ডেস্ক রিপোর্ট: বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্র্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) ভুলের কারণে নিয়োগের জন্য সুপারিশকৃত শতাধিক জুনিয়র শিক্ষক সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ে যোগদান করেও এমপিওভুক্তি না হবার শংকায় চরম হতাশার মধ্যে পড়েছেন। এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষের নিকট অনলাইন আবেদন করার তারিখ অতিবাহিত হলেও জুনিয়র শিক্ষক আবেদন করতে পারেননি।
বিদ্যালয়সমূহের শূন্যপদ পূরণের চাহিদা আহ্বানকালে প্রার্থীরা জুনিয়র শিক্ষকের এমপিওভুক্ত শূন্যপদে আবেদন করায় এনটিআরসিএ সমন্বিত জাতীয় মেধার ভিত্তিতে প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাচাই বাছাই করে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়সমূহে চূড়ান্ত নিয়োগযোগ্য হিসেবে সুপারিশপত্র পাঠালে জুনিয়র শিক্ষকগণ সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। কিন্ত যোগদানকারী জুনিয়র শিক্ষকগণ তাঁদের এমপিওভুক্তির জন্য অনলাইনের মাধ্যমে আবেদন করতে গেলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বিভাগসমূহ তাঁদেরকে এমপিওভুক্তির আবেদন করা হতে বিরত রাখে।
সংশ্লিষ্ট জুনিয়র শিক্ষকদের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে ৩৭.০০.০০০০.০৭১.০৮.০০৮.০৫(অংশ)-১০৮১ স্মারকের পরিপত্রের মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্র্তপক্ষের (এনটিআরসিএ) নিকট বেসরকরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সকল শূন্যপদে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়। শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করা এবং এনটিআরসিএকে শিক্ষকদের নিয়োগের দায়িত্ব দেয়ার পূর্বে ১১ অক্টোবর ২০১৫ ৩৭.০০.০০০০.০৭২.৪৪.০৬৯.১২-৫৩০ স্মারকে বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয় সংযুক্ত প্রাথমিক স্তরে কেবল এমপিওভুক্ত শূন্যপদে নিয়োগের জন্য পরিপত্র জারী করা হয়। উক্ত পরিপত্রটি সংশোধন করে ২৬ মে ২০১৬ তারিখ, ৩৭.০০.০০০০.০৭২.৪৪.০৬৯.১২.১৩ স্মারকে পুনরায় আর একটি পরিপত্র জারি করে বলা হয়, ‘যে সকল বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সাথে প্রাথমিক বিদ্যালয় সংযুক্ত রয়েছে (অর্থাৎ ১ম-১০ম শ্রেণি বা ১ম-১২ শ্রেণি পর্যন্ত) সে সকল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্তরে কেবল এমপিওভুক্ত শূন্যপদে ০১.০১.১৯৮২ তারিখের জনবল কাঠামো অনুসরণে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাথে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ করা হলে তাদের পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত এমপিওভুক্ত করা যাবে। উক্ত ০১.০১.৮২ তারিখের ‘স্টাফিং প্যাটার্ন’-এ ‘মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংযুক্ত প্রাথমিক স্তর’র ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘স্কুলের প্রাথমিক শ্রেণিসমূহ চালু থাকলে প্রতি শাখা ও শ্রেণির জন্য ০১ জন শিক্ষক অনুদান পাইতে পারেন’।
এরপর এনটিআরসিএ ০৯ মে ২০১৭ তারিখ, বেশিনিক/শি.শি./বে.শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিঃ নিয়োগ/৫৭৪/২০১৬/৯৭ স্মারকে সকল বেসরকারি (এমপিও ও ননএমপিও) বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের শূন্যপদে চাহিদা পূরণের জন্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা দপ্তরের মাধ্যমে চাহিদা আহ্বান করলে সমগ্র দেশের বিদ্যালয়সমূহ চাহিদাপত্র জমা দেয়। পুনরায় শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে এনটিআরসিএ কর্তৃক সমগ্র দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ হতে ২৬ আগস্ট ২০১৮ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত নিয়োগযোগ্য শূন্যপদ পূরণের জন্য চাহিদা আহ্বান করা হলে সর্বমোট ৪০,২৮৭টি শিক্ষক পদ পূরণের জন্য অনলাইনে চাহিদা পাওয়া যায়। এই চাহিদার মধ্যে জুনিয়র শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত শূন্যপদ পূরণের চাহিদাও রয়েছে। যে শূন্যপদসমূহ পূরণে দীর্ঘদিন যাবৎ সুযোগ ছিল না।
