শাহারিয়ার হুসাইন, বাগআঁচড়া (যশোর): শার্শা উপজেলার একমাত্র সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষের একমাত্র চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র ৫০ শয্যার শার্শা উপজেলা (বুরুজবাগান) স্বাস্থ্য কমপে¬ক্স। সেবা প্রদানের জন্য দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ সরকারি হাসপাতালে কয়েকজন চিকিৎসক রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে রোগীদের সাথে প্রতারণা ও বাইরের পছন্দের বেসরকারি ক্লিনিকের সাথে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি এ হাসপাতাল ৩১ শয্যা থেকে উন্নীত হয়ে ৫০ শয্যায় রুপান্তরিত হয়েছে। ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও এখনও পর্যন্ত কোন ডাক্তার বা জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে ২শ’ রোগী হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন। বহির্বিভাগে প্রত্যেক রোগীর কাছ থেকে টিকিটের জন্য ৫ টাকা করে আদায় করা হলেও রোগীরা কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হওয়ার নিয়ম থাকলেও সাড়ে ১০টার আগে কোন চিকিৎসককে হাসপাতালে দেখা মেলে না। আবার বেলা ১টা বাজলে কোন ডাক্তারকে হাসপাতালে খুঁজেও পাওয়া যায় না। দূর-দূরন্ত থেকে রোগীরা চিকিৎসা নিতে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা চিকিৎসকের অপেক্ষায় বসে থেকে কাঙ্খিত সেবা না পেয়ে চলে যান। উপজেলার আমতলা-গাতিপাড়া গ্রামের বৃদ্ধা রওশনারা (৬০) ও তাহেরা বেগম (৫৫) জানালেন, সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত টিকিট কেটে ডাক্তারের অপেক্ষায় বসে আছি, এখনও কোন ডাক্তার হাসপাতালে আসেননি। হাসপাতালে রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অশোক কুমার সাহা নিজেই বাইরের পছন্দের বেসরকারি ক্লিনিকে রোগী পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে।
উপজেলার লক্ষণপুর গ্রামের নয়নতারা (২৭) জানান, হাসপাতালের জরুরী বিভাগ থেকে সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার নিজামুল ইসলাম বাইরের পছন্দের বেসরকারি ক্লিনিক থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নিয়ে আনতে বলেন। আমরা গরীব মানুষ, বেসরকারি হাসপাতালে ভালো ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে গেলে অনেক টাকা লাগে তাই বুরুজবাগান এই হাসপাতালে এসেছি। কিন্তু ডাক্তারের অভাবে আমরা ভালো চিকিৎসা পাচ্ছি না। কিন্তু উল্লিখিত পরীক্ষাগুলো হাসপাতালের নিজস্ব প্যাথলজিক্যাল বিভাগ থেকে করানো হয় বলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মরত টেকনিশিয়ান হুমায়ুন কবীর স্বীকার করলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের এক কর্মচারী জানালেন, এই হাসপাতালের নিজস্ব প্যাথোলজিক্যাল বিভাগে যে সব রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় তার ৮০ ভাগ রোগী কমিশন বাণিজ্যের জন্য চিকিৎসকরা বাইরের পছন্দের বেসরকারি ক্লিনিকে পাঠাচ্ছেন। ফলে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) এনাম উদ্দিন শিপন অফিসের বিভিন্ন কাজে অধিকাংশ সময়ে হাসপাতালের বাইরে থাকেন। দাঁতের চিকিৎসক রাবেয়া খাতুনের চিকিৎসা সেবার মান সন্তোষজনক নয় এবং তিনি সারাক্ষণ মোবাইল ফোনে ফেসবুক দেখেই সময় কাটান। আর তার সহকারী আনিছুর রহমান রোগীদের সেবা না দিয়ে প্রায়ই হাসপাতালের বারান্দায় বা অন্যরুমে গল্প করে সময় কাটাতে দেখা য়ায়। নাভারণ বাজারে আনিছুর রহমানের নিজস্ব দন্ত চিকিৎসালয় থাকায় তিনি হাসপাতালের রোগীদের সেখানে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক উৎপলা দত্ত ডিউটি চলাকালীন অধিকাংশ সময়ে বাসায় অবস্থান করেন। হোমিও চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর উপস্থিতি দেখে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অশোক কুমার সাহা মোবাইল ফোনে চিকিৎসক উৎপলাকে চেম্বারে ডেকে পাঠান। স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কন্যা চিকিৎসক হুমায়রা আশরাফী তন্বী জরুরী বিভাগে ডিউটিরত অবস্থায় এক রোগীর অভিভাবকের সাথে অনাকাঙ্খিত ও অশালীন আচরণ করতেও দেখা যায়। হাসপাতালের প্রশাসনিক ব্যবস্থা এতই নাজুক যে হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত স্টোরকিপার জরুরী বিভাগে চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আবার কোরবানী ঈদের সময় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক উৎপলা হাসপাতালের জরুরী বিভাগে এক সপ্তাহ যাবৎ এালোপ্যাথিক চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এদিকে হাসপাতালে সার্জিক্যাল বিভাগ, মেডিসিন বিভাগ, গাইনি বিভাগ ও অ্যানেস্থেসিয়া বিভাগে কনসালটেন্ট পদে কখনো কোন ডাক্তার নিয়োগ দেয়া হয়নি। এভাবে উপজেলার একমাত্র সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অশোক কুমার সাহা বলেন, সব উপজেলা হাসপাতালে ডাক্তারের সংকট রয়েছে। কোথাও দুই তিন জনের বেশি ডাক্তার নেই। সরকারিভাবে নতুন করে নিয়োগ দিলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এবং রোগীরাও কাক্সিক্ষত সেবা পাবেন।
শার্শা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মুখ থুবড়ে পড়েছে স্বাস্থ্য সেবা
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/