ন্যাশনাল ডেস্ক: ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ। গাজীপুরে (জয়দেবপুরে) সংঘটিত হয় প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা এক গৌরবদীপ্ত অধ্যায়। একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে আমাদের চূড়ান্ত স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলেও এর পূর্বে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরের মাটিতেই সূচিত হয়েছিল বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্বে বীর বাঙালির প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। এ দিনেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিকামী বাঙালির পক্ষ থেকে গর্জে উঠেছিল বন্দুক। আর সে কারণেই একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে সমগ্র বাংলাদেশে স্লোগান উঠেছিল ‘জয়দেবপুরের পথ ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ৭১’ ১ মার্চ থেকে সমগ্র বাংলাদেশে চলতে থাকে দুর্বার আন্দোলন। এর ঢেউ এসে লাগে জয়দেবপুরেও। আন্দোলন বেগবান করার জন্য জয়দেবপুরে গঠন করা হয় সর্ব দলীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ। এ পরিষদের ছিল দুটি শাখা। একটি হাই কমান্ড, অপরটি অ্যাকশান কমিটি।
হাই কমান্ডে ছিলেন সাবেক এমপি মরহুম হাবিব উল্লাহ, প্রয়াত ডা. এনীদ্রনাথ গোস্বামী ও মরহুম এম এ মোতালেব। অ্যাকশন কমিটিতে ছিলেন বর্তমান এমপি ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আ.ক.ম মোজম্মেল হক (আহ্বায়ক), বিএনপির বর্তমান স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান (কোষাধ্যক্ষ), নূরুল ইসলাম, আয়েশ উদ্দিন, মরহুম শহীদুল্লাহ বাচ্চু, আব্দুস সাত্তার মিয়া, হারুনুর রশিদ ভূঁইয়া, শহীদুল্লাহ পাঠান জিন্নাহ ও শেখ আবুল হোসাইন। সে সময় জয়দেবপুরের ভাওয়াল রাজবাড়িতে (বর্তমান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়) অবস্থান ছিল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের।
এ রেজিমেন্টের ২৫/৩০ জন ছাড়া সবাই ছিলেন বাঙালি অফিসার ও সৈনিক এবং অধিকাংশই মনে মনে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক। সে সময় বাঙালিকে চিরতরে দমিয়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নানা ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছিল। এরই একটি অংশ ছিল কৌশলে বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করা।
এ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে ঢাকার ব্রিগেড সদর দফতর থেকে নির্দেশ এল রেজিমেন্টের ৩০৩ ক্যালিবার রাইফেলগুলো সদর দফতরে জমা দিতে হবে। কিন্তু বাঙালি অফিসার সৈন্যরা অস্ত্র জমা দিতে ইচ্ছুক নন। এ খবর সদর দফতরে জানানো হলে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পুনরায় খবর পাঠানো হলো ব্রিগেড কমান্ডার পাঞ্চাবি ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবার নিজে ১৯ মার্চ রেজিমেন্ট পরিদর্শনে আসবেন। এটা যে আসলে বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে আসা সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না কারো।
ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্যসহ ১৯ মার্চ দুপুরে জয়দেবপুর সেনানিবাসে এসে উপস্থিত হন। কিন্তু বাঙালি সৈন্যদের সতর্কত অবস্থা দেখে তিনি অস্ত্র নেবার পরিকল্পনা বাতিল করেন।
এদিকে পাঞ্জাব সৈন্যরা অস্ত্র নিতে এসেছে এ খবরটি দাবানলের মত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার জনতা লাঠি-সোটা, তীর-ধনুক বল্লম হাতে জড়ো হতে থাকেন জয়দেবপুরে। তাদের সংঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় সমরাস্ত্র কারখানা ও মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির শ্রমিক কর্মচারীরাও। জঙ্গি জনতা ইট-পাথর-গাছ দিয়ে রাস্তায় ব্যরিকেড দেয়। এছাড়া মালগাড়ির একটি ওয়াগন এনে জয়দেবপুর বাজার রেলক্রসিং বন্ধ করে দেয়। জনতার কাতারে কাজী আজিম উদ্দিনসহ সালাম ও সেকান্দর নামে ৩ জন বন্দুক নিয়ে উপস্থিত হন।
এদিকে ব্যারিকেড দেবার খবর শুনে জাহানজেব ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং সেগুলো অপসারণ করার নির্দেশ দেন। জাহান জেব সামনে বাঙালি সৈন্য ও পিছনে পাঞ্জাবি সৈন্য দিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হয়ে বাধাপ্রাপ্ত হলে গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। কিন্তু বাঙালি সৈন্যরা ফাঁকা গুলিবর্ষণ করেন। এ সময় জনতার অনুরোধে কাজী আজিম উদ্দিন আহমেদ, ছালাম ও সেকান্দর পাল্টা গুলি করেন।
অপর দিকে টাঙ্গাইল থেকে রেশন পৌঁছে দিয়ে রেজিমেন্টের একটি ৩ টনি ট্রাক জয়দেবপুরে ফিরছিল। এতে হাবিলদার সিদ্দিকুর রহমানসহ ৫ জন সৈন্য ছিল এবং তাদের সঙ্গে ছিল এসএমজি ও চাইনিজ রাইফেল। জয়দেবপুর কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে আসামাত্র তাদের গাড়ি থামিয়ে জনতা ঘটনা বর্ণনা করে এবং গুলিবর্ষণের অনুরোধ করে। জনতার মনোভাব বুঝতে পেরে তারা গুলিবর্ষণ শুরু করেন। এটাই ছিল বাঙালিদের পক্ষ থেকে প্রথম প্রতিরোধ ও গুলিবর্ষণের ঘটনা।
পরে পাঞ্জাবি সৈন্যরা ব্যারিকেড অপসারণ করে জয়দেবপুর বাজারে প্রবেশ করে এবং কারফিউ ঘোষণা করে। এখানেই গুলিতে নেয়ামত ও মনু খলিফা শহীদ হন। এরপর আরও ব্যারিকেড অপসারণ করে চান্দনা চৌরাস্তায় পৌঁছে পাঞ্জাবি সৈন্যরা প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এখনে হুরমত নামে অসম সাহসী এ কিশোর পাঞ্জাবি সৈন্যের রাইফেল কেড়ে নেওয়ার সময় অপর সৈন্যের গুলিতে নিহত হন। এছাড়া কানু মিয়া নামে অপর একজন আহত হয়ে পরে মারা যান। জয়দেবপুরের প্রতিরোধের কথা সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ে। জয়দেবপুরের প্রতিরোধকামী জনতার বীরত্বের কারণে সে সময় সমগ্র বাংলাদেশে স্লোগান উঠেছিল-“জয়দেবপুরের পথ ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর”।
গাজীপুরে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/