২০১৫ সালের ১১ অক্টোবর এবং ২০১৬ সালের ২৬ মে মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংযুক্ত প্রাথমিক স্তরে ০১.০১.১৯৮২ সালের জনবল কাঠামো অনুসরণে এমপিওভুক্ত শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগের কথা উল্লেখ করা হলে সমগ্র দেশের বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহের জুনিয়র শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত শূন্যপদ পূরণে তৎপর হয়ে ওঠে। কিন্তু এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষ শূন্যপদের চাহিদা আহ্বানের গণবিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুসরণে নিয়োগের কথা উল্লেখ করলেও এনটিআরসিএ শূন্যপদের চাহিদা আহ্বান করার সময় অন্যান্য শিক্ষকদের পদের সাথে জুনিয়র শিক্ষকদের পদও উল্লেখ করে। সেই সাথে ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর অনলাইনে এনটিআরসিএ’র পাবলিক সার্কুলেশনে সংশ্লিষ্ট স্কুলের নাম, ঠিকানা, পদ, বিষয়, শূন্যপদের সংখ্যা এবং ওই পদ এমপিওভুক্ত কিনা তাও উল্লেখ করা হয়।
প্রাপ্ত আবেদনপত্রসমূহ সরকারি নীতিমালা অনুসরণে মেধাক্রম অনুযায়ী টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের কম্পিউটার সিস্টেমের মাধ্যমে যাচাই বাছাই করে নিয়োগযোগ্য পদের বিপরীতে এনটিআরসিএ কর্তৃক বিদ্যালয় নির্বাচিত করে, নিজ পদ ও বিষয় উল্লেখ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখের ৩৭.০০.০০০০.০৭১.০৮.০০৮.০৫ (অংশ)-১০৮১ নং পরিপত্রের ৪.০ ও ৫.০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এবং এনটিআরসিএ ২৪ জানুয়ারি, ২০১৯ তারিখ, বেশিনি/শি.শি./ বেশিপ্রশি.নি/৮৫৪/২০১৮/২৩৫ স্মারকে নিয়োগের জন্য সুপারিশপত্র আনলাইনের মাধ্যমে প্রেরণ করে। এছাড়া প্রার্থীর নিজ মোবাইল সেটে মেসেজ পাঠিয়ে বাছাই নিশ্চিত করা হয়। সেই সাথে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়েও মেসেজ পাঠানো হয়। এনটিআসিএ থেকে চূড়ান্ত নিয়োগযোগ্য সুপারিশপত্র পেয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি সেই সকল জুনিয়র শিক্ষকদের নিয়োগ প্রদানের জন্য সভা আহ্বান করে নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাঁদের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই যোগদানের ব্যবস্থা করে। যোগদানের পর এনটিআরসিকে অনলাইনে যোগদান নিশ্চিত করা হয়। এভাবে বাছাই ও নিয়োগ প্রক্রিয়া বিনা খরচে সম্পন্ন হয়। এনটিআরসিএ’র এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে জুনিয়র শিক্ষকদের নিয়োগ, যোগদান এবং পরবর্তীতে এমপিওভুক্তির কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়নি অথবা জুনিয়র শিক্ষক পদে আবেদনকালে এই পদে আবেদন করা যাবে না এধরনের কোন বাধা না থাকায় প্রার্থীরা সহজেই আবেদন করার সুযোগ পেয়েছেন।
খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার আঙ্গারদোহা গ্রামের আবুল হোসেন খানের ছেলে আবু দাউদ খান এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে সুপারিশ পেয়ে খুলনার রূপসা এলাকায় ঢাকা ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রি সেকেন্ডারি স্কুলে জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু তিনি নতুন এমপিওভুক্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করতে গেলে এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী এমপিওভুক্তির সুপারিশ করা সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বিভাগ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়।
তিনি বলেন, এনটিআরসিএ’র অনলাইনে আবেদন করার সময় সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র শিক্ষক পদ দেখে ও স্কুলের নাম, ঠিকানা, বিষয়, শূন্যপদের সংখ্যা এবং ওই পদ এমপিওভুক্ত কিনা তা দেখে আবেদন করেছি। তখন বিদ্যালয় পর্যায়ে জুনিয়র শিক্ষক পদ ছিল। চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলার বড়গাছী গ্রামের আমানত আলীর ছেলে আব্দুল ওয়াদুদ শহীদ মাহমুদ পুলিশ লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজ সংযুক্ত প্রাথমিক স্তরে এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে নিয়োগ পান। তিনি জানান, নতুন এমপিওভুক্তির