার তুলনায় সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৫৮ জন মানুষ নিহত হয়েছে, যদিও বেসরকারি তথ্য মতে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশী। হাজার হাজার ঘর বাড়ি ভেসে যায়। সমগ্র উপকূলীয় বাঁধ একে বারে ধ্বংস হয়ে যায়। বিপুল সংখ্যক গবাদী পশুপাখি ও বন্য প্রাণী মারা যায়। মানুষ স্কুল, কলেজ, উঁচু বাড়ির ছাদে, ভাঙ্গা বাঁধের উপর আশ্রয় নিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাতে থাকে। খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, চিকিৎসা, প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাসের এক ভয়ঙ্কর আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তায় আক্রান্ত জনপদে এক ভয়ানক হাহাকার শুরু হয়। এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশী, বিদেশী, স্থানীয় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রগতিও যোগ দেয় ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরাতায়। দিন যত যেতে থাকে ততই মানুষের দুর্ভোগ আরো বাড়তে থাকে। ভাঙ্গা বাঁধের কারণে মানুষ কিছুতেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না এবং বিভিন্ন সংস্থার ত্রাণ প্রবাহ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। মানুষের জীবিকার আর কোন উপায় থাকে না। দুর্গত মানুষের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। এলাকায় পুকুরের পানিই খাওয়ার পানির প্রধান উৎস ছিল। কিন্তু সকল মিঠা পানির উৎস লোনা ও দূষিত পানিতে দূষিত হয়ে যায়। এলাকায় যে অল্প সংখ্যক অগভীর নলকূপ ছিল তা লোনাপানিতে তলিয়ে যায়। ফলে মানুষের পানের উপযোগী কোন পানি থাকে না। অবস্থা বেশী অসহনীয় হয়ে পড়ে শিশুদের জন্য। অধিকাংশ স্যানিটারী পায়খানা ভেসে অথবা নষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং স্যানিটেশনের সুবিধার অভাব এক বিরাট সমস্যা হিসেবে দেখা দেয় এবং এই পরিস্থিতি নারী ও বালিকাদের জন্য বেশী কষ্টকর হয়ে পড়ে।
বহু মানুষ খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাতে লাগে। ভাঙা বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে গ্রামগুলো দিনে দুবার প্লাবিত করে, গ্রামে কোন শুকনো জায়াগা না থাকায় মানুষ বাঁধের উপর গাদাগাদি করে অমানবিক অবস্থায় বাস করতে বাধ্য হয়। কিছু মানুষ সাইক্লোন সেল্টার বা উচুঁ কোন বাড়ির ছাদে আশ্রয় নেয় কিন্তু তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। সাইক্লোন সেন্টারগুলো নির্মাণ পদ্ধতিও দীর্ঘ সময় বসবাসের অনুকূল ছিল না। দুর্যোগে কোন কোন মানুষ গাছের উপর পর্যন্ত আশ্রয় নিয়ে জীবন বাঁচায়।
সাইক্লোনের পরেও বাড়ি ফেরা সম্ভব হয় না। কোন মানুষ যদিও গ্রামে ফিরতে চাইল কিন্তু সর্বত্র ময়লা আর দূষিত পানিতে পূর্ণ থাকায় ফেরা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। এই ময়লা ও দূষিত পানিতে এলাকাতে নানা ধরনের চর্মরোগ দেখা দেয়। চারিদিকে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল টিম দিন রাত কাজ করে ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খায়।
দুর্গত গ্রামে কাজের বা আয়ের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুর্গত মানুষকে সম্পূর্ণ ত্রাণের উপর নির্ভর করতে হয়। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, প্রতিবন্ধী ও নারী প্রধান পরিবারগুলো কোন কর্মসূচির সুযোগ গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না এবং তারা ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হয়। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নারী ও কিশোরী মেয়েরা চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে। শারীরিক প্রতিবন্ধীরা চরম কষ্টে দিন কাটাতে লাগে, কারণ কোথাও কোন শুকনো জায়গা ছিল না। তাদেরকে কর্দমাক্ত বাঁধের উঁপর অত্যন্ত গাদাগাদি করে বসবাস করতে হচ্ছিল। দুর্যোগের একেবারে শুরুতে ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ লোক এলাকা ছেড়ে চলে যায়, সম্পূর্ণ বাঁধ বাধা না হলে গ্রামে বসবাসের উপযোগী না হলে ফিরবার সম্ভাবনা কম ছিল।
