Site icon suprovatsatkhira.com

সামাজিক ‘বিষ’ থেকে মুক্ত হওয়ার শপথে পালন হোক স্বাধীনতা দিবস

স্বাধীনতার ৪৮ বছরে পদার্পণ করেছে স্বাধীন বাংলাদেশ। পাকিস্তানিদের বিষবাষ্প থেকে মুক্তির স্বাদ পেয়ে জাতি আজ মেতে উঠবে আনন্দ উল্লাসে। সারা দেশে পালিত হবে নানা বৈচিত্র্যময় উৎসব অনুষ্ঠান। সেই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান আর আমাদের সকলের ভালোবাসার কিংবদন্তী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণায় যে স্বাধীনতার ডাক এসেছিলো, সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি নেমে পড়েছিলো পাকিস্তানিদের অত্যাচার আর শোষণের প্রতিবাদে। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা বিজয় পেয়েছিলাম ১৬ ডিসেম্বর। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করেছিলাম আমরা। আজ আর পাকিস্তানিদের সেই শোষণ নেই। নেই পাক বাহিনীর নির্মম অত্যাচার। তবে আজ নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক কিছু ‘বিষ’। আর তাই এবছর স্বাধীনতা দিবস পালিত হোক সামাজিক সেই সব ‘বিষ’ থেকে মুক্তি পাওয়ার শপথে।
অগ্রগতির কোনো শেষ হয় না। আজ ভালো তো কাল আরও ভালো। যাকে সাধারণ ভাষায় উত্তম বলে অভিহিত করা হয়। অগ্রগতির ধারা বহমান রাখতে চাইলেই বহমান রাখা যায়। আর এই ধারা বহমান রাখাটাও জরুরি। দেশের অগ্রগতি বা নাগরিকের অগ্রগতি বলতে সাধারণভাবে যা বোঝানো হয়, শুধু সেই বস্তুগত অগ্রগতি হলেই কিন্তু চলে না। মূল্যবোধ ও চিন্তাধারারও অগ্রগতি সময়ের সাথে সাথে জরুরি। সেই সূত্র ধরেই তাই বলতে হয়, আমাদের স্বাধীনতারও অগ্রগতি প্রয়োজন নয় বরং জরুরী।
আজ বাংলাদেশের ৪৯তম স্বাধীনতা দিবস। অর্থাৎ স্বাধীনতার ৪৮ বছর পূর্তি হচ্ছে। পাকিস্তানিদের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার গরিমা এই দিনটার মূল তাৎপর্য। তবে সে তাৎপর্যেই আমরা আটকে থাকব, না কি শৃঙ্খল মুক্তির আলোকে পরবর্তী কোনো তাৎপর্য নিয়ে স্বাধীনতা দিবস পালিত হবে, তা ভাবার সময় এসেছে আজ।
মূল কথায় যেতে চাই। একটা সময় শুধুমাত্র পাকিস্তানিদের অত্যাচার আর নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়াই ছিল স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য। কিন্তু আজ অনেক কিছু থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মের নামে হিংসা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, অবিচার, হত্যা, গুম, খুন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা- এসব একের পর এক সামাজিক ‘বিষ’ আজ আমাদের দেশটাকে গিলে খেতে চাইছে। আর তাই আবার বলছি এবছর আমাদের স্বাধীনতা দিবস পালিত হোক এই সব সামাজিক ‘বিষ’ থেকে মুক্তি পাওয়ার শপথে।
একটা ঘোষণা আর তারপরে মাত্র নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দিয়ে এই দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার স্বাদ আমরা কতটা বুঝি সেটা তখনই কেবল বোঝা যায় যখন এই সব দিবসগুলো আমাদের সামনে আসে। কারণ এসব দিবসগুলো পালন শুধু স্মৃতি-নির্ভর কিন্তু শপথ-নির্ভর নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে সংগ্রামী যোদ্ধাদের প্রকৃত সম্মান জানিয়ে প্রতি বছর ২৬ মার্চ যদি আবারও একটি শপথ নিতে পারতাম যে, আজকের এই সামাজিক বিষগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার, তা হলেই দিনটাকে বোধ হয় যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হতো।