অনলাইনে আবেদন করতে গেলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বিভাগ থেকে তাঁকে অনলাইলে আবেদন করতে নিষেধ করে। বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার রাজিয়া গ্রামের লুৎফর শেখের ছেলে মনজুর শেখ একই উপায়ে বাগেরহাট সদর উপজেলার ফতেপুর নি¤œ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে এমপিওভুক্ত শূন্যপদে যোগদান করেন। তিনি বলেন, এনটিআরসিএ’র অনলাইনে স্কুলের জুনিয়র শিক্ষকের পদ যদি না থাকতো তা হলে আমি আবেদন করতাম না। তাঁর প্রশ্ন, তিনি এনটিআরসিএ’র বাছাইয়ের পর যোগদান করেও এমপিওভুক্তির হতে বঞ্চিত হবেন কেন? মনজুর শেখ এসব বিষয়ে কথা বলতে এনটিআরসিএ’র চেয়ারম্যানের নিকট তিনবার গেলেও তাঁকে দেখা করতে দেয়া হয়নি।
এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে একই ভাবে নিয়োগ পেয়েছেন খুলনার নিরালা এলাকার আখতার উজ জামানের ছেলে ফয়সাল উজ জামান। তিনি বলেন, শিক্ষক নিয়োগকালে যাতে স্কুল কর্তৃপক্ষ আর্থিক সুযোগ গ্রহণ করতে না পারে সেজন্য সরকার আমাদের আর্থিক হয়রানি থেকে মুক্তির জন্য এনটিআরসিএ’র নিকট দায়িত্ব দিয়েছে। কিন্ত এনটিআরসিএ’র এই ভুলের কারণে আমাদের যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে সেই কথা এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারছি না। যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার কপালিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এমপিওভুক্ত শূন্যপদে যোগদান করেন বিলাস চন্দ্র ম-ল। সাতক্ষীরা নৈশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে যোগদান করেন ৫ জন জুনিয়র শিক্ষক, তাঁদের মধ্যে বর্তমানে কর্মরত আছেন চারজন শিক্ষক। তাঁরা হলেন, হাফিজুর রহমান, মহিদুল ইসলাম, হাবিবুল্লাহ ও হুমায়ূন কবির।
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল এবং মানবাধিকার সংস্থা ‘নিজ অধিকার’ সাতক্ষীরার সহ সভাপতি অধ্যাপক লিয়াকত পারভেজ বলেন, এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয়সমূহের শুন্যপদ পূরণের জন্য আবেদন আহ্বানকালে জুনিয়র শিক্ষক পদ উল্লেখ থাকায় প্রার্থীরা আবেদন করেছেন এবং আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়ায় বাছাই করে তাঁদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। এই বাছাই প্রক্রিয়ার সময় যদি এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষ জুনিয়র শিক্ষকদের নিয়োগ সর্বশেষ এমপিও নীতিমালার আলোকে করার ইচ্ছা করত তাহলে তাঁদের নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করতে পারত। কিন্তু তারা জুনিয়র শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়ার আবেদন বাতিল করেনি। বরং নিয়েগের জন্য সুপারিশ করে বিদ্যালয়সমূহে পাঠিয়েছে। এক্ষেত্রে যথানিয়মে এমপিওভুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে।
খুলনা আঞ্চলিক মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক নিভা রাণী পাঠক জানান, বিদ্যালয়সমূহের জুনিয়র শিক্ষক নিয়োগে সর্বশেষ জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুসরণ করা হয়নি। এই নীতিমালায় জুনিয়র শিক্ষকের পদ নেই। একারণে জুনিয়র শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহা পরিচালক মহোদয়ের নিকট শীঘ্রই সুনির্দিষ্ট মতামত চেয়ে চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
জুনিয়র শিক্ষকদের অভিমত, এনটিআসিএ যদি চাহিদা আহ্বানকালে এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুসরণ করে জুনিয়র শিক্ষকের পদ না উল্লেখ করত তাহলে ওই পদে কোন আবেদন পড়ত না। এখন এনটিআসি’র ভুলের কারণে এমপিওভুক্তি না হবার আশঙ্কায় জুনিয়র শিক্ষকরা এখন বিপদগ্রস্ত। এদিকে এমপিওভুক্তির মাস হিসেবে চলতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে এমপিওভুক্তির জন্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয় থেকে এমপিওভুক্তির অনলাইন আবেদন পাঠানোর কথা থাকলেও আবেদন পাঠানো সম্ভব হয়নি।
এনটিআরসিএ’র সুপারিশে যোগ দিলেও এমপিওভুক্তি না হওয়ার শংকায় শতাধিক জুনিয়র শিক্ষক
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/