আইলায় শ্যামনগর ও আশাশুনির প্রায় সমগ্র উপকূলীয় বাঁধ বিধ্বস্ত হয়। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও জনগণের অংশগ্রহণে অস্থায়ীভাবে সংস্কার বা পুনঃনির্মাণ করে অধিকাংশ এলাকার জোয়ারের পানি ঠেকানো সম্ভব হলেও গাবুরা, পদ্মপুকুর ও প্রতাপনগর ইউনিয়নের ১৫টি স্থানের বিধ্বস্ত বাঁধের ভেঙ্গে যাওয়া স্থান পুনঃনির্মাণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। দুর্গত মানুষের পক্ষ থেকে বারবার দাবি করা হয় ‘ত্রাণ নয়-বাঁধ বেধে দিন’। প্রতিদিন দুবার করে জোয়ারে প্লাবিত হতো গাবুরা, পদ্মপুকুর ও প্রতাপনগরের জনপদ।
সাতক্ষীরার ৩টি ইউনিয়নের ১৫টি স্থানে ক্লোজার না হওয়ায় মানুষদের ফিরতে দু’বছর সময় লাগে। এগুলো হলো: গাবুরা ইউনিয়নের জেলিয়াখালী, চকবারা, ৯নং সোরা, গাগড়ামারী, চাঁদনিমুখার ভাঙ্গন, পদ্মপুকুরের চন্ডিপুর, পশ্চিম পাতাখালী, কামালকাটি, ঝাপা, চাউলখোলার ভাঙ্গন আর প্রতাননগর ইউনিয়নের চাকলা, চুইবাড়িয়া, হরিশখালী, কুড়িকাহুনিয়া, কোলার ভাঙন কবলিত বাঁধ।
দিনে দু’বার করে জোয়ারে প্লাবিত হওয়া মানুষের দ্রুত বাঁধ নির্মাণের আকুতির প্রতি আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায় নি। শুধু মাত্র ঘোষণা দেওয়া হয় যে শুষ্ক মৌসুমের আগে বাধ নির্মাণ করা আর সম্ভব নয়। ২৫ মে ২০০৯ ভাঙ্গন হলেও অক্টোবর ২০০৯ এর পরপরই বাধঁ নির্মাণ শুরু হবে এ বিশ্বাসে মানুষ সীমাহীন অমানবিক সংকটের মধ্যেও আশায় বুক বেধে দিন কাটায়। কিন্তু, জানুয়ারি ২০১০ শেষ হলেও বাধ নির্মাণে তেমন কোন উদ্যোগ না গ্রহণ করায় এলাকার সাধারণ জনগণ আইলায় বিধ্বস্ত বাঁধ নির্মাণের দাবিতে বৃহত্তর আন্দোলনে নামে এবং একের পর একে নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করতে থাকে। বাঁধ নির্মাণের দাবি ঊর্র্ধ্বতন মহলে তুলে ধরতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলে ‘আইলা বিধ্বস্ত বাঁধ নির্মাণ গণ সংগ্রাম কমিটি’।
আইল বিধ্বস্ত বাঁধ নির্মাণ গণসংগ্রাম কমিটি, সিএসআরএল, প্রগতির সাতক্ষীরা কেন্দ্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি খুলনা ও ঢাকাতে আইলা বিধ্বস্ত বেড়ি দ্রুত নির্মাণের দাবিতে সচেতন মহলসহ নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণে এগিয়ে আসে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। সিএসআরএল এর উদ্যোগের ফলে ছয়টি দাতা সংস্থার ফোরাম ইমারজেন্সি ক্যাপাসিটি বিল্ডিং- ইসিবি নীতি নির্ধারক ও আর্ন্তজাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে সেমিনার, মিটিং ও লবিং শুরু করে। নাগরিক ্সংহতির নেতৃত্বে ঢাকাতে ও হিউম্যানিটিওয়াচ এর নেতৃত্বে খুলনাতে বিধ্বস্ত বেড়িবাধ নির্মাণের দাবি তুলে ধরতে বিভিন্ন কর্মসূচি শুরু করে। এ সময় আইলায় বিধ্বস্ত সাতক্ষীরা ও খুলনার সকল বেড়িবাধ নির্মাণের দাবি তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের করুন চিত্রও তুলে ধরা হয। সকল কর্মসূচির লক্ষ্য থাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
আইলা বিধ্বস্ত বাঁধ নির্মাণ গণ সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে ২০ জানুয়ারি ২০১০ সাতক্ষীরা প্রেস ক্লাবে মতবিনিময় সভা, ২৪ জানুয়ারি ২০১০ শ্যামনগরে হাজার মানুষ মানুষ সমবেত হয়ে মানববন্ধন করে। পরে এক বিশাল সমাবেশ শ্যামনগর উপজেলা চত্বরে অনুষ্ঠিত হয়। এখানে মাননীয় জাতীয় সংসদ সদস্য এইচ এম গোলাম রেজা ও তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবদুস সামাদ উপস্থিত হয়ে দ্রুত বাঁধ নির্মাণের আশ্বাস আদায়, ২৫ জানুয়ারি ২০১০ সাতক্ষীরাতে