গৌরব অহংকার আর গরিমার আরও একটি দিন পার করছি আমরা। ভূবনজোড়া একুশে উদযাপন আমাদের গরিমাকে আরও বৃদ্ধি করেছে। অহংকারে আমরা আরও বিকশিত হয়েছি, পুষ্পের মতো আরও সহস্র পাপড়ি নিয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছি আমরা, বাঙালিরা। মহান একুশে পালিত হচ্ছে বিশ্বের দেশে দেশে। আফ্রিকার দেশ সিওরালিয়ন পালন করছে সে দেশের দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে মর্যাদা পাওয়া আমাদের বাংলা ভাষার জন্য আত্মদানকারীদের স্মরণ করে।
ভাষা ক্রমবিকাশশীল, ভাষা ক্রম সম্প্রসারণশীল, ভাষা ক্রমবর্ধনশীল। ভাষা ক্রমবিবর্তনশীল। ভাষার আদান প্রদান, ভাষার চর্চা, ভাষার অনুশীলন, ভাষার প্রকাশ, ভাষার গবেষণা ভাষাকে আরও বিকশিত করে। ভাষার ডালপালা বিস্তৃত হয়। ভাষা নিঃসন্দেহে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রস্ফুটিত হয়। ভাষার অবিরাম চর্চায় শব্দকোষ বাড়ে, ভাষার বাঁধন বলিষ্ঠ হয়। একদিন এই ভাষা বাংলা নিশ্চয়ই খিড়কি পুকুর থেকে নদী, নদী থেকে সাগর, মহাসাগরে পরিণত হবে। এ কারণেই তো একুশের জন্ম হয়েছিল। এই একুশে নিয়ে আমাদের কত যে ভালবাসা তার পরিমাপ নিশ্চিত করা যাবে না। এই ভাষা নিয়ে আমাদের কত যে প্রেম , কত যে ভালবাসা, কত যে আশা প্রত্যাশা তারও শেষ নেই।
‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি’। সালাম, জব্বার, রফিক, সফিক, বরকতরা তো সে কারণেই বুক পেতে দিয়েছিল। তাদের ঝরা রক্তে প্রস্ফুটিত হয়েছে শাপলা, শতদল। ‘যে নারীর মধু প্রেমেতে আমার রক্ত দোলে, যে শিশুর মায়া মমতায় আমার বিশ্ব ভোলে, সেই শান্তির প্রহর গুনি’। মাতৃভাষার জন্য সেদিনের ছাত্র জনতা এই জন্যই তো প্রাণ দিতে পিছপা হয়নি। মাতৃভাষাকে মায়ের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার অবিরাম সংগ্রাম আমাদের চলার পথকে সুগম করে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। অস্ত্র হাতে আমাদের লড়তে শিখিয়েছে। একাত্তরে মহান স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে নেওয়ার শক্তি সাহস যুগিয়েছে। ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার সাহস দেখিয়ে আমরাই চূড়ান্ত মুক্তির পথের সিঁড়ি বেয়ে চলতে শিখেছি। আমরাই বিশ্বকে শিখিয়েছি মাতৃভাষার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত আমরা। কারণ বাংলা ভাষা আমাদের প্রাণ, বাংলা আমাদের মান, বাংলা আমাদের অহংকার। এই ভাষায় কথা বলি, এই ভাষায় মা ডাকি, এই ভাষায় প্রেম নিবেদন করি, এই ভাষায় শিশুকে আদর স্নেহ করি, শিশু এই ভাষায় মা ডাকে। এই ভাষায় আমরা খুনসুটি পাড়ি, এই ভাষায় আড্ডাবাজি করি, এই ভাষায়ই আমাদের রং তামাশা। এই বাংলা ভাষায় প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা প্রকাশ করি, এই ভাষায় আমাদের হাসি আমাদের কান্না। এই ভাষায় গান গাই, এই ভাষায় বাঁশের বাঁশরী বাজাই। এই ভাষাই আমাদের সভ্যতা গড়েছে, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশ করেছে। বাংলা ভাষা আমাদের শিক্ষা দিয়েছে। বাংলা ভাষাতেই আমরা ডুবে যাই সঙ্গীত ভূবনে।
মহান একুশে পালনে সে কি উচ্ছ্বাস। রাজশাহী কলেজে মানব মিনার তৈরি করে পালিত হয়েছে মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মাতৃভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন ৫২’তে, তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করতেই এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। আমরা মানব প্রাচীর দেখেছি। মহান বিজয় দিবসে কোটি জনতা বাংলাদেশের মানচিত্র রচনা করেছে, এক কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি গেয়ে উঠেছে। রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরা মানব প্রাচীর তৈরি করে তাদের প্রাণোচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। সেখানেই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। এই ভাষার সাথে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের রক্ত, হাসি, কান্না, ভালবাসা ও অহংকার। দেশের উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের দাসিয়ারছড়া ও পাটগ্রামে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীও বিনশ্র শ্রদ্ধায় পালন করছেন মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। তারা ইট মাটি কাগজ কিংবা কদলি বৃক্ষ দিয়ে হাতে তৈরি অস্থায়ী শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ভাষা শহিদদের প্রতি। যশোরের বেনাপোল সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ডে শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন দুই বাংলার মানুষ। ভাষার জন্য, মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা জানাতে, বাংলাভাষাকে তার যথাযথ মর্যাদা দিতে, ভাষা শহীদদের সম্মানিত করতে দুই দেশের মানুষ একুশে ফেব্রুয়ারিতে ফুল হাতে নিয়ে ভুলে যান সব সীমারেখা। তারা একাকার হয়ে প্রত্যুষে গেয়ে ওঠেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। বাংলা ভাষা আমাদের সকল শক্তির উৎস। বাংলা ভাষা আমাদের সাহস, আমাদের প্রেরণা, বাংলা আমাদের ভালবাসা।