আমরা যারা বর্তমান প্রজন্ম তারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই দেখিনি। দেখিনি পাকিস্তানিদের অত্যাচার আর নির্যাতনের দৃশ্য। শুধু শুনেছি সেসবের নির্মম কাহিনী। আবার কেউ তো শুধু পড়েই জেনেছে সেসময়ের ইতিহাস। কিন্তু তাতে মহান স্বাধীনতা দিবস বর্তমান প্রজন্মের কাছে যে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে, এমনটা নয়। কিন্তু দিনটা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হতে পারে, যদি প্রত্যেক বাংলাদেশি নাগরিককে এই দিনে নতুন কোনও আন্দোলনের শপথ দেখিয়ে এগিয়ে নেওয়া যায়।
নিশ্চয়ই দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ থেকে হয়তো এসব সামাজিক বিষগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহ্বান থাকবে। কিন্তু সেই সংগ্রামের অগ্রগতির পথ দেখাবে কে? যারা স্থানীয় পর্যায়ে সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা চেয়ারম্যান রয়েছেন তারা নিশ্চই সেই বার্তাকে সংগ্রামের বার্তা হিসেবে গ্রহণ করবেন। আর এটাই তো সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আর এভাবেই স্বাধীনতার পরবর্তী প্রজন্মগুলোর কাছে স্বাধীনতা দিবসের প্রাসঙ্গিকতা আরও বাড়িয়ে তোলা যেত। তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাটির যেমনি স্বার্থকতা পেত তেমনি দেশের মানুষ স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করতে পারতো। কিন্তু এমন কার্যক্রম শুধু মাইক আর মজলিসে ছাড়া কোথাও চোখে পড়ে না।
শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা, তুমি একটা সুদীর্ঘ মিছিলের স্বপ্ন।’ সুদীর্ঘ মিছিল বলতে কি বোঝানো হয়েছে? আসলে স্বাধীনতা হঠাৎ কোন চিন্তার বিষয় নয়। দীর্ঘ দিনের চিন্তার লালন, মানুষের রক্তের বিনিময় আর অসংখ্য ত্যাগের নজরানা পেশ করেই তবে স্বাধীনতা আসে। কিন্তু সেই স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ কয়জনই বা পায়।
সময় মিলিয়ে যাচ্ছে দ্রুতই কালের গহ্বরে। স্বাধীনতার বার্তাও যেন ক্রমশই ফিকে হচ্ছে। প্রকট হয়ে উঠছে এই সামাজিক ‘বিষগুলো’। ৫২এর ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে ক্রমশ এগিয়ে যাওয়ার আন্দোলন ৭১এর যুদ্ধে বিজয় অর্জনের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতায় রূপ পায়। অসংখ্য বীর সন্তানের জীবন বিসর্জনের রক্তে সিক্ত হয়েছে সেই পথ। ঐক্য আর শান্তি প্রাপ্তির শপথই ছিল সেই পথের শক্ত ভিত্তি। অর্ধ শতাব্দি পার হওয়ার আগেই একটা জাতি যেন ভুলতে বসেছে সেই অঙ্গীকার। সাম্প্রদায়িকতা নামক বিষবৃক্ষের উৎপাটন তো দূরের কথা সামান্য ধর্ষণের বিরুদ্ধে শক্ত কোন পদক্ষেপ এই জাতি দেখেনি। দুর্নীতি, অবিচার, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর ধর্মের নামে হিংসা মানুষকে আজও দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলছে। শুধু মতের পার্থক্যের কারণে আমরা জাতীয় স্বার্থেও দূরে ঠেলে দিচ্ছি একে অপরকে। এই ফল এই জাতির জন্যে অত্যন্ত অপরিনামদর্শী সংকট বয়ে নিয়ে আসবে।
সবশেষে বলি, আমরা যারা নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছি তারা চাই দেশের মধ্য থেকে এসব সামাজিক বিষ দূর করে আমাদের জন্য বসবাসের এক উপযুক্ত জায়গা তৈরি করতে কাজ করবেন আজকের দায়িত্ববানরা। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি থেকে শুরু করে একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বর এই দেশের তরুণ প্রজন্মকে এমনভাবে গড়ে তুলতে কাজ করবেন যেন এই প্রজন্ম আগামীতে স্বাধীন বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবের স্বপ্নের সেই ‘সোনার বাংলা’ গড়তে সচেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। -লেখক: শিক্ষার্থী ও বিতার্কিক, সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version