মতবিনিময় সভায় রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বেড়িবাঁধ নির্মাণকে প্রথম ও প্রধান দাবি হিসেবে উল্লে¬খ করেন, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১০ সাতক্ষীরা প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১০ মানববন্ধন, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১০ বিক্ষোভ সমাবেশ, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড ঘেরাও, ২ মার্চ ২০১০ খাদ্য ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক শ্যামনগর ও আশাশুনি আইলাবিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শনে এলে তাঁকে বাঁধ নির্মাণের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান, ৩ মার্চ ২০১০ সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সামনে প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালন, ১৬ মার্চ ২০১০ জাতীয় সংসদের খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যবৃন্দ সাতক্ষীরা সফরের সময় তাদের সঙ্গে সাক্ষাত ও স্মারকলিপি প্রদান, ৮ ও ৯ এপ্রিল ২০১০ জাতীয় ক্ষেত্রে বিশিষ্টজনদের আইলা দুর্গত এলাকা সফর করানো, ১৫ মে ২০১০ বর্ষার আগেই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবিতে সাংবাদিক ও রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নাগরিক সংলাপ, ১৭ এপ্রিল ২০১০ বেঁড়িবাধ নির্মাণ: স্থানীয় মানুষের প্রত্যাশা শীর্ষক মতবিনিময় সভা, ২৪ ও ২৫ মার্চ ২০১০ আইলা দুর্গতদের স্মরণে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা হয়, ২৬ মার্চ ২০১০ গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নের আইলা দুর্গতদের নিয়ে স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করা, ১৮ ও ২০ মে ২০১০ আইলার বর্ষপূর্তির পূর্বে জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে এবং ইলেট্রনিক মিডিয়াতে বাঁধ নির্মাণের বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য সাংবাদিকদের আইলা এলাকার গাবুরা ও পদ্মপুকুর এলাকা পরিদর্শন, ২৫ মে ২০১০ আইলা বর্ষপূর্তি উপলক্ষে শ্যামনগর, আশাশুনি ও সাতক্ষীরাতে অনুষ্ঠান করা হয়। একই সময় খুলনাতে ১২ জানুয়ারি ২০১০ সংবাদ সম্মেলন, ১৫ জানুয়ারী ২০১০ দুই শতাধিক সিভিল সমাজের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহনে অবস্থান কর্মসূচি, ২২ জানুয়ারী ২০১০ আইলাদুর্গতদের মিছিল ও স্মারকলিপি পেশ, ২৬ জানুয়ারী ২০১০ পাঁচ দিনব্যাপী আইলা মঞ্চের উদ্বোধনী গণ-জমায়েত, ২৭ জানুয়ারী ২০১০ আইলাদুর্গত ৫ শতাধিক ছাত্রছাত্রীদের মিছিলে ছাত্রনেতারা অংশগ্রহণ করেন এবং বাঁধ নির্মাণে পাউবোকে চাপ প্রয়োগের ৫ মে ২০১০ জাতীয় যাদুঘরের সামনে খাবার ও কাজের দাবিতে শানকি হাতে মানব বন্ধন করার মধ্যদিয়ে আইলা দুর্গত মানুষদের দুর্ভোগ লাঘবে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য দৃষ্টি আর্কষণ করা হয়।
মানবিক আন্দোলনের ফলে ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১০ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাতক্ষীরার শ্যামনগরে দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন এবং শ্যামনগর হাইস্কুল মাঠের জনসভা করেন। এখানে তিনি ঘোষণা দেন যে বর্ষা মৌসুমের আগেই বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ করা হবে। কিন্তু বাস্তবে ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গভাবে ভেঙ্গে থাকা বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। ১৫ জানুয়ারির ২০১১ মধ্যে শেষ হবে বলে আবারও ঘোষণা দেয়া হয়। জনআন্দোলন আর প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় ২০১১ সালে মাঝামাঝি মানুষ এলাকায় ফিরে যেতে সক্ষম হয়। আইলা দুর্গত মানুষদের কষ্টের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল বিধ্বস্ত উপকূলীয় বাধ সময়মত নির্মাণ না করায়।