গত বছর একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে আমি উত্তরবঙ্গের বগুড়া শহরের সাতমাথা থেকে বাসে চড়েছিলাম সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে। পথে পথে আমি দেখেছি অগণিত মানুষকে ভাষা শহিদদের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানাতে। শত শত শিক্ষার্থীর হাতে ফুল। তারা ফুল দিচ্ছে শহিদ বেদিতে। ঘন কুয়াশার চাদর ভেদ করে প্রভাত ফেরিতে অংশ নিতে পায়ে হেঁটে চলা শিক্ষার্থীরা তাদের অগ্রজ রফিক শফিক জব্বার বরকত সালামদের সালাম জানাতে কেমন এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের মুখে বাজছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। স্কুল কলেজ মাঠে কাগজের তৈরি শহিদ মিনার গড়ে ফুল দিচ্ছে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। পাশেই মাইকে ক্ষণে ক্ষণে বেজে উঠছে ‘আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি’। ‘আমরা হারবো না হারবো না, তোমার মাটির একটি কণাও ছাড়বো না’। শহিদ মিনার চত্বরে মাটিতে নুইয়ে পড়ে শিশুদের চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা দেখেছি। তারা তাদের তুলির আঁচড়ে গড়ে তুলছে এক একটি শহিদ মিনার, কখনও বা ভাষা শহিদদের অবয়ব। পথের ধারে পাশে উন্মুক্ত প্রান্তরে আলোচনা সভা। মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আবারও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার জোরালো দাবি। ইংরেজি নয়, বাংলায় আদালতের রায় লেখার দাবিতে সোচ্চার তারা। সকল বিষয়ের পাঠ্যকে বাংলায় উন্নীতকরণের দাবি। গৃহ কোণ থেকে বাংলাকে পূর্ণ মাত্রায় খোলা বাতাসে নিয়ে আসতে হবে। সব সরকারি অফিস আদালতে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বাংলাকে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঐতিহ্যে উদ্ভাসিত ২১ শে ফেব্রুয়ারি শুধু মাত্র একটি দিনেরই নাম নয়, বাঙালির জাগরণের একটি স্মারক। এই প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে ধারাবাহিকভাবে এই স্মারক বয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যেই বাংলাকে আরও উন্মুক্ত প্রান্তরে নিয়ে যেতে হবে।
পথে পথে আমি দেখেছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে স্কুল কলেজ শিক্ষার্থীদের রচনা প্রতিযোগিতা, নান্দনিক হস্তলেখা প্রতিযোগিতা, দেশাত্মবোধক গানের প্রতিযোগিতা। জাতীয় পতাকাকে অর্ধনমিত রেখে শহিদদের প্রতি জাতির বিনশ্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন দেখেছি আমি। ভাষা শহিদদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় দেখেছি বিশেষ প্রার্থনা। হাতছানি দিয়েছে। আমার প্রাণ ভরে উঠেছে যখন দেখেছি চার দিকে ফুলের পাহাড়, এক একটি ফুলই যেনো এক একটি শহিদ মিনার, ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে যে মিনার।
সাতক্ষীরায় শহিদ বেদিতে জমেছে ফুলের পাহাড়। শহিদ রাজ্জাক পার্কে শহিদদের স্মরণে আলোচনা সভা, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে শিশুদের আবৃত্তি, সুন্দর হাতের লেখা ও চিত্রাংকন প্রতিযোগিতার চিহ্ন। ততক্ষণে নিজের মোবাইল ফোনে ছোট্ট একটি বার্তা পৌঁছেছে, ‘জান দিয়েছি, দেইনি তবু বাংলা ভাষার মান, নির্ভয়ে তাই গাইতে পারি এমন ভাষার গান’।
পত্র পত্রিকায় পড়েছি ‘সেই পাকিস্তান, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শত্রু, যারা আমাদের ভাষা শহিদদের বুকে গুলি করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল, এবার তারা করাচি, ইসলামাবাদ ও লাহোরে নানা আয়োজনের মধ্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করেছে বলে বিবিসিকে খবর দিয়েছেন পাকিস্তানি সাংবাদিক মনির আহমেদ। বহু ভাষার দেশ প্রতিবেশি ভারতও পূর্ণ মর্যাদায় পালন করছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আমার প্রত্যয় জেগেছে বাংলা তার আপন মহিমায় এভাবেই হয়ে উঠবে একটি প্রস্ফুটিত গোলাপ, একটি মহাসমুদ্র। আর মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে সাতক্ষীরার ভোমরা ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে ২১ ভারতীয় বাংলাদেশে প্রবেশ করে বাংলা ভাষার জয়গান গেয়েছেন। তারা বলেছেন বাংলা ভাষায় আমরা এক। আমি দেখেছি ইট কাদামাটি কলাগাছ আর লাল কালো কাপড়ের ক্যানভাসে ঘেরা নিজেদের হাতে তৈরি শহিদ মিনারে শিশু কিশোরদের পুষ্পার্ঘ অর্পণের সেকি উচ্ছ্বাস। কণ্ঠে তাদের কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি , আমি কি ভুলিতে পারি’। লেখক: সাতক্ষীরা করেসপন্ডেন্ট, এনটিভি ও দৈনিক যুগান্তর
সাতক্ষীরার পথে পথে একুশে
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/