যুগ এখন বিশ্বায়নের, যেখানে আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বিচরণ করছি। তথ্য-প্রযুক্তির ক্রম বর্ধমান বিকাশে সমগ্র পৃথিবী এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। আর প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উদ্ভাবন এ কাজকে করছে সহজ থেকে সহজতর। বিষয়টি বাংলাদেশেও সমগুরুত্ব বহন করছে। কেননা ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। আর এই গুরুত্ব অনুধাবন করেই বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নামে একটি স্বতন্ত্র বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যা পাঠ্যক্রম হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে। এর সুফলও আমরা পেতে শুরু করেছি। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি তথা ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহারের বেশ কিছু কুফলও ইতোমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। যা আমাদের তরুণ সমাজের উপর এমনকি শিশুদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
যেমন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি নিয়ে সকলেই বেশ উদ্বিগ্ন। শুধু তাই নয়, ইন্টারনেট ব্যবহারে অধিক মনোযোগী হওয়ায় লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে অনেকে। শিক্ষা জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে অনেকের। মোবাইল, ফেসবুক, গেমস ইত্যাদি নিয়ে নতুন প্রজন্ম ব্যস্ত। পাশাপাশি বসে কেউ কারো সাথে এখন কথা বলে না, তারা শুধু ব্যস্ত ইন্টারনেট নিয়ে। ছেলেমেয়েরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। এ কারণে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে ও পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে।
সবচেয়ে ভয়ংকর হলো, খুব অল্প বয়সে অনেক শিশুই পর্নসাইটে আসক্ত হয়ে পড়ছে। বিকৃত রুচির চটিগুলোও বাদ থাকছে না তাদের বিচরণ থেকে। এতে বাড়ছে নানা সামাজিক অসঙ্গতি।
ইভটিজিং, ধর্ষণ, অশ্লীল কর্মকা-ের ভিডিও ধারণ ও তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়ে ব্লাকমেইলিংয়ের ঘটনা ঘটছে অহরহ। যা শিশুদের নৈতিক মূল্যবোধকে করছে ধুলিসাৎ। নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সময় ও মেধা। যা জাতির কাছে অপ্রত্যাশিত, ক্ষতিকর।
একই সাথে ব্লু হোয়েলসহ বিভিন্ন আত্মঘাতি গেমে আসক্ত হয়ে অনেক শিশুর জীবন অকালে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অনেকে জড়িয়ে পড়ছে উগ্র মৌলবাদি জঙ্গী গোষ্ঠীর সাথে।
যেহেতু ইন্টারনেট বা তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য, সেহেতু অন্তত শিশুদের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির ব্যবহার এখনই নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরী। শিশুরা ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে কি করতে পারবে, কি করতে পারবে না, কোন সাইটে প্রবেশ করা যাবে, কোনটিতে যাবে না, কোনটি শিশুর জন্য ক্ষতিকর ও হুমকি সরূপ তা নির্দিষ্ট করা দরকার।
একই সাথে ইন্টারনেটের অপব্যবহারের মাধ্যমে শিশুদের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে বিষয়টি নিয়ে পরিবারের সাথে আলোচনা, উঠান বৈঠক, জনসভা, মানববন্ধন, র্যালি, বির্তক প্রতিযোগিতা, নাটক, প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন, লিফলেট বিতরণ, অভিভাবক সমাবেশ, পাড়ায় পাড়ায় দলগঠন করে শিশুদের নিয়ে কাউন্সেলিং ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারে সচেতনতা বিষয়ক নির্দেশিকা পাঠদান করা যেতে পারে। এতে শিশুরা ইন্টারনেটের অপব্যবহার সম্পর্কে জানতে পারবে।
সেই সাথে শিশু আইন ২০১৩ বাস্তবায়ন করা জরুরী হয়ে পড়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি শিশুকে অসৎ পথে চালিত করে বা যৌন কর্ম বা নীতি গর্হিত কোন কাজে লিপ্ত হওয়ার সম্মুখিন করে তাহলে এই আইনের অধীনে অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। যার শাস্তি সর্ব্বোচ্চ ৩ বছর ও সর্বনি¤œ ২ বছর কারাদন্ড প্রদান করা হবে । এছাড়া সর্ব্বোচ্চ ১ লক্ষ টাকা এবং সবনি¤œ ৫০ হাজার টাকা অর্থ দন্ডের বিধান আছে ।
অন্যদিকে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধনী ২০১৩) এ বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে কিংবা অনলাইনের মাধ্যমে কোন কিছু প্রকাশ করা, যা মিথ্যা ও অশ্লীল এবং এর দ্বারা কোন ব্যক্তি নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হয়, মানহানি ঘটে, ব্যক্তির ভাবমূর্তি নষ্ট হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এ ধরনের তথ্য প্রকাশ করলে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। যার শাস্তি সর্Ÿোচ্চ ১৪ বছর এবং সর্বনি¤œ ৭ বছর কারাদ- এবং এক কোটি টাকা পর্যন্ত আর্থিক জরিমানা হতে পারে।
অপরদিকে, পর্নগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি কোন শিশুকে পর্নগ্রাফিতে অংশগ্রহণ, প্রলোভন, অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করে ভয়ভীতি দেখানোর মাধ্যমে আর্থিক বা অন্য কোন সুবিধা গ্রহণ করে বা মানসিক নির্যাতন করে বা পর্নগ্রাফি সরবরাহ বা প্রদর্শন কাজে লিপ্ত থাকে তাহলে অপরাধী বলে বিবেচিত হবে। যার সর্ব্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছর সশ্রম কারাদ- এবং সর্ব্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা হবে।
এক্ষেত্রে এ বিষয়টি প্রশংসার দাবিদার যে, সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে অসংখ্য পর্ন সাইট ব্লক করে দিয়েছে। তবে, তা থেকে যে শিশুরা পরিপূর্ণ নিষ্কৃতি পেয়েছে, তা নয়। একই সাথে অংখ্য ভুইফোড় ওয়েব সাইট যৌন সুড়সুড়ি দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ বিষয়টি অনেকটা প্রকাশ্য হলেও এক্ষেত্রে সরকারের কোন পদক্ষেপ এখনো চোখে পড়েনি। যদিও পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই শিশুকে এ বিষয়ে প্রথমেই সতর্ক করা দরকার।
ইন্টারনেটের অপব্যবহার রোধ, এর মাধ্যমে যৌন হয়রানি ও নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করছে অগ্রগতি সংস্থা। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক আব্দুস সবুর বিশ্বাসের মতে, ইন্টারনেটের অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিদিন অসংখ্য শিশু যৌন নির্যাতন ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। অনেক শিশু না বুঝেও অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। এজন্য শিশুদেরকে আগাম সতর্ক করা দরকার। আমাদেরকে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পাঠ্যসূচির অংশ হিসাবে ইন্টারনেট ব্যবহার বিধি সম্পর্কে ছাত্র-ছাত্রী তথা শিশুদেরকে সচেতন করা শুরু করেছে। তাছাড়া বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে। আমরাও অগ্রগতি সংস্থার বাস্তবায়নে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সহযোগিতায় ইন্টানেটের মাধ্যমে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কার্যক্রমের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছি।
সর্বোপরি, ইন্টারনেটের অপব্যবহারের সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে শিশুদের সুরক্ষায় সমাজের সকলকে এক সাথে কাজ করতে হবে। তা না হলে জাতিকে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখিন হতে হবে। সরকারকে নিরাপদ ইন্টারনেটের ব্যবহারবিধি পাঠ্যপুস্তকে সংযুক্ত করতে হবে, পাশাপাশি বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। ইন্টারনেট সেবাকে ইতিবাচক কাজে ব্যবহার করার জন্য সমাজের সব শ্রেণি পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে, শিশুদেরকে সচেতন করতে হবে। পারিবারিক বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করতে হবে। সেইসাথে মা-বাবা তথা অভিভাবককে হতে হবে ইতিবাচক ও বন্ধুসুলভ মনোভাবাপন্ন। তবেই আমরা গড়ে তুলতে পারবো শিশুর নিরাপদ ভবিষ্যৎ। লেখক: সাংবাদিক, যুগ্ম সম্পাদক, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব
শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ; ইন্টারনেটের অপব্যবহার রোধ করতে হবে: আব্দুস সামাদ
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/