২০১৯ সালে আজও সেই একই তিমিরে দাডিয়ে উপকূলের মানুষ। বিধ্বস্ত বাধ নির্মাণ আর বাধের বর্তমান ডিজাইনের পরিবর্তন করে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা সক্ষম বাঁধ তৈরীর দাবি আবার এলাকা থেকে উঠছে। দাবি উঠেছে বাঁধ ব্যবস্থাপনা স্থানীয় সরকারের হাতে দেওয়ার। যেটি এক সময় ছিল, তখন নিয়মিত বাধ সংস্কার হতো।
সমগ্র বিশ্বে বর্তমানে উন্নয়নের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করা। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও অন্যান্য মহাজাগতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের জলবায়ুর ব্যাপকভাবে পরিবর্তন হচ্ছে। এর ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ভূমির নিমজ্জ্বন হচ্ছে। ঘন ঘন সামুদ্্িরক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর বড় বড় নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব কারণে বাংলাদেশের মত সাগরকূলের নিম্নভূমি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ঘন ঘন সামুদ্রিক সাইক্লোন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীর নাব্যতা হ্রাস এবং এ কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে এই এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এর সাথে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে যুক্ত রয়েছে বাধ ব্যবস্থনার বিষয়টি। এই অবস্থার উন্নয়নের জন্য এবং এই এলাকায় মানুষের বসতি টিকিয়ে রাখার জন্য বাস্তবসম্মত পরিকল্পিত বাধ নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া অতীব জরুরী। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় এখন প্রথম অভিযোজন হচ্ছে টেকসই পরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ ও স্থানীয় সরকারকে বাঁধ ব্যবস্থাপনার তদারকিতে যুক্ত করা।
ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। একটি জলবায়ু ট্রস্ট ফান্ড গঠন ও একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন। কিন্তু সরকারের মহৎ এ উদ্যোগ ইতোমধ্যে হোচট খেয়েছে। সুষ্ঠু নীতিমালা না থাকায় জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের টাকা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে যুক্ত নয় এমন খাতেও ব্যবহারিত হয়েছে। আবার জন সম্পৃক্ততা না করায় প্রকল্পের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তৈরী হচ্ছে। পাশাপাশি অনেক পরিকল্পনা ও অনেক অর্থ এলাকাতে এসেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলার নানান প্রকল্প ইতোমধ্যে বাস্তায়িত হয়েছে ও হচ্ছে কিন্তু আজও মানুষের জীবন ঝুঁকিমুক্ত হয়নি। মানুষের নিরাপত্তাময় জীবনযাত্রা আজও অধরা। ফলে সকল বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যে, আমরা কি এখনও সক্ষমতা অর্জন করেনি।
এ অবস্থায় প্রগতি সিএএসআরএল এর স্টাটেজিক সহযোগী হিসেবে উপকূলের আইলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দুটি উপজেলায় (খুলনার কয়রা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর) বৃটিশ কাউন্সিলের ‘প্রকাশ’ কর্মসূচির সহযোগিতায় জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন তথা ক্লাইমেট ফাইনান্স ট্রান্সফারেন্সি ম্যাকানিজম-সিএফটিএম প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এ কার্যক্রমের সাথে যুক্ত আছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ‘ইআরডি’ বিভাগ। আর এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে যে আবারও মানুষের সেই দাবিই প্রধান হিসেবে সামনে আসে, ‘টেকসই বাঁধ ব্যবস্থাপনা’। বর্তমানে এর সাথে যুক্ত হয়েছে উপকূলীয় বাঁধ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার বিশেষ করে ‘ইউনিয়ন পরিষদকে তদারকিতে যুক্ত রাখা